রবিবার, ১৬ মে, ২০২১

উপন্যাস “দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়” গাজী সাইফুল ইসলাম ॥ এক ॥
“As a woman I have no country. As a woman my country is the whole world.” -Virginia Wolf. দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসটিতেই মুক্তি সেরনিয়াবাতের মনে হলো এখানেও সে একা। প্রথম ক্লাসে সবাই কত উৎফুল্ল, নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যস্ত। মুক্তির না হচ্ছে কোনো আনন্দ, না জাগছে কোনো ব্যাপারে আগ্রহ। সবসময়ের মতো চুপচাপ থাকতেই তার ভালো লাগছে। সবাই যখন পছন্দের মানুষটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য হাত বাড়াচ্ছে মুক্তির তখন নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই ভালো লাগছে। কত ছাত্র-ছাত্রী আর কলরবের মধ্যে সে আছে কিন্তু এসবের কোনো ছাপই পড়ছে না তার মনের ওপর। দূরে দাঁড়িয়ে মানুষ যেমন করে কোনো অচেনা, অপরিচিত জায়গার দিকে তাকায় মুক্তিও তেমনই তাকিয়ে আছে সবার দিকে। কেন্দ্রের ভেতরে থেকেও কেন্দ্রের বাইরে, দৃশ্যের মধ্যে থেকে অদৃশ্য। ম্যাডাম ক্লাসে এলেন। হাতে তার স্নাতক শ্রেণির ‘গল্প পাঠ’ বইটি। বোঝা গেল বাংলার টিচার। বয়সে নবীন, সুন্দরী, স্মার্ট। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই উঠে দাঁড়ালে তিনি বললেন:‘‘বসো, বসো। শোনো আমি তোমাদের বাংলা পড়াব। এই যে দেখছ, এই বইটা। লেকচার শুরু করব আগামী ক্লাস থেকে। আজকে আমরা পরিচিত হবো। ও হ্যাঁ, আগে আমার পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমি ‘নাহিদার রহমান’। ঢাবির অনার্স, মাস্টার্স। এখানে জয়েন্ট করেছি ২০১১ সালে। বাড়ি গাজীপুরের ভুরুলিয়ায়। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত, এক সন্তানের জননী। এখন তোমাদের পালা। ওই বেঞ্চ থেকে শুরু হোক, একেকজন করে তোমাদের নাম, কোথা থেকে এসেছ জানিয়ে দাও। শেষ বেঞ্চের উত্তর প্রান্তে বসা একটি মেয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘‘আমার নাম সাগুপ্তা ইয়াসমিন, ইভা। এসছি, ঢাকার সাভার থেকে।’’ এভাবে বেশ ক’জন বলল। কিন্তু অনেকেই ইতস্তত করছে, কেউ উঠি, উঠব করছে। মুক্তি বসেছিল দ্বিতীয় ব্যাঞ্চের দক্ষিণ প্রান্তে। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাডামের চোখ পড়ল তার ওপর। তার দিকে আঙুল তুলে বললেন: ‘‘এই মেয়ে দাঁড়াও, তোমার নাম কী? কোথা থেকে এসেছ?’’ ‘‘ম্যাডাম! মুক্তি সেরনিয়াবাত আমার নাম, ‘ফুলেশ্বরী’ বাড়ির পাশের নদী, ‘কবি চন্দ্রাবতী’র পাতোয়ারী এ অভাগীর জন্ম-জন্মান্তের গ্রাম।’’ -‘‘বাহ! তুমিতো দেখছি আরেক চন্দ্রাবতী কথা ভরা কবিতা আর ফুলে জানি না বাবা কে তোমার বসতি ফুলেশ্বরীর কোন কূলে?’’ ক্লাসে পিন পতন নিরবতা। -শোনো মুক্তি, ম্যাডাম নয়, আপা বলবে। তোমার দু’টি বিষয় আমি বুঝলাম না: ‘এ অভাগী’ আর ‘জন্ম-জন্মান্তর’। কেনো তুমি অভাগী? আর তুমি কি জন্মান্তরে বিশ্বাস করো? -জন্মান্তর ধারণায় কখনও করি কখনও করি না। সে অস্পষ্ট ধারণার আঁধার এখনও আমার কাটেনি। ম্যাডাম বুঝেছেন, একটি উত্তর মুক্তি এড়িয়ে গেছে। তিনিও সেটি পাশ কেটে বললেন: বুঝেছি, সময় লাগবে। যাহোক, আমি বহু বছর ধরে তোমার গ্রাম ‘পাতোয়ারী’তে যাওয়ার কথা ভাবছি। কিন্তু হয়ে উঠেনি। এখন মনে হয়, আমার সে স্বপ্ন পূরণ হবে। একদিন আমি তোমার সঙ্গেই ঈসা খাঁ ট্রেনে চড়ে বসব। ‘‘আমি সানন্দে রাজি, ম্যাডাম।’’ ‘‘আবার ম্যাডাম?’’ সব ছাত্রছাত্রীরা হেসে ফেলে। মুক্তি বুঝতে পারছিল না এতে হাসির কী আছে? বলল:‘‘সরি আপা।’’ ‘‘ও হ্যাঁ, ভালো কথা। আমার মনে হলো, তুমি খুব মনমরা কিংবা অন্যমনস্ক হয়ে আছ, কেন বলত? রাতে ঘুমাও নি?’’ ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীর দৃষ্টি এবার মুক্তির ওপর। এক বান্দর ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,‘‘আপা, নতুন বিয়ে হয়েছে তো।’’ ওর কথা শুনে সব ছাত্রছাত্রী হেসে ভেঙে পড়ছে। ‘‘ও সরি, তাই নাকি?’’ ম্যাডামের প্রশ্নের কী উত্তর দেবে মুক্তি বুঝতে পারছিল না। লজ্জায় তার কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে সে শক্ত করে বলল: ‘‘জি আপা।’’ এমন একটি কথা কেন যেন তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো সে বুঝতেই পারল না। ‘‘খুব ভালো, ওয়েলকাম। কামনা করছি, তোমার দাম্পত্য জীবন সুখের হোক। কিন্তু পড়াশোনার জার্নিটা একটু কঠিন হবে-এই আরকি। ওকে, ক্লাসে সবার সঙ্গে কথা বলবে, মিশবে, হাসবে। দেখবে ভালো লাগবে। আসলে আমাদের জীবনটা একটা জার্নি। আজ এখানে, কাল ওখানে, এরপর হয়তো কোথাও নেই। ও হ্যাঁ, সমপ্রতি আমি একটা উপন্যাস শেষ করেছি। উপন্যাসটার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে তোমার গ্রাম আর নদীর কথা। সবটাই গবেষণা আর কল্পনা থেকে। খুব ইচ্ছে, বইটা প্রকাশ করার আগে ওই গ্রামটায় আমি একবার অন্তত যাই, ওখানকার ধূলোয় শুয়ে, বসে একটি সন্ধ্যা পার করি। ফুলেশ্বরীর বুকে নৌকায় চড়ে এর পানির স্পর্শ নিই, তীরের কোনো গ্রামে যাপন করি একটি রাত।’’ -আপা, আপনার ইচ্ছে পূরণ করার জন্য আমি সবকিছু করতে প্রস'ত। -ওহ ধন্যবাদ। আচ্ছা এবার তোমরা বল, অন্যদের দিকে ইঙ্গিত করে, কে বলতে পারবে-ওর গ্রাম ‘পাতোয়ারী’ কেন বিখ্যাত? সবাই চুপচাপ। কেউ কথা বলছে না। -আশ্চর্য! কেউ জানো না? মুক্তি তুমিই বলো, এদের জানিয়ে দাও। -চন্দ্রবতী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মহিলা কবি, ষোড়শ শতাব্দিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল কিশোরগঞ্জের পাতোয়ারী গ্রামে, ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। যার বাবা ছিলেন কবি দ্বিজ কানাই। ভালো নাম দ্বিজ বংশীদাস। ‘মহুয়া, মলুয়ার পালা ও মনসা-মঙ্গল কাব্যের কবি। -শুনলে? ভুলো না কিন্তু সারজীবন ধরে শুনলেও চন্দ্রাতবতীর গল্প পুরোনো হবে না। আচ্ছা ঠিক আছে, এবার তুমি দাঁড়াও। তোমার নাম কী?’’ ওই বান্দর ছেলেটির দিকে আঙুল তুললেন ম্যাডাম। -আসগর ইমতিয়াজ আপা, কিন্তু... -কিন্তু কী? -সবাই ডাকে অজগর বলে। -অজগর, মানে সাপ? -জি আপা। -খুব ভালো নাম। তো ওর যে বিয়ে হয়েছে তুমি জানো কীভাবে?’’ -আপা, এটা তো হিউম্যান সাইকোলজির ব্যাপার। বিবাহিত মেয়েরা বিয়ের প্রথমদিকে একটু চুপচাপ থাকে। এরপর মুখরা হয়, কথা শুরু করলে মাশাল্লাহ আর থামে না। -বা! তুমি তো দেখছি মেয়েদের সাইকোলজিতে একেবারে পিএইচডি করে এসেছ। একটি ছেলে দাঁড়িয়ে বলল: আপা এ কথা তো আমাদের গুরু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছেন। বলব তিনি কী বলেছিলেন? -বলো। -‘‘বিয়ের পর প্রথম ছেলে বলে মেয়ে শুনে, এরপর মেয়ে বলে ছেলে শুনে। এরপর দু’জন বলে পাড়াপ্রতিবেশী শুনে।’’ -ধন্যবাদ তোমাকে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার জন্য। তো মি. অজগর, তোমার রেজাল্ট সম্পর্কে আমাদের একটু বলো। এসএসসিতে... ‘‘গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ।’’ ‘‘এইচএসসিতে?... -গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ। -কী বলছ দুষ্টু ছেলে, এত ভালো রেজাল্ট তোমার? -আপা, আমি মোটেই দুষ্টু ছেলে নই। স্কুল জীবনে স্যারেরা আমাকে ঠাণ্ডা মিয়া বলে ডাকতেন। -কলেজ জীবনে? -ওই যে অজগর। -তাহলে তো এখানেও তোমার একটা নাম দিতে হয়। -জি না আপা, আগেরগুলোতেই চলবে। না হলে আমি নামের ভারে অচল হয়ে যাব। তার কথা শুনে সবার কী হাসি। -এই তোমরা শোনো (সব ছেলেমেয়ের প্রতি), তোমরা সবাই মিলে ওর একটা নাম ঠিক করে নিও। -জি ম্যাডাম। -নো, আই ডোন্ট লাইক ম্যাডাম, আপা। -ওকে আপা। -ঠিক আছে আজকের মতো ক্লাস এখানেই শেষ। আগামী ক্লাসে আমরা পড়ব সুবোধ ঘোষের ‘জতুগৃহ’ গল্পটি। একটু পড়ে এসো। ও হ্যাঁ, গল্পটির নামকরণ সম্পর্কে একটু ধারণা দিয়ে রাখি যাতে তোমাদের বুঝতে সুবিধা না হয়। -আচ্ছা, তোমরা কেউ মহাভারত পড়েছ? -জি না ম্যাডাম। অনেকে একসঙ্গে বলল। -কিন্তু পড়া দরকার। যাহোক, ‘জতুগৃহ’ নামটি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী থেকে নেয়া। মহাভারতে আছে: ‘‘দুর্যোধন পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য, বরণাবতে একটি ঘর নির্মাণ করেছিলেন। সেই ঘরটির নামই ‘জতুগৃহ’। তারা কৌশলে সে ঘরে পাণ্ডবদের (পঞ্চপাণ্ডব) থাকার ব্যবস্থা করেছিল। দুর্যোধনের সঙ্গে এ পরিকল্পায় যুক্ত ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র, দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনি প্রমুখ। দুর্যোধনের মন্ত্রী পুরোচনের ওপর দায়িত্ব ছিল ওই ঘরে আগুন দেওয়ার। কিন্তু বিদুর পূর্বেই যুধিষ্ঠিরকে এ বিষয়টি অবগত করান। এরপর বিদুরের প্রেরিত খননকারীর সহায্যে পাণ্ডবরা ঘরের ভেতর থেকে নিকটবর্তী নদীতীর পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ খনন করান। তারা ঘরটিতে এক বছর ধরে বসবাসের পর, কুন্তী একদিন একটি ভোজসভার আয়োজন করেন। ভোজসভার রাত গভীর হলে পাণ্ডবরা এই ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং বিদুরের পাঠানো নৌকায় করে নদী পার হয়ে পলায়ন করে। সে সময় পুরোচন, তার পাঁচ পুত্র ও এক হাতীর মাহুত ওই ঘরে অবস্থান করছিল। তারা অতিরিক্ত মদপানজনিত কারণে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফলে তারা সকলেই পুড়ে মারা যায়।’’ এখন গল্পটি পড়ার পর তোমরা নামকরণের স্বার্থকতা বিশ্লেষণ করো। আগামী ক্লাসে দেখব কে সবচেয়ে ভালো পারো। ধন্যবাদ সবাইকে। ম্যাডাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে ক্লাসে হাসির জোয়ার বইয়ে গেল। মুক্তিও শেষ পর্যন্ত না হেসে পারল না যখন বান্দর আসগর তার সামনে এসে বলল:‘‘দুঃখিত, তোমাকে বিবাহিত বলার জন্য। আমি শুধু ফান করার জন্য বলেছি। আর তুমি কিনা বললে, তুমি বিবাহিত। সত্যি কি তুমি বিবাহিত?’’ -হ্যাঁ, এটা কি মিথ্যে বলার বিষয়? -ও তাহলে তো, ঢিলটা আমি যথার্থই মেরেছি। -তো আর বলছি কি? আপনাকে অচিরেই বৌভাতে অনুষ্ঠানে দাওয়াত করব। যাবেন কিন্তু! -শুধু আমি কেন? সবাই যাবে। -ঠিক আছে সবাই যাবেন। ॥ ২ ॥ দর্শনের ক্লাস। সো স্মার্ট একজন স্যার এসে হাজির। কিছু ছাত্র-ছাত্রী দাঁড়িয়েছে আর কিছু তখনও মোবাইল ফেসবুকে নিবিষ্ট। -বসুন বসুন, কেমন আছেন আপনারা?’’ -ভালো স্যার। আপনি ভালো আছেন তো? সমস্বরে প্রায় সবাই বলে উঠল। -ক্লাসের সময়ও যদি ছাত্র-ছাত্রীরা ফেসবুকে ডুবে থাকে-তাহলে কীভাবে ভালো থাকি বলুন? এই আপনারা আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? মোবাইল অফ। ক্লাসের সময় মোবাইল চালাতে হলে ক্লাসের বাইরে থাকতে হবে। অন্তত আমার ক্লাসে। -জি স্যার। আজগর ওঠে দাঁড়াল। স্যার, একটা কথা বলব? -বলেন। -স্যার, আমাদের ‘আপনি’ না বলে তুমি বলুন। ‘আপনি’ শুনতে ভালো লাগে না। -তোমরা তো এখন আর শিশু নেই-বড় ব্যাটা হয়ে গেছ, ইন্টার পাস দিয়েছ। সবারই মুখে গোঁপ-দাঁড়ি। -তবু স্যার। -ঠিক আছে, আপত্তি না থাকলে। আচ্ছা বসো। এটা বিশ্ববিদ্যালয়। কথায় কথায় দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই। ও হ্যাঁ, আমি তোমাদের দর্শন পড়াব। পড়াব বলতে আমি বোঝাচ্ছি আলোচনা করব। আসলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কাউকে কিছু শেখাতে পারে না, পথ দেখাতে পারে। আর সে পথে সারাজীবন ধরে ছাত্রী-ছাত্রীদের নিজেদের মত করে চলতে হয়, শিখতে ও শেখাতে হয়। আমি আশা রাখি তোমরাও তাই করবে। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের চোরাগলিতে পা দিয়ে পথ হারাবে না। -বিশ্ববিদ্যালয়ের চোরাগলি? আসগর বলল। -আছে, আলোকিত গলিও আছে। সেটাই হোক তোমাদের পথ। -ইয়েস স্যার। একজন ছাত্র, যার নাম ইবনূল বারি, দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘স্যার, আগে আমরা পরস্পর পরিচিত হয়ে নিতে পারতাম।’’ -তোমার নাম? -সৈয়দ ইবনূল বারি। -ওহ সুন্দর নাম। যাহোক ইবনূল, পরিচয় এমনিতেই হয়ে যাবে। আগে আমরা পরস্পরের মুখ চিনব। এরপর বিহেভিয়ার...এরপর নাম, ধাম। এখন বললেও মনে থাকবে না। -ইয়েস স্যার, আপনার কথায় যুক্তি আছে। আজগর বলল। -পরিচয় পরিমিতি, বন্ধুত্ব এগুলো জীবনের জন্য এক ধরনের ফর্মালিটিস। এগুলোর খুব বেশি প্রয়োজন নেই। সত্য বলতে এগুলো দিয়ে কিছু হয়ও না। -কী বলছেন স্যার? পরিচয়, বন্ধুত্ব এগুলো দিয়ে কিচ্ছু হয় না? -ইউরোপ-আমেরিকার কথা বাদ দিলে ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষ যেখানে উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু করে না সেখানে সব ফর্মালিটিসের পেছনেই আমি উদ্দেশ্য দেখতে পাই। তুমি সরকারের যে কোনো সেবাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখবে তোমাকে সাহায্য করার জন্য অতি উৎসাহী লোকের অভাব নেই। প্রথমেই তারা তোমাকে ছালাম দেবে। কিন্তু... -স্যার, সালাম তো আমরাও আপনাদের দিই। -এটাও এ ধরনের ফর্মালিটিস। কিন্তু ওদেরটা আরেক ধরনের ফর্মালিটিস। আমি বলি: দালাল ফর্মালিটিস। একসঙ্গে অনেকে এগিয়ে আসবে। ‘‘কোথা থেকে এসছেন, কী কাজ আপনার?’’সবই আসলে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কেউ চা অফার করবে। চায়ের দামটা কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে। ও হ্যাঁ, তোমার পাঁচশ টাকার কাজ সে করে দেবে একহাজার থেকে পাঁচহাজার টাকা নিয়ে। নির্বাচনের সময়ের ফর্মালিটিসগুলোর কথা মনে করতে চেষ্টা কর? কী মূল্য আছে সে সবের? এমন হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যাবে। এভাবে বিচার করলে দেখবে আমাদের দেশে ফর্মালিটিসের মৃত্যু হয়েছে। ফর্মালিটিস এখন অতি তোষণের নাম... -জি স্যার, অতি তোষণ, দারুণ বলেছেন স্যার। পেছন থেকে আরেকটি ছেলে বলল। -যা হোক, আমরা যুক্তি, তর্ক থেকে দর্শনের দিকে যাব। অপ্রিয় বিষয়ও হয়তো চলে আসবে। তোমরা সেসব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। হাউজের মানে ক্লাসের বাইরে না। আমার মনে হয়, দর্শনের সংজ্ঞা সম্পর্কে তোমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। দর্শন হলো জ্ঞানবিদ্যা। কেউ কেউ বলেছেন: জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা। তোমরা কেউ কিছু বলতে পারো? মানে দর্শন কী? -কেউ কোনো কথা বলছে না। স্যার একটি মেয়ের দিকে ইঙ্গিত করলেন: এই তোমার নাম কী? -স্যার, সাগুপ্তা ইয়াসমিন ইভা। -বলতে পারো কোনো দার্শনিকের নাম? -পারি স্যার। এই মুহূর্তে একজন অস্ট্রিয়ো দার্শনিকের নাম আমার মনে পড়ছে। তার নাম লুডবিগ উইটজেনস্টাইন। তার বিখ্যাত উক্তি: ‘‘আমার ভাষার সীমাবদ্ধতার অর্থ হলো আমার পৃথিবী সীমাবদ্ধ।’’ কিংবা ‘‘আমি জানি না কেন আমরা এখানে আছি, তবে আমি বেশ নিশ্চিন্ত যে, এটা আমাদের নিজেদের উপভোগের জন্যও নয়।’’ -খুব ভালো বলেছ। একেবারে কন্টেম্পরারি। -মি. লুডবিগ ‘এখানে’ দ্বারা তিনি কী বুঝিয়েছেন স্যার...? পেছন থেকে বোধিচন্দ্র প্রশ্ন করল। -এ পৃখিবীকে। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, তোমার নাম কী? -বোধিচন্দ্র দত্ত। -বসো বোধি। দর্শনের আলোচ্য বিষয় জীবন ও জগৎ , উৎপত্তি, বিলয়, কিংবা মৃত্যুর পরে কী হয় সেসব বিষয়ে আলোচনা। -জি স্যার। -এগুলো বইয়ে আছে তোমরা পড়ে নেবে। লুডবিগ উইটজেনস্টাইন সম্পর্কে ইভার কাছ থেকে পরে আরও জানব। আর কেউ অন্য কোনো দার্শনিকের নাম বল, কে বলবে? -জাঁ জ্যাক রুশো। হেদায়েতুল ইসলাম বলল। -থ্যাঙ্কিয়ু। তার কোনো বইয়ের নাম? -সোসাল কন্ট্রাক্ট। -তাঁর কোনো দর্শন বাক্য কেউ বলতে পার? -Yes Sir, Man is born free but everywhere he is in chain. হেদায়েতুল ইসলাম বলল। -হ্যাঁ, মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত। -স্যার, সবসময় শিশু স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। এটা দার্শনিকের উত্তম চিন্তা কিন্তু কোনো কোনো দেশে শিশু মাতৃগর্ভেই ঋণগ্রস্থ, শিকলাবদ্ধ। জাতিসংঘ শিশু সনদের বেশিরভাগ তার ভাগ্যে জুটে না। -তোমার কথাও ঠিক। কিন্তু তিনি বিষয়টাকে প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। যাহোক, তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার নাম কী? -হেদায়েতুল ইসলাম, স্যার। -শোনো, আমি খুব খুশি। মনে হচ্ছে, তোমাদের দিয়ে হবে। ওকে হেদায়েত তুমি বসো। আর কেউ বলবে কোনো দার্শনিকের নাম? -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজগর দাঁড়িয়ে বলল। -রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে অনেকেই হেসে ফেলল। -এই তোমরা হাসলে কেন? আচ্ছা, তোমার নাম কী? যে ছেলেটা রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে হেসেছিল স্যার তার দিকে আঙুল তুললেন? -তুফান শেখ, স্যার? তুফানের নাম শুনে সবাই হেসে ফেলল। -তুফান শেখ? ক্লাস রোলেও তোমার এই নাম? -জি স্যার, কোনো সমস্যা? -ওহ নো, সরি। তাহলে আমার ক্লাসে সৈয়দ আছে, শেখও আছে -স্যার, ঠাকুর, ব্রাহ্মণ আছে, ক্ষত্রিয়ও আছে। -ওহ তাই নাকি? ওয়াও। আচ্ছা, বোধিচন্দ্র দত্ত তুমি কোনো দার্শনিকের নাম কিংবা তার কাজের অংশ উল্লেখ করতে পার? -জি স্যার, শঙ্করাচার্য। কা তব কান্তা কন্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীব বিচিত্রঃ কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভ্রাতঃ।। -আমি বিস্মিত। তোমরা আমাকে চমকে দিচ্ছ। তো বোধি অর্থ বলতে পারবে শ্লোকটির? -জি স্যার। ‘‘কে তোমার স্ত্রী? কে বা তোমার পুত্র? এই সংসার হলো অতীব বিচিত্র। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? তত্ত্ব সহকারে এ বিষয়ে চিন্তা করে দেখ। -আরে কী বলছ বোধি! তোমরা তো দেখছি সবাই জন্ম দার্শনিক। -ও হ্যাঁ, এবার তুফানকে শুধাই, পরে হয়ত ভুলে যাব: তোমার নাম শুনে, এক বিদেশি শিল্পী তুফান রাফাইয়ের কথা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। -স্যার, আমার বাবা সেই তুফান রাফাইয়ের গল্প পড়েই আমার নাম তুফান রেখেছিলেন। -তাই নাকি? আচ্ছা, তার কথা একদিন আমরা তোমার কাছ থেকে শুনব। আচ্ছা, তুফান, এখন তুমি বল, রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে খুব হেসেছিলে, কেন? উনি কি দার্শনিক নন? -স্যার, উনিতো কবি, কথা সাহিত্যিক। তুফান শেখ রিপিট করল। -আচ্ছা, আজগর এবার তুমি বল, তুমি কেন রবীন্দ্রনাথকে দার্শনিক বলেছিলে? -আজগর মাথা চুলকাচ্ছে। কী বলবে গুছাতে পারছে না। -স্যার, দর্শনে রবীন্দ্রনাথের স্পেসিফিক কোনো কাজ নেই ঠিক, তবে বিচ্ছিন্নভাবে বহু লেখায় তাঁর দর্শন আমরা পাই। কুটিল সাংমা বলল। -যেমন? -‘‘প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নতুন আবির্ভাবে কে তুমি? মেলেনি উত্তর। বৎসর বৎসর চল গেল। দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগর তীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়- কে তুমি? পেল না উত্তর।’’ আকাশ স্যার: ওহ কুটিল, এতক্ষণ করেছিলে চুপ, শেষটায় জানিয়ে দিলে তুমি যে পোড়া ধূঁপ। কুটিল: জি না স্যার। আমি বড় নাদান। সারাজীবন ব্যাক বেঞ্চার। মুক্তি: ব্যাক বেঞ্চাররাই অনেক সময় সবচেয়ে বড় অ্যাডভেনচারের কাজটা করে ফেলে, স্যার। আকাশ স্যার: হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আইনস্টাইন, বিল গেট, জ্যাক মা। মুক্তি: রবীন্দ্রনাথের এ ক’টি বাক্যের মধ্যেই ভারতীয় দর্শনের বেশিরভাগ অনুসন্ধান রয়েছে। আর এর উত্তরহীনতার মধ্যে। উপমহাদেশীয় সকল ভাবালুতার মুখবন্ধ রবীন্দ্রনাথের এ ক’টি বাক্যে বিকাশুন্মুখ। এখানে সব আছে, ভাববাদ, আধ্যাত্মবাদ, অজ্ঞেয়বাদ... আকাশ স্যার: মুক্তি, ওহ্ মুক্তি, তোমার কথায় রয়েছে অনেক যুক্তি। মুক্তি: প্লিজ স্যার, বাড়িয়ে বলবেন না। এমনিতেই আমরা অলস, কর্মবিমুখ, পড়াচোর। প্রশংসা পেয়ে হয়তো মাথায় উঠব, সব ছেড়ে ছুঁড়ে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বশেষ সার্কাস দেখতে বসে যাব। কুটিল সাংমা: মানে? মুক্তি: কিছু না। আকাশ স্যার: অলস মানুষ কিন্তু জ্ঞানী হয়। ইভা: স্যার, ঘরে আগুন লাগলে অলস তো উঠে দেখবে না কী হচ্ছে, ফলে সকল জ্ঞানসহ পুড়ে মরবে। আকাশ স্যার: আরে অত অলস না যে ঘরে আগুন লাগলেও উঠে দেখবে না। কুটিল সাংমা: স্যার, মুক্তি যে বলল: সর্বশেষ সার্কাস, এর মানে বুঝলাম না? মুক্তি: এটা বুঝলে না? ভোট বিহীন নির্বাচন, এক দলীয় শাসন, করাপশন। আকাশ স্যার: ওহ, রাজনীতি বাদ। মুক্তি: এই তো আপনাদের বড় সমস্যা, স্যার। আকাশ স্যার: কী সমস্যা? মুক্তি: দর্শনের উৎপত্তি মূলত ধর্মচিন্তা থেকে আর এর বিকাশ প্রধানত রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ণের মাধ্যমে ক্ষমতার টিকে থাকার উদ্দেশ্য থেকে। যেমন দাস প্রথা ও কলোনিজম টিকিয়ে রাখার জন্যও দার্শনিক পরামর্শ ছিল। আমি একটু পড়ে শোনচ্ছি: John Locke took part in administering the slave-owing colonies… a philosopher who put forth radical ideas while working on behalf of slavery and colonism.. আর আপনারা এখনও রাজনীতি থেকে দর্শন ও ধর্মকে বাদ দিতে চাচ্ছেন। আকাশ স্যার: কারণ এর পেছনে ঐতিহাসিক সত্য রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক, দর্শনের সূতিকাগার। ওখানে কখনও কি রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব ছিল? মুক্তি: কেনো যে আপনারা প্রাচীন গ্রীককেই দর্শনের সূতিকাগার বলেন? যেখানে স্পষ্ট প্রাচীন মশিরীয়রা, পিথাগোরাস, প্লেটো, পারমেনিডস আর অ্যারিস্টটলের ২৫০০ বছর আগে জ্ঞানবিদ্যার চর্চা করেছিলেন। খ্রিস্টের জন্মের ২৩৫০ বছর আগের মিসরীয় পাতাহহোতেপ সম্পর্কে জানুন। দেখুন তিনিই প্রথম বলেছিলেন: ‘‘সত্য ও ন্যায় বিচারের শক্তি এটাই যে, শেষাবধি তারা বিজয়ী হয়।’’ আর ধর্ম থেকে দশর্নকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা একেবারে দর্শন চিন্তার শুরু থেকেই হয়ে আসছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সফল হয় নি, হবেও না কোনোদিন। তবে হ্যাঁ, হতো, যদি চিন্তাজগতে মুসলমানদের আগমন না ঘটত। -ধর্ম থেকে দর্শনকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা প্রথম কখন হয়েছে? -থেলিসের সময় থেকে। -মানে প্রথম দার্শনিক? -জি স্যার। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফিতে(১৯৪৫) যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন: এটাই ঠিক চিন্তা যে, খ্রিস্ট্রের জন্মের পূর্বের ছয় শতাব্দিতে প্রথম দার্শনিক থেলিসের আবির্ভাব ঘটেছিল গ্রিক কলোনি মাইলিটাস বা মিলিটাসে, যেটির বর্তমান নাম তুরস্ক। আর তখনকার চিন্তাবিদরাই প্রথম ধর্ম থেকে দর্শনকে আলাদা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। রাসেলই লিখেছেন: After all, the thinker who is called the first philosopher, Thales, is remembered for remarking, “All things are full of Gods.” আকাশ স্যার: আমি চাই রাজনীতি থেকে ধর্ম আলাদা হোক। কুটিল সাংমা: কোন যুক্তিতে স্যার। আকাশ স্যার: ঝগড়া এড়ানোর জন্য। মোমিনূল হক: কিন্তু আমার ধর্ম? পারফেক্ট কোড অব মাই লাইফ। এরপরও আমি চাই সকলমতের সহবস্থান কিন্তু সমন্বয় নয়। যেমনটি চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আকবর যে সমন্বয় করেছিলেন সেটিও অচল মুদ্রা। জগাখিুচরি বেশিদিন টিকে না। ধর্মানুভূতি মানুষের চিরন্তন। এটা কিছুতেই দাবিয়ে রাখা যায় না। যদি যেত তাহলে ধর্মকে আফিম আখ্যায়িত করা কমিউনিস্ট রাশিয়ার পতন ঘটত না। এই চাওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর-গান্ধী-বিবেকান্দ কিংবা আরও অনেকের থেকে এগিয়ে। -হ্যাঁ, ঠিক। চমৎকার যুক্তি উপস্থাপনের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। হেদায়েত: রবীন্দ্রনাথের এই কবিতায় আমরা লালনের প্রভাব দেখতে পাই। এক ধরনের অনিশ্চিত স্পিরিচোয়ালিটি। আকাশ স্যার: শুধু লালন নয়, হাফিজ, রুমি, জামি, ইকবাল, কবীর, সারমাদ সবাইকে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথে। তাঁর কাপে ধোঁমায়িত আধ্যাত্মিকতা আধুনিক রূপ লাভ করেছে। এ জন্যই মাঝে-মধ্যে আমি বলি: ‘‘সব কবিই দার্শনিক। কিন্তু সব দার্শনিক কবি নন।’’ -স্যার হেদায়েতের এ কথাটা বুঝলাম না, ‘অনিশ্চিত স্পিরিচোয়ালিটি’। স্পিরিচোয়ালিটির আবার অনিশ্চিন্ততা কী? -জবাব তো হেদায়েতর দেবার কথা, তাই না? হেদায়েত: লালনে যে স্পিরিচোয়ালিটি আমরা পাই: সেটা অনিশ্চিন্ত। কারণ তাঁর স্পেসিফিক কোনো ধর্ম ছিল না। তিনি খোদাকেও ডেকেছেন, ভগবানকেও পুঁজেছেন। হিন্দু ঘরে জন্মগ্রহণ করে মুসলমান ঘরে লালিত-পালিত। আবার তাঁর গুরু হলেন: সিরাজ শাঁই। এসব কারণেই তাঁর আধ্যাত্মিকতাকে আমি অনিশ্চিন্ত বলেছি। সত্য বলতে তিনি নিজেই জানতেন না: কোন গন্তব্যে যেতে চান তিনি। আকাশ স্যার: তোমার বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আরও আলোচনার দাবী রাখে। এরপর একটি সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া যেতে পারে। যাহোক, পরে না হয় কোনোদিন লালন দর্শনের ওপর একটি আউডডোর আলোচনায় আমরা অংশগ্রহণ করব। আচ্ছা, একটি প্রশ্ন আমার মাথায় উঁচি-চুকি দিচ্ছে: রবীন্দ্রনাথের দর্শনের কোনো দার্শনিক নাম বা সংজ্ঞা কি কেউ দিতে পারি আমরা? অর্থাৎ তার দার্শনিক কাজকে আমরা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করব? আসগর: ইতোমধ্যেই তা করা হয়ে গেছে। কেউ বলেছেন রবীন্দ্রনাথের দর্শনের নাম ‘আনন্দবাদ’, কেউ বলছেন: আধ্যাত্মবাদ । -তাহলে নিশ্চয়ই তুমি দুঃবাদী এক দু’জন কবির নামও বলতে পারবে? -নিশ্চয়ই স্যার। কায়কোবাদ, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। -ও দারুণ বলেছ। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত শুধু দুঃখবাদীই নন। তিনি নিরেশ্বরবাদীও। অর্থাৎ ঈশ্বরে যার বিশ্বাস নেই। -স্যার ‘‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই।’’ এ হলো নিরেশ্বরবাদীদের বক্তব্য। পেছন থেকে বোধিচন্দ্র সরকার দাঁড়িয়ে বলল। -ওর কথা ঠিক আছে স্যার, কিন্তু এ কালীদাসের কথা। আর সত্যেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত বলেছেন: শুনহ মানুষ ভাই! সবার উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ, স্রষ্টা আছে কি নাই।।’’ -ওহ খুব ভালো লাগছে। ক্লাসটি আমি দারুণ উপভোগ করছি। -স্যার, একজন সমালোচক বলেছেন: যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘দুঃখবাদ’ আসলে রবীন্দ্রনাথের ‘আনন্দবাদ’এর প্রতিবাদ। এখানে ব্যক্তিগত কোনো ক্ষয়-ক্ষতি বা দুঃখ জড়িত নয়। অর্থাৎ তাঁর দীর্ঘশ্বাস মানে নৈরাশ্যবাদী দীর্ঘশ্বাস, যে সুখ তিনি পেতে চেয়েছিলেন তার নাগাল পাননি বলে। ঠিক কায়কোবাদেও একই কথার প্রতিধ্বনি। তাঁর বাক্যে বাক্যে দুঃখ ও নৈরাশ্যবাদ ঝরে পড়ে। হেদায়েতুল ইসলাম বলল। -কিন্তু কায়কোবাদ কিছুতেই নিরেশ্বরবাদী ছিলেন না। সাগুপ্তা শারমিন ইভা বলল। -স্যার, কায়কোবাদের দুঃখ আসলে মানবীয় প্রেম-বিরহ কিংবা আর্থিক দৈন্য জনিত নয়, ভাববাদী চিন্তা প্রসূত। ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনাঙক্ষা থেকে এ রকমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। যেমন: ‘‘দূরে থেকে দূরে রেখে কি সুখ প্রিয়?’’ -রবীন্দ্রনাথে ঈশ্বরভাবনা বা আধ্যাত্মিকতা বেশি। বহু লেখায় তিনি নিজেকে ঈশ্বরে কিংবা ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে বিলিন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, যেমনটি কায়কোবাদের ধরন। -কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ আরও উন্নত, আধুনিক। কুটিল সাংমা বললো -হ্যাঁ, ঠিক বলেছ: তাঁর স্বর্গ ভাবনা অনেক বেশি আধুনিক? বোধি: জি স্যার। এটা তার আধ্যাত্মিকতারই অংশ। -উদারহরণ দাও। -রবীন্দ্রনাথের ছোট্ট একটি কবিতা ’প্রার্থনা’। ওতে পাওয়া যায়:‘‘আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক।’’ আজগর: উপনিষদেও ঠিক এ রকমই আছে: ‘‘অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জোতির্গময়... রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম।’’ অর্থাৎ হে সত্য, সমস্ত অসত্য হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও; হে প্রকাশ, তুমি একবার আমার হও, আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক। -এ আলোচনা আরও দীর্ঘ হলে ভালো লাগত। -মুক্তি দাঁড়াল। স্যার, আমি কিছু বলতে চাই। -কিন্তু ঘণ্টা পড়ে গেছে। তবু বল, শুনি। মুক্তি: রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি কবি হিসেবে, দার্শনিক হিসেবে না। আমাদের দেশের অমির, সমির, জমির যেমন কবি, কাক-কোকিলও তেমনই কবি। আদি কবি দৌলিত কাজী, শাহ সগীর থেকে শুরু করে আমরা খাইও কবিতা, পোশাকও পরি কবিতার। তাই আমাদের কাছে দর্শন দুর্বোধ্য। গ্রিক-জার্মানরা আমাদের বিপরীত। তারা কবি হওয়ার চেয়ে জোর দেয় দার্শনিক হওয়ার ওপর। এ সমস্ত কারণে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে আমরা যতটা কাড়াকাড়ি করেছি তাঁর শিক্ষা ও বিশ্ব বিষয়ক অনেক লেখা যেগুলোতে দর্শন আছে, সে সব আমরা ওই অর্থে ছুঁয়েও দেখি নি। বহির্বিশ্বের লেখক পণ্ডিতগণ সে সম্পর্কে প্রচুর লিখেছেন। কোথায় পড়েছি মনে পড়ছে না-তাঁর দর্শন প্রসঙ্গে কেউ একজন লিখেছেন: ‘‘Very few studies are available to understand the philosophical views of Rabindranath Tagore in the light of his attitude and realization of universalism. '' আসগর: স্যার, মুক্তি সঠিক কথাই বলেছে:‘‘ দর্শন আমাদের কাছে দুর্বোধ্য।’’ প্রসঙ্গত একটা বাক্য আমি শুনাচ্ছি: There’s an unfortunate perception that philosophy is, by nature, obscure, difficult and inaccessible . ইভা: কিন্তু স্যার দর্শন আমাদের পড়তেই হবে কেনো? হেদায়েত: স্যার, এর উত্তরটা Cicero দিয়েছেন: Philosophy can enrich the lives of anyone with a thirst for knowledge or self-improvement. -ওয়াও! খুব সুন্দর। শোনো, আউটডোর ক্লাসে এসব বিষয় নিয়ে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করব। তোমরা জানোতো, আউটডোরেও যে আমরা ক্লাস নিই? আর প্রথম আলোচনা করতে চাই রবীন্দ্র দর্শনের ওপর। -জি স্যার। আপনি চাইলেই আমরা হাজির হবো। -আচ্ছা শোনো, যদিও আজকের আলোচনা যতটা না দর্শন বিষয়ক তার চেয়ে অনেক বেশি সাহিত্য নির্ভর হয়ে গেছে। তবু, আমি খুশি। আমার সময়টা খুব নিরামিশ যাচ্ছিল। আমরা জানলাম দর্শনে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কোনো কাজ নেই? কিন্তু ভালো সাহিত্যিক না হলে ভালো দার্শনিক হওয়া যায় না এমন একটি সিদ্ধান্তেও আমরা পৌঁছলাম। যাহোক প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, কথা বলে ভালো লাগল। আগামি ক্লাসে আমরা পড়ব, গ্রিক ফিলোসফি। তোমরা পড়ে এসো। -জি স্যার। -যাবার বেলায় বলব: ‘‘আর শুধু এইটুকু রেখ মনে আকাশ আহমেদ আমার নাম এখানেই প্রথম পরিচয় তোমাদে সঙ্গে বাংলারই এক অজ পাড়াগাঁয়ে ধাম।’’ -থ্যাঙ্কুয়ু স্যার। চলবে- ॥ তিন ॥

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন