বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১

Fbook Theke “দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়’’ গাজী সাইফুল ইসলাম
ভূমিকা: আমরা জানি যে, ‘‘উপন্যাসের কেনো ভূমিকার প্রয়োজন হয় না” তবু আমার এ উপন্যাসের একটি ভূমিকা লিখতে হচ্ছে। কারণ উপন্যাসটিতে পাঠকের প্রবেশের আগে কিছু ধারণা মাথায় রাখলে ভালো হবে। এর মূল গল্পের সঙ্গে আরও অসংখ্য গল্প ও প্রতিগল্প উপস্থাপিত হয়েছে সে সব নিয়ে দ্বন্দ্ব কলহের শেষ নেই। মত-প্রতিমত-বিরোধ, আপাত বিরোধ, স্ববিরোধ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এতে আছে। এমনকি পাগলের প্রলাপও এতে রয়েছে। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীর যুগ-জনমের দ্বন্দ্ব এর বাক্যে বাক্যে ছড়ানো। আমি শুধু তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। ‘‘আমি কে? কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাব?’’ ইসলামসহ সকল প্রধান ধর্মে এর সুনির্দিষ্ট উত্তর রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানি ও দার্শনিকগণ যুগ যুগ ধরে নিজেদের মত করে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজে গেছেন। কারণ তারা ধর্ম নির্ধারিত পথে যেতে চান নি। তারা, সংখ্যায় অনেক, ধর্মেই বিশ্বাস করেননি। এ উপন্যাসে আমি ধর্মবেত্তা ও দার্শনিকদের মতগুলো খুঁজেছি, জড়ো করেছি, সবার জন্য সহজপাঠ্য করেছি। সক্রেটিসের পদ্ধতি ছিল উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে বেশি বেশি প্রশ্ন করা। আমি প্রশ্ন করেছি উত্তরও খুঁজেছি। আর সবসময় চেয়েছি, না মানুক কিন্তু সবচেয়ে কাঙিক্ষত উত্তরটি মানুষ জানুক। ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত এলাকা শাকুয়াই, সেখানে একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি কলেজ আছে। আমি সেখানে কংসের তীরে একটি দর্শন বিশ্ববিদ্যালয় কল্পনা করে নিয়েছি। আমার কথা, এতে ভর্তি হওয়ার জন্য ছাত্রদের নেই কোনো বয়সের কিংবা সিলেবাসের বাইনিন্ডংস। যে কেউ ইচ্ছে করলে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে। বছর শেষে নিয়ম মেনে পরীক্ষা দিলেই মিলে দার্শনিকের সার্টিফিকেট। প্রতিটি মানুষ তার জায়গায় তার মত করে দার্শনিক। সবাই প্রকৃতির দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এখানে-ওখানে বিশ্বের সর্বত্র। জীবনের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষ তার মত করে দার্শনিক, কবি, বুদ্ধিজীবী। সবাই যদি সবার কথা লিখে রেখে যেত জগৎ গার্বেজ হয়ে যেত। কেউ কারুরটা পড়া তো দূরের কথা ফিরেও তাকাত না। আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময় ক্লাসে আমি স্যারদের, বিশেষ করে, দর্শন বিভাগের স্যারদের অনেক প্রশ্ন করতাম। আমার প্রশ্ন শুনে অনেকেই হাসত, কেউ কেউ ঠাট্টা করে আমায় দার্শনিক বলে ডাকত। পরে দেখলাম আমার এ নামটাই সকল বিভাগের ছাত্রদের মধ্যেও চালু হয়ে গেছে। আজ বহু বছর পর আমার সেইসব বন্ধুদের ঠাট্টার জবাব দিয়েছি এ দর্শন পটভূমির উপর এই উপন্যাস লিখে। কিন্তু আমি এ-ও জানি ‘‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন‘‘ শুনতে ভালো লাগে না। “I don’t want to teach you philosophy but how to philosophize.’’ ছোট্ট এই বাক্যটি কবে কোথায় প্রথম পড়েছিলাম মনে নেই। কার লেখা তাও মনে নেই। কিন্তু পরে Teaching of Sir Immanuel kant-এ আমরা পেয়েছি: “Not to learn philosophy, but rather how to philosophize…;’’ তাঁদের এমন সব বক্তব্য দ্বারা সারাজীবন আমি অণুপ্রাণিত হয়েছি। এই বইয়ে আমি আমার নিজের চিন্তা ও মত যত না দিয়েছি তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি চিন্তা ও মত নিয়েছি দেশের সাধারণ মানুষের। কারণ তারাই আমার টার্গেট চরিত্র। এ জন্য 'ফেসবুক বাহাস'এ দেখিয়েছি-তারা কী বলে? সকল পাঠকের প্রতি অনুরোধ এ বইকে ব্যক্তি, গোষ্ঠি অথবা কোনো মহুলের বিশেষের উদ্দেশ্যমূলক প্রচরাণা ধরে নেবেন না। আমি শুধু উপমহাদেশীয় দর্শনকে ইউরোপ, আমেরিকা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শনের আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়েছি। কাউকে আঘাত করা, হেয় বা ছোট করার চেষ্টা এতে হয়নি। সকল ধর্মের, বর্ণের সকল মানুষের মতের প্রতি শ্রদ্ধা এতে দেখানো হয়েছে। বিশ্ব হোক শান্তিপূর্ণ, সহবস্থানের পাদপিঠ। সকলের মুক্ত মতের প্রতিফলনে গড়ে উঠুক, প্রসারিত ও বিকশিত হোক আমাদের চিন্তার জগৎ। সকল শুভানুধ্যায়ী ও দর্শনগুরুদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি আমার এ বক্তব্য, ধন্যবাদ। উৎসর্গ: তোমাকে হে যুবক! অমৃত সরোবর আত্মা তোমার উঠুক জেগে চাপাপড়া ভূয়াদর্শনের পাথরের নিচ থেকে মার খেও না চোখ বুজে বেওকুবি ও অলসতায় গা ভাসিয়ে অকর্মণ্য চিন্তায় সত্তার মহান ঝর্ণাকে বুকে চেপে রেখে। ॥এক॥ “As a woman I have no country. As a woman my country is the whole world.” -Virginia Wolf. দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসটিতেই মুক্তি সেরনিয়াবাতের মনে হলো এখানেও সে একা। প্রথম ক্লাসে সবাই কত উৎফুল্ল, নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যস্ত। মুক্তির না হচ্ছে কোনো আনন্দ, না জাগছে কোনো ব্যাপারে আগ্রহ। সবসময়ের মতো চুপচাপ থাকতেই তার ভালো লাগছে। সবাই যখন পছন্দের মানুষটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য হাত বাড়াচ্ছে মুক্তির তখন নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই ভালো লাগছে। কত ছাত্র-ছাত্রী আর কলরবের মধ্যে সে আছে কিন্তু এসবের কোনো ছাপই পড়ছে না তার মনের ওপর। দূরে দাঁড়িয়ে মানুষ যেমন করে কোনো অচেনা, অপরিচিত জায়গার দিকে তাকায় মুক্তিও তেমনই তাকিয়ে আছে সবার দিকে। কেন্দ্রের ভেতরে থেকেও কেন্দ্রের বাইরে, দৃশ্যের মধ্যে থেকে অদৃশ্য। ম্যাডাম ক্লাসে এলেন। হাতে তার স্নাতক শ্রেণির ‘গল্প পাঠ’ বইটি। বোঝা গেল বাংলার টিচার। বয়সে নবীন, সুন্দরী, স্মার্ট। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই উঠে দাঁড়ালে তিনি বললেন:‘‘বসো, বসো। শোনো আমি তোমাদের বাংলা পড়াব। এই যে দেখছ, এই বইটা। লেকচার শুরু করব আগামী ক্লাস থেকে। আজকে আমরা পরিচিত হবো। ও হ্যাঁ, আগে আমার পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমি ‘নাহিদার রহমান’। ঢাবির অনার্স, মাস্টার্স। এখানে জয়েন্ট করেছি ২০১১ সালে। বাড়ি গাজীপুরের ভুরুলিয়ায়। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত, এক সন্তানের জননী। এখন তোমাদের পালা। ওই বেঞ্চ থেকে শুরু হোক, একেকজন করে তোমাদের নাম, কোথা থেকে এসেছ জানিয়ে দাও। শেষ বেঞ্চের উত্তর প্রান্তে বসা একটি মেয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘‘আমার নাম সাগুপ্তা ইয়াসমিন, ইভা। এসছি, ঢাকার সাভার থেকে।’’ এভাবে বেশ ক’জন বলল। কিন্তু অনেকেই ইতস্তত করছে, কেউ উঠি, উঠব করছে। মুক্তি বসেছিল দ্বিতীয় ব্যাঞ্চের দক্ষিণ প্রান্তে। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাডামের চোখ পড়ল তার ওপর। তার দিকে আঙুল তুলে বললেন: ‘‘এই মেয়ে দাঁড়াও, তোমার নাম কী? কোথা থেকে এসেছ?’’ ‘‘ম্যাডাম! মুক্তি সেরনিয়াবাত আমার নাম, ‘ফুলেশ্বরী’ বাড়ির পাশের নদী, ‘কবি চন্দ্রাবতী’র পাতোয়ারী এ অভাগীর জন্ম-জন্মান্তের গ্রাম।’’ -‘‘বাহ! তুমিতো দেখছি আরেক চন্দ্রাবতী কথা ভরা কবিতা আর ফুলে জানি না বাবা কে তোমার বসতি ফুলেশ্বরীর কোন কূলে?’’ ক্লাসে পিন পতন নিরবতা। -শোনো মুক্তি, ম্যাডাম নয়, আপা বলবে। তোমার দু’টি বিষয় আমি বুঝলাম না: ‘এ অভাগী’ আর ‘জন্ম-জন্মান্তর’। কেনো তুমি অভাগী? আর তুমি কি জন্মান্তরে বিশ্বাস করো? -জন্মান্তর ধারণায় কখনও করি কখনও করি না। সে অস্পষ্ট ধারণার আঁধার এখনও আমার কাটেনি। ম্যাডাম বুঝেছেন, একটি উত্তর মুক্তি এড়িয়ে গেছে। তিনিও সেটি পাশ কেটে বললেন: বুঝেছি, সময় লাগবে। যাহোক, আমি বহু বছর ধরে তোমার গ্রাম ‘পাতোয়ারী’তে যাওয়ার কথা ভাবছি। কিন্তু হয়ে উঠেনি। এখন মনে হয়, আমার সে স্বপ্ন পূরণ হবে। একদিন আমি তোমার সঙ্গেই ঈসা খাঁ ট্রেনে চড়ে বসব। ‘‘আমি সানন্দে রাজি, ম্যাডাম।’’ ‘‘আবার ম্যাডাম?’’ সব ছাত্রছাত্রীরা হেসে ফেলে। মুক্তি বুঝতে পারছিল না এতে হাসির কী আছে? বলল:‘‘সরি আপা।’’ ‘‘ও হ্যাঁ, ভালো কথা। আমার মনে হলো, তুমি খুব মনমরা কিংবা অন্যমনস্ক হয়ে আছ, কেন বলত? রাতে ঘুমাও নি?’’ ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীর দৃষ্টি এবার মুক্তির ওপর। এক বান্দর ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,‘‘আপা, নতুন বিয়ে হয়েছে তো।’’ ওর কথা শুনে সব ছাত্রছাত্রী হেসে ভেঙে পড়ছে। ‘‘ও সরি, তাই নাকি?’’ ম্যাডামের প্রশ্নের কী উত্তর দেবে মুক্তি বুঝতে পারছিল না। লজ্জায় তার কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে সে শক্ত করে বলল: ‘‘জি আপা।’’ এমন একটি কথা কেন যেন তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো সে বুঝতেই পারল না। ‘‘খুব ভালো, ওয়েলকাম। কামনা করছি, তোমার দাম্পত্য জীবন সুখের হোক। কিন্তু পড়াশোনার জার্নিটা একটু কঠিন হবে-এই আরকি। ওকে, ক্লাসে সবার সঙ্গে কথা বলবে, মিশবে, হাসবে। দেখবে ভালো লাগবে। আসলে আমাদের জীবনটা একটা জার্নি। আজ এখানে, কাল ওখানে, এরপর হয়তো কোথাও নেই। ও হ্যাঁ, সমপ্রতি আমি একটা উপন্যাস শেষ করেছি। উপন্যাসটার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে তোমার গ্রাম আর নদীর কথা। সবটাই গবেষণা আর কল্পনা থেকে। খুব ইচ্ছে, বইটা প্রকাশ করার আগে ওই গ্রামটায় আমি একবার অন্তত যাই, ওখানকার ধূলোয় শুয়ে, বসে একটি সন্ধ্যা পার করি। ফুলেশ্বরীর বুকে নৌকায় চড়ে এর পানির স্পর্শ নিই, তীরের কোনো গ্রামে যাপন করি একটি রাত।’’ -আপা, আপনার ইচ্ছে পূরণ করার জন্য আমি সবকিছু করতে প্রস'ত। -ওহ ধন্যবাদ। আচ্ছা এবার তোমরা বল, অন্যদের দিকে ইঙ্গিত করে, কে বলতে পারবে-ওর গ্রাম ‘পাতোয়ারী’ কেন বিখ্যাত? সবাই চুপচাপ। কেউ কথা বলছে না। -আশ্চর্য! কেউ জানো না? মুক্তি তুমিই বলো, এদের জানিয়ে দাও। -চন্দ্রবতী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মহিলা কবি, ষোড়শ শতাব্দিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল কিশোরগঞ্জের পাতোয়ারী গ্রামে, ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। যার বাবা ছিলেন কবি দ্বিজ কানাই। ভালো নাম দ্বিজ বংশীদাস। ‘মহুয়া, মলুয়ার পালা ও মনসা-মঙ্গল কাব্যের কবি। -শুনলে? ভুলো না কিন্তু সারজীবন ধরে শুনলেও চন্দ্রাতবতীর গল্প পুরোনো হবে না। আচ্ছা ঠিক আছে, এবার তুমি দাঁড়াও। তোমার নাম কী?’’ ওই বান্দর ছেলেটির দিকে আঙুল তুললেন ম্যাডাম। -আসগর ইমতিয়াজ আপা, কিন্তু... -কিন্তু কী? -সবাই ডাকে অজগর বলে। -অজগর, মানে সাপ? -জি আপা। -খুব ভালো নাম। তো ওর যে বিয়ে হয়েছে তুমি জানো কীভাবে?’’ -আপা, এটা তো হিউম্যান সাইকোলজির ব্যাপার। বিবাহিত মেয়েরা বিয়ের প্রথমদিকে একটু চুপচাপ থাকে। এরপর মুখরা হয়, কথা শুরু করলে মাশাল্লাহ আর থামে না। -বা! তুমি তো দেখছি মেয়েদের সাইকোলজিতে একেবারে পিএইচডি করে এসেছ। একটি ছেলে দাঁড়িয়ে বলল: আপা এ কথা তো আমাদের গুরু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছেন। বলব তিনি কী বলেছিলেন? -বলো। -‘‘বিয়ের পর প্রথম ছেলে বলে মেয়ে শুনে, এরপর মেয়ে বলে ছেলে শুনে। এরপর দু’জন বলে পাড়াপ্রতিবেশী শুনে।’’ -ধন্যবাদ তোমাকে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার জন্য। তো মি. অজগর, তোমার রেজাল্ট সম্পর্কে আমাদের একটু বলো। এসএসসিতে... ‘‘গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ।’’ ‘‘এইচএসসিতে?... -গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ। -কী বলছ দুষ্টু ছেলে, এত ভালো রেজাল্ট তোমার? -আপা, আমি মোটেই দুষ্টু ছেলে নই। স্কুল জীবনে স্যারেরা আমাকে ঠাণ্ডা মিয়া বলে ডাকতেন। -কলেজ জীবনে? -ওই যে অজগর। -তাহলে তো এখানেও তোমার একটা নাম দিতে হয়। -জি না আপা, আগেরগুলোতেই চলবে। না হলে আমি নামের ভারে অচল হয়ে যাব। তার কথা শুনে সবার কী হাসি। -এই তোমরা শোনো (সব ছেলেমেয়ের প্রতি), তোমরা সবাই মিলে ওর একটা নাম ঠিক করে নিও। -জি ম্যাডাম। -নো, আই ডোন্ট লাইক ম্যাডাম, আপা। -ওকে আপা। -ঠিক আছে আজকের মতো ক্লাস এখানেই শেষ। আগামী ক্লাসে আমরা পড়ব সুবোধ ঘোষের ‘জতুগৃহ’ গল্পটি। একটু পড়ে এসো। ও হ্যাঁ, গল্পটির নামকরণ সম্পর্কে একটু ধারণা দিয়ে রাখি যাতে তোমাদের বুঝতে সুবিধা না হয়। -আচ্ছা, তোমরা কেউ মহাভারত পড়েছ? -জি না ম্যাডাম। অনেকে একসঙ্গে বলল। -কিন্তু পড়া দরকার। যাহোক, ‘জতুগৃহ’ নামটি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী থেকে নেয়া। মহাভারতে আছে: ‘‘দুর্যোধন পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য, বরণাবতে একটি ঘর নির্মাণ করেছিলেন। সেই ঘরটির নামই ‘জতুগৃহ’। তারা কৌশলে সে ঘরে পাণ্ডবদের (পঞ্চপাণ্ডব) থাকার ব্যবস্থা করেছিল। দুর্যোধনের সঙ্গে এ পরিকল্পায় যুক্ত ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র, দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনি প্রমুখ। দুর্যোধনের মন্ত্রী পুরোচনের ওপর দায়িত্ব ছিল ওই ঘরে আগুন দেওয়ার। কিন্তু বিদুর পূর্বেই যুধিষ্ঠিরকে এ বিষয়টি অবগত করান। এরপর বিদুরের প্রেরিত খননকারীর সহায্যে পাণ্ডবরা ঘরের ভেতর থেকে নিকটবর্তী নদীতীর পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ খনন করান। তারা ঘরটিতে এক বছর ধরে বসবাসের পর, কুন্তী একদিন একটি ভোজসভার আয়োজন করেন। ভোজসভার রাত গভীর হলে পাণ্ডবরা এই ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং বিদুরের পাঠানো নৌকায় করে নদী পার হয়ে পলায়ন করে। সে সময় পুরোচন, তার পাঁচ পুত্র ও এক হাতীর মাহুত ওই ঘরে অবস্থান করছিল। তারা অতিরিক্ত মদপানজনিত কারণে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফলে তারা সকলেই পুড়ে মারা যায়।’’ এখন গল্পটি পড়ার পর তোমরা নামকরণের স্বার্থকতা বিশ্লেষণ করো। আগামী ক্লাসে দেখব কে সবচেয়ে ভালো পারো। ধন্যবাদ সবাইকে। ম্যাডাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে ক্লাসে হাসির জোয়ার বইয়ে গেল। মুক্তিও শেষ পর্যন্ত না হেসে পারল না যখন বান্দর আসগর তার সামনে এসে বলল:‘‘দুঃখিত, তোমাকে বিবাহিত বলার জন্য। আমি শুধু ফান করার জন্য বলেছি। আর তুমি কিনা বললে, তুমি বিবাহিত। সত্যি কি তুমি বিবাহিত?’’ -হ্যাঁ, এটা কি মিথ্যে বলার বিষয়? -ও তাহলে তো, ঢিলটা আমি যথার্থই মেরেছি। -তো আর বলছি কি? আপনাকে অচিরেই বৌভাতে অনুষ্ঠানে দাওয়াত করব। যাবেন কিন্তু! -শুধু আমি কেন? সবাই যাবে। -ঠিক আছে সবাই যাবেন। ॥২॥ দর্শনের ক্লাস। সো স্মার্ট একজন স্যার এসে হাজির। কিছু ছাত্র-ছাত্রী দাঁড়িয়েছে আর কিছু তখনও মোবাইল ফেসবুকে নিবিষ্ট। -বসুন বসুন, কেমন আছেন আপনারা?’’ -ভালো স্যার। আপনি ভালো আছেন তো? সমস্বরে প্রায় সবাই বলে উঠল। -ক্লাসের সময়ও যদি ছাত্র-ছাত্রীরা ফেসবুকে ডুবে থাকে-তাহলে কীভাবে ভালো থাকি বলুন? এই আপনারা আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? মোবাইল অফ। ক্লাসের সময় মোবাইল চালাতে হলে ক্লাসের বাইরে থাকতে হবে। অন্তত আমার ক্লাসে। -জি স্যার। আজগর ওঠে দাঁড়াল। স্যার, একটা কথা বলব? -বলেন। -স্যার, আমাদের ‘আপনি’ না বলে তুমি বলুন। ‘আপনি’ শুনতে ভালো লাগে না। -তোমরা তো এখন আর শিশু নেই-বড় ব্যাটা হয়ে গেছ, ইন্টার পাস দিয়েছ। সবারই মুখে গোঁপ-দাঁড়ি। -তবু স্যার। -ঠিক আছে, আপত্তি না থাকলে। আচ্ছা বসো। এটা বিশ্ববিদ্যালয়। কথায় কথায় দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই। ও হ্যাঁ, আমি তোমাদের দর্শন পড়াব। পড়াব বলতে আমি বোঝাচ্ছি আলোচনা করব। আসলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কাউকে কিছু শেখাতে পারে না, পথ দেখাতে পারে। আর সে পথে সারাজীবন ধরে ছাত্রী-ছাত্রীদের নিজেদের মত করে চলতে হয়, শিখতে ও শেখাতে হয়। আমি আশা রাখি তোমরাও তাই করবে। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের চোরাগলিতে পা দিয়ে পথ হারাবে না। -বিশ্ববিদ্যালয়ের চোরাগলি? আসগর বলল। -আছে, আলোকিত গলিও আছে। সেটাই হোক তোমাদের পথ। -ইয়েস স্যার। একজন ছাত্র, যার নাম ইবনূল বারি, দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘স্যার, আগে আমরা পরস্পর পরিচিত হয়ে নিতে পারতাম।’’ -তোমার নাম? -সৈয়দ ইবনূল বারি। -ওহ সুন্দর নাম। যাহোক ইবনূল, পরিচয় এমনিতেই হয়ে যাবে। আগে আমরা পরস্পরের মুখ চিনব। এরপর বিহেভিয়ার...এরপর নাম, ধাম। এখন বললেও মনে থাকবে না। -ইয়েস স্যার, আপনার কথায় যুক্তি আছে। আজগর বলল। -পরিচয় পরিমিতি, বন্ধুত্ব এগুলো জীবনের জন্য এক ধরনের ফর্মালিটিস। এগুলোর খুব বেশি প্রয়োজন নেই। সত্য বলতে এগুলো দিয়ে কিছু হয়ও না। -কী বলছেন স্যার? পরিচয়, বন্ধুত্ব এগুলো দিয়ে কিচ্ছু হয় না? -ইউরোপ-আমেরিকার কথা বাদ দিলে ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষ যেখানে উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু করে না সেখানে সব ফর্মালিটিসের পেছনেই আমি উদ্দেশ্য দেখতে পাই। তুমি সরকারের যে কোনো সেবাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখবে তোমাকে সাহায্য করার জন্য অতি উৎসাহী লোকের অভাব নেই। প্রথমেই তারা তোমাকে ছালাম দেবে। কিন্তু... -স্যার, সালাম তো আমরাও আপনাদের দিই। -এটাও এ ধরনের ফর্মালিটিস। কিন্তু ওদেরটা আরেক ধরনের ফর্মালিটিস। আমি বলি: দালাল ফর্মালিটিস। একসঙ্গে অনেকে এগিয়ে আসবে। ‘‘কোথা থেকে এসছেন, কী কাজ আপনার?’’সবই আসলে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কেউ চা অফার করবে। চায়ের দামটা কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে। ও হ্যাঁ, তোমার পাঁচশ টাকার কাজ সে করে দেবে একহাজার থেকে পাঁচহাজার টাকা নিয়ে। নির্বাচনের সময়ের ফর্মালিটিসগুলোর কথা মনে করতে চেষ্টা কর? কী মূল্য আছে সে সবের? এমন হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যাবে। এভাবে বিচার করলে দেখবে আমাদের দেশে ফর্মালিটিসের মৃত্যু হয়েছে। ফর্মালিটিস এখন অতি তোষণের নাম... -জি স্যার, অতি তোষণ, দারুণ বলেছেন স্যার। পেছন থেকে আরেকটি ছেলে বলল। -যা হোক, আমরা যুক্তি, তর্ক থেকে দর্শনের দিকে যাব। অপ্রিয় বিষয়ও হয়তো চলে আসবে। তোমরা সেসব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। হাউজের মানে ক্লাসের বাইরে না। আমার মনে হয়, দর্শনের সংজ্ঞা সম্পর্কে তোমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। দর্শন হলো জ্ঞানবিদ্যা। কেউ কেউ বলেছেন: জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা। তোমরা কেউ কিছু বলতে পারো? মানে দর্শন কী? -কেউ কোনো কথা বলছে না। স্যার একটি মেয়ের দিকে ইঙ্গিত করলেন: এই তোমার নাম কী? -স্যার, সাগুপ্তা ইয়াসমিন ইভা। -বলতে পারো কোনো দার্শনিকের নাম? -পারি স্যার। এই মুহূর্তে একজন অস্ট্রিয়ো দার্শনিকের নাম আমার মনে পড়ছে। তার নাম লুডবিগ উইটজেনস্টাইন। তার বিখ্যাত উক্তি: ‘‘আমার ভাষার সীমাবদ্ধতার অর্থ হলো আমার পৃথিবী সীমাবদ্ধ।’’ কিংবা ‘‘আমি জানি না কেন আমরা এখানে আছি, তবে আমি বেশ নিশ্চিন্ত যে, এটা আমাদের নিজেদের উপভোগের জন্যও নয়।’’ -খুব ভালো বলেছ। একেবারে কন্টেম্পরারি। -মি. লুডবিগ ‘এখানে’ দ্বারা তিনি কী বুঝিয়েছেন স্যার...? পেছন থেকে বোধিচন্দ্র প্রশ্ন করল। -এ পৃখিবীকে। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, তোমার নাম কী? -বোধিচন্দ্র দত্ত। -বসো বোধি। দর্শনের আলোচ্য বিষয় জীবন ও জগৎ , উৎপত্তি, বিলয়, কিংবা মৃত্যুর পরে কী হয় সেসব বিষয়ে আলোচনা। -জি স্যার। -এগুলো বইয়ে আছে তোমরা পড়ে নেবে। লুডবিগ উইটজেনস্টাইন সম্পর্কে ইভার কাছ থেকে পরে আরও জানব। আর কেউ অন্য কোনো দার্শনিকের নাম বল, কে বলবে? -জাঁ জ্যাক রুশো। হেদায়েতুল ইসলাম বলল। -থ্যাঙ্কিয়ু। তার কোনো বইয়ের নাম? -সোসাল কন্ট্রাক্ট। -তাঁর কোনো দর্শন বাক্য কেউ বলতে পার? -Yes Sir, Man is born free but everywhere he is in chain. হেদায়েতুল ইসলাম বলল। -হ্যাঁ, মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত। -স্যার, সবসময় শিশু স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। এটা দার্শনিকের উত্তম চিন্তা কিন্তু কোনো কোনো দেশে শিশু মাতৃগর্ভেই ঋণগ্রস্থ, শিকলাবদ্ধ। জাতিসংঘ শিশু সনদের বেশিরভাগ তার ভাগ্যে জুটে না। -তোমার কথাও ঠিক। কিন্তু তিনি বিষয়টাকে প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। যাহোক, তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার নাম কী? -হেদায়েতুল ইসলাম, স্যার। -শোনো, আমি খুব খুশি। মনে হচ্ছে, তোমাদের দিয়ে হবে। ওকে হেদায়েত তুমি বসো। আর কেউ বলবে কোনো দার্শনিকের নাম? -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজগর দাঁড়িয়ে বলল। -রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে অনেকেই হেসে ফেলল। -এই তোমরা হাসলে কেন? আচ্ছা, তোমার নাম কী? যে ছেলেটা রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে হেসেছিল স্যার তার দিকে আঙুল তুললেন? -তুফান শেখ, স্যার? তুফানের নাম শুনে সবাই হেসে ফেলল। -তুফান শেখ? ক্লাস রোলেও তোমার এই নাম? -জি স্যার, কোনো সমস্যা? -ওহ নো, সরি। তাহলে আমার ক্লাসে সৈয়দ আছে, শেখও আছে -স্যার, ঠাকুর, ব্রাহ্মণ আছে, ক্ষত্রিয়ও আছে। -ওহ তাই নাকি? ওয়াও। আচ্ছা, বোধিচন্দ্র দত্ত তুমি কোনো দার্শনিকের নাম কিংবা তার কাজের অংশ উল্লেখ করতে পার? -জি স্যার, শঙ্করাচার্য। কা তব কান্তা কন্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীব বিচিত্রঃ কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভ্রাতঃ।। -আমি বিস্মিত। তোমরা আমাকে চমকে দিচ্ছ। তো বোধি অর্থ বলতে পারবে শ্লোকটির? -জি স্যার। ‘‘কে তোমার স্ত্রী? কে বা তোমার পুত্র? এই সংসার হলো অতীব বিচিত্র। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? তত্ত্ব সহকারে এ বিষয়ে চিন্তা করে দেখ। -আরে কী বলছ বোধি! তোমরা তো দেখছি সবাই জন্ম দার্শনিক। -ও হ্যাঁ, এবার তুফানকে শুধাই, পরে হয়ত ভুলে যাব: তোমার নাম শুনে, এক বিদেশি শিল্পী তুফান রাফাইয়ের কথা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। -স্যার, আমার বাবা সেই তুফান রাফাইয়ের গল্প পড়েই আমার নাম তুফান রেখেছিলেন। -তাই নাকি? আচ্ছা, তার কথা একদিন আমরা তোমার কাছ থেকে শুনব। আচ্ছা, তুফান, এখন তুমি বল, রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে খুব হেসেছিলে, কেন? উনি কি দার্শনিক নন? -স্যার, উনিতো কবি, কথা সাহিত্যিক। তুফান শেখ রিপিট করল। -আচ্ছা, আজগর এবার তুমি বল, তুমি কেন রবীন্দ্রনাথকে দার্শনিক বলেছিলে? -আজগর মাথা চুলকাচ্ছে। কী বলবে গুছাতে পারছে না। -স্যার, দর্শনে রবীন্দ্রনাথের স্পেসিফিক কোনো কাজ নেই ঠিক, তবে বিচ্ছিন্নভাবে বহু লেখায় তাঁর দর্শন আমরা পাই। কুটিল সাংমা বলল। -যেমন? -‘‘প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নতুন আবির্ভাবে কে তুমি? মেলেনি উত্তর। বৎসর বৎসর চল গেল। দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগর তীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়- কে তুমি? পেল না উত্তর।’’ আকাশ স্যার: ওহ কুটিল, এতক্ষণ করেছিলে চুপ, শেষটায় জানিয়ে দিলে তুমি যে পোড়া ধূঁপ। কুটিল: জি না স্যার। আমি বড় নাদান। সারাজীবন ব্যাক বেঞ্চার। মুক্তি: ব্যাক বেঞ্চাররাই অনেক সময় সবচেয়ে বড় অ্যাডভেনচারের কাজটা করে ফেলে, স্যার। আকাশ স্যার: হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আইনস্টাইন, বিল গেট, জ্যাক মা। মুক্তি: রবীন্দ্রনাথের এ ক’টি বাক্যের মধ্যেই ভারতীয় দর্শনের বেশিরভাগ অনুসন্ধান রয়েছে। আর এর উত্তরহীনতার মধ্যে। উপমহাদেশীয় সকল ভাবালুতার মুখবন্ধ রবীন্দ্রনাথের এ ক’টি বাক্যে বিকাশুন্মুখ। এখানে সব আছে, ভাববাদ, আধ্যাত্মবাদ, অজ্ঞেয়বাদ... আকাশ স্যার: মুক্তি, ওহ্ মুক্তি, তোমার কথায় রয়েছে অনেক যুক্তি। মুক্তি: প্লিজ স্যার, বাড়িয়ে বলবেন না। এমনিতেই আমরা অলস, কর্মবিমুখ, পড়াচোর। প্রশংসা পেয়ে হয়তো মাথায় উঠব, সব ছেড়ে ছুঁড়ে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বশেষ সার্কাস দেখতে বসে যাব। কুটিল সাংমা: মানে? মুক্তি: কিছু না। আকাশ স্যার: অলস মানুষ কিন্তু জ্ঞানী হয়। ইভা: স্যার, ঘরে আগুন লাগলে অলস তো উঠে দেখবে না কী হচ্ছে, ফলে সকল জ্ঞানসহ পুড়ে মরবে। আকাশ স্যার: আরে অত অলস না যে ঘরে আগুন লাগলেও উঠে দেখবে না। কুটিল সাংমা: স্যার, মুক্তি যে বলল: সর্বশেষ সার্কাস, এর মানে বুঝলাম না? মুক্তি: এটা বুঝলে না? ভোট বিহীন নির্বাচন, এক দলীয় শাসন, করাপশন। আকাশ স্যার: ওহ, রাজনীতি বাদ। মুক্তি: এই তো আপনাদের বড় সমস্যা, স্যার। আকাশ স্যার: কী সমস্যা? মুক্তি: দর্শনের উৎপত্তি মূলত ধর্মচিন্তা থেকে আর এর বিকাশ প্রধানত রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ণের মাধ্যমে ক্ষমতার টিকে থাকার উদ্দেশ্য থেকে। যেমন দাস প্রথা ও কলোনিজম টিকিয়ে রাখার জন্যও দার্শনিক পরামর্শ ছিল। আমি একটু পড়ে শোনচ্ছি: John Locke took part in administering the slave-owing colonies… a philosopher who put forth radical ideas while working on behalf of slavery and colonism.. আর আপনারা এখনও রাজনীতি থেকে দর্শন ও ধর্মকে বাদ দিতে চাচ্ছেন। আকাশ স্যার: কারণ এর পেছনে ঐতিহাসিক সত্য রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক, দর্শনের সূতিকাগার। ওখানে কখনও কি রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব ছিল? মুক্তি: কেনো যে আপনারা প্রাচীন গ্রীককেই দর্শনের সূতিকাগার বলেন? যেখানে স্পষ্ট প্রাচীন মশিরীয়রা, পিথাগোরাস, প্লেটো, পারমেনিডস আর অ্যারিস্টটলের ২৫০০ বছর আগে জ্ঞানবিদ্যার চর্চা করেছিলেন। খ্রিস্টের জন্মের ২৩৫০ বছর আগের মিসরীয় পাতাহহোতেপ সম্পর্কে জানুন। দেখুন তিনিই প্রথম বলেছিলেন: ‘‘সত্য ও ন্যায় বিচারের শক্তি এটাই যে, শেষাবধি তারা বিজয়ী হয়।’’ আর ধর্ম থেকে দশর্নকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা একেবারে দর্শন চিন্তার শুরু থেকেই হয়ে আসছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সফল হয় নি, হবেও না কোনোদিন। তবে হ্যাঁ, হতো, যদি চিন্তাজগতে মুসলমানদের আগমন না ঘটত। -ধর্ম থেকে দর্শনকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা প্রথম কখন হয়েছে? -থেলিসের সময় থেকে। -মানে প্রথম দার্শনিক? -জি স্যার। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফিতে(১৯৪৫) যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন: এটাই ঠিক চিন্তা যে, খ্রিস্ট্রের জন্মের পূর্বের ছয় শতাব্দিতে প্রথম দার্শনিক থেলিসের আবির্ভাব ঘটেছিল গ্রিক কলোনি মাইলিটাস বা মিলিটাসে, যেটির বর্তমান নাম তুরস্ক। আর তখনকার চিন্তাবিদরাই প্রথম ধর্ম থেকে দর্শনকে আলাদা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। রাসেলই লিখেছেন: After all, the thinker who is called the first philosopher, Thales, is remembered for remarking, “All things are full of Gods.” আকাশ স্যার: আমি চাই রাজনীতি থেকে ধর্ম আলাদা হোক। কুটিল সাংমা: কোন যুক্তিতে স্যার। আকাশ স্যার: ঝগড়া এড়ানোর জন্য। মোমিনূল হক: কিন্তু আমার ধর্ম? পারফেক্ট কোড অব মাই লাইফ। এরপরও আমি চাই সকলমতের সহবস্থান কিন্তু সমন্বয় নয়। যেমনটি চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আকবর যে সমন্বয় করেছিলেন সেটিও অচল মুদ্রা। জগাখিুচরি বেশিদিন টিকে না। ধর্মানুভূতি মানুষের চিরন্তন। এটা কিছুতেই দাবিয়ে রাখা যায় না। যদি যেত তাহলে ধর্মকে আফিম আখ্যায়িত করা কমিউনিস্ট রাশিয়ার পতন ঘটত না। এই চাওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর-গান্ধী-বিবেকান্দ কিংবা আরও অনেকের থেকে এগিয়ে। -হ্যাঁ, ঠিক। চমৎকার যুক্তি উপস্থাপনের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। হেদায়েত: রবীন্দ্রনাথের এই কবিতায় আমরা লালনের প্রভাব দেখতে পাই। এক ধরনের অনিশ্চিত স্পিরিচোয়ালিটি। আকাশ স্যার: শুধু লালন নয়, হাফিজ, রুমি, জামি, ইকবাল, কবীর, সারমাদ সবাইকে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথে। তাঁর কাপে ধোঁমায়িত আধ্যাত্মিকতা আধুনিক রূপ লাভ করেছে। এ জন্যই মাঝে-মধ্যে আমি বলি: ‘‘সব কবিই দার্শনিক। কিন্তু সব দার্শনিক কবি নন।’’ -স্যার হেদায়েতের এ কথাটা বুঝলাম না, ‘অনিশ্চিত স্পিরিচোয়ালিটি’। স্পিরিচোয়ালিটির আবার অনিশ্চিন্ততা কী? -জবাব তো হেদায়েতর দেবার কথা, তাই না? হেদায়েত: লালনে যে স্পিরিচোয়ালিটি আমরা পাই: সেটা অনিশ্চিন্ত। কারণ তাঁর স্পেসিফিক কোনো ধর্ম ছিল না। তিনি খোদাকেও ডেকেছেন, ভগবানকেও পুঁজেছেন। হিন্দু ঘরে জন্মগ্রহণ করে মুসলমান ঘরে লালিত-পালিত। আবার তাঁর গুরু হলেন: সিরাজ শাঁই। এসব কারণেই তাঁর আধ্যাত্মিকতাকে আমি অনিশ্চিন্ত বলেছি। সত্য বলতে তিনি নিজেই জানতেন না: কোন গন্তব্যে যেতে চান তিনি। আকাশ স্যার: তোমার বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আরও আলোচনার দাবী রাখে। এরপর একটি সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া যেতে পারে। যাহোক, পরে না হয় কোনোদিন লালন দর্শনের ওপর একটি আউডডোর আলোচনায় আমরা অংশগ্রহণ করব। আচ্ছা, একটি প্রশ্ন আমার মাথায় উঁচি-চুকি দিচ্ছে: রবীন্দ্রনাথের দর্শনের কোনো দার্শনিক নাম বা সংজ্ঞা কি কেউ দিতে পারি আমরা? অর্থাৎ তার দার্শনিক কাজকে আমরা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করব? আসগর: ইতোমধ্যেই তা করা হয়ে গেছে। কেউ বলেছেন রবীন্দ্রনাথের দর্শনের নাম ‘আনন্দবাদ’, কেউ বলছেন: আধ্যাত্মবাদ । -তাহলে নিশ্চয়ই তুমি দুঃবাদী এক দু’জন কবির নামও বলতে পারবে? -নিশ্চয়ই স্যার। কায়কোবাদ, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। -ও দারুণ বলেছ। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত শুধু দুঃখবাদীই নন। তিনি নিরেশ্বরবাদীও। অর্থাৎ ঈশ্বরে যার বিশ্বাস নেই। -স্যার ‘‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই।’’ এ হলো নিরেশ্বরবাদীদের বক্তব্য। পেছন থেকে বোধিচন্দ্র সরকার দাঁড়িয়ে বলল। -ওর কথা ঠিক আছে স্যার, কিন্তু এ কালীদাসের কথা। আর সত্যেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত বলেছেন: শুনহ মানুষ ভাই! সবার উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ, স্রষ্টা আছে কি নাই।।’’ -ওহ খুব ভালো লাগছে। ক্লাসটি আমি দারুণ উপভোগ করছি। -স্যার, একজন সমালোচক বলেছেন: যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘দুঃখবাদ’ আসলে রবীন্দ্রনাথের ‘আনন্দবাদ’এর প্রতিবাদ। এখানে ব্যক্তিগত কোনো ক্ষয়-ক্ষতি বা দুঃখ জড়িত নয়। অর্থাৎ তাঁর দীর্ঘশ্বাস মানে নৈরাশ্যবাদী দীর্ঘশ্বাস, যে সুখ তিনি পেতে চেয়েছিলেন তার নাগাল পাননি বলে। ঠিক কায়কোবাদেও একই কথার প্রতিধ্বনি। তাঁর বাক্যে বাক্যে দুঃখ ও নৈরাশ্যবাদ ঝরে পড়ে। হেদায়েতুল ইসলাম বলল। -কিন্তু কায়কোবাদ কিছুতেই নিরেশ্বরবাদী ছিলেন না। সাগুপ্তা শারমিন ইভা বলল। -স্যার, কায়কোবাদের দুঃখ আসলে মানবীয় প্রেম-বিরহ কিংবা আর্থিক দৈন্য জনিত নয়, ভাববাদী চিন্তা প্রসূত। ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনাঙক্ষা থেকে এ রকমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। যেমন: ‘‘দূরে থেকে দূরে রেখে কি সুখ প্রিয়?’’ -রবীন্দ্রনাথে ঈশ্বরভাবনা বা আধ্যাত্মিকতা বেশি। বহু লেখায় তিনি নিজেকে ঈশ্বরে কিংবা ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে বিলিন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, যেমনটি কায়কোবাদের ধরন। -কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ আরও উন্নত, আধুনিক। কুটিল সাংমা বললো -হ্যাঁ, ঠিক বলেছ: তাঁর স্বর্গ ভাবনা অনেক বেশি আধুনিক? বোধি: জি স্যার। এটা তার আধ্যাত্মিকতারই অংশ। -উদারহরণ দাও। -রবীন্দ্রনাথের ছোট্ট একটি কবিতা ’প্রার্থনা’। ওতে পাওয়া যায়:‘‘আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক।’’ আজগর: উপনিষদেও ঠিক এ রকমই আছে: ‘‘অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জোতির্গময়... রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম।’’ অর্থাৎ হে সত্য, সমস্ত অসত্য হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও; হে প্রকাশ, তুমি একবার আমার হও, আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক। -এ আলোচনা আরও দীর্ঘ হলে ভালো লাগত। -মুক্তি দাঁড়াল। স্যার, আমি কিছু বলতে চাই। -কিন্তু ঘণ্টা পড়ে গেছে। তবু বল, শুনি। মুক্তি: রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি কবি হিসেবে, দার্শনিক হিসেবে না। আমাদের দেশের অমির, সমির, জমির যেমন কবি, কাক-কোকিলও তেমনই কবি। আদি কবি দৌলিত কাজী, শাহ সগীর থেকে শুরু করে আমরা খাইও কবিতা, পোশাকও পরি কবিতার। তাই আমাদের কাছে দর্শন দুর্বোধ্য। গ্রিক-জার্মানরা আমাদের বিপরীত। তারা কবি হওয়ার চেয়ে জোর দেয় দার্শনিক হওয়ার ওপর। এ সমস্ত কারণে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে আমরা যতটা কাড়াকাড়ি করেছি তাঁর শিক্ষা ও বিশ্ব বিষয়ক অনেক লেখা যেগুলোতে দর্শন আছে, সে সব আমরা ওই অর্থে ছুঁয়েও দেখি নি। বহির্বিশ্বের লেখক পণ্ডিতগণ সে সম্পর্কে প্রচুর লিখেছেন। কোথায় পড়েছি মনে পড়ছে না-তাঁর দর্শন প্রসঙ্গে কেউ একজন লিখেছেন: ‘‘Very few studies are available to understand the philosophical views of Rabindranath Tagore in the light of his attitude and realization of universalism. '' আসগর: স্যার, মুক্তি সঠিক কথাই বলেছে:‘‘ দর্শন আমাদের কাছে দুর্বোধ্য।’’ প্রসঙ্গত একটা বাক্য আমি শুনাচ্ছি: There’s an unfortunate perception that philosophy is, by nature, obscure, difficult and inaccessible . ইভা: কিন্তু স্যার দর্শন আমাদের পড়তেই হবে কেনো? হেদায়েত: স্যার, এর উত্তরটা Cicero দিয়েছেন: Philosophy can enrich the lives of anyone with a thirst for knowledge or self-improvement. -ওয়াও! খুব সুন্দর। শোনো, আউটডোর ক্লাসে এসব বিষয় নিয়ে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করব। তোমরা জানোতো, আউটডোরেও যে আমরা ক্লাস নিই? আর প্রথম আলোচনা করতে চাই রবীন্দ্র দর্শনের ওপর। -জি স্যার। আপনি চাইলেই আমরা হাজির হবো। -আচ্ছা শোনো, যদিও আজকের আলোচনা যতটা না দর্শন বিষয়ক তার চেয়ে অনেক বেশি সাহিত্য নির্ভর হয়ে গেছে। তবু, আমি খুশি। আমার সময়টা খুব নিরামিশ যাচ্ছিল। আমরা জানলাম দর্শনে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কোনো কাজ নেই? কিন্তু ভালো সাহিত্যিক না হলে ভালো দার্শনিক হওয়া যায় না এমন একটি সিদ্ধান্তেও আমরা পৌঁছলাম। যাহোক প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, কথা বলে ভালো লাগল। আগামি ক্লাসে আমরা পড়ব, গ্রিক ফিলোসফি। তোমরা পড়ে এসো। -জি স্যার। -যাবার বেলায় বলব: ‘‘আর শুধু এইটুকু রেখ মনে আকাশ আহমেদ আমার নাম এখানেই প্রথম পরিচয় তোমাদে সঙ্গে বাংলারই এক অজ পাড়াগাঁয়ে ধাম।’’ -থ্যাঙ্কিয়ু। ॥৩॥ ‘‘বন্ধুত্ব করা, মাটির ওপর মাটি দিয়ে ‘মাটি’ লেখার মত সহজ বন্ধুত্ব রক্ষা করা, পানি দিয়ে পানির ওপর ‘পানি’ লেখার মত কঠিন। -হযরত আলী (রা.) ক্যাম্পাসের মাঠের পাশে একটি পাকা প্ল্যাটফরমের ওপর বসে আছে সাগুপ্তা শারমিন ইভা। ওপরের বাক্যগুলো তার সামনের দিকের একটি ওয়ালে বড় বড় অক্ষরে লেখা। সে বাক্যগুলো আওড়াচ্ছে আর ভাবছে: ‘‘কত সুন্দর এই কথাগুলো। হয়রত আলী (রা.) ইসলামের চতুর্থ ও সর্বশেষ খলিফা। তিনি অনেক জ্ঞানী ছিলেন। তাঁর বহু কথা বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। এবার সে ব্যাগ খুলে ‘লাভ পোয়েমস অব হেরমান হেস’ বইটি বের করে পড়তে শুরু করে। প্রথমেই কবি পরিচিতি অধ্যায়টিতে চোখ বুলায়: In 1931, Hermann Hesse married Ninon Dolbin. She had sent Hesse a letter in 1909 when she was 14, and the correspondence had continued. First meeting with Hesse occurred in 1922 in Montagnola. Their relationship began when they met again accientally in Zurich in 1926,... বইটি আধা বন্ধ করে সে ভাবতে থাকে: ১৯০৯ সালে ১৪ বছর বয়সে কিশোরী ডলবিন হেসকে চিঠি লিখেন। ১৯০৯ থেকে ১৯২৬, ১৭ বছর তাদের যোগাযোগ ছিল। ১৯২৬ সালে দুর্ঘটনাক্রমে যখন তাদের চার চোখের মিলন ঘটে হেসের বয়স তখন ৩৯ আর ডলবিনের বয়স ৩১বছর। হেস তার সঙ্গে গেলেন? এরপর কি তাদের বিয়ে হয়েছিল১৯৩১ সালে। নাকি এমনিতেই একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলেন? কারণ, এরপর হেসের অসি'র জীবনে সি'রতা আসে। এটাকে কি দীর্ঘ প্রেমের পরিণতি বলা যায়? মাঝখানে আবার দু’জনেরই পূর্বের স্ত্রীদের সঙ্গে সংসারের ইতি টানতে হয়েছে। অদ্ভুত ওদের সভ্যতা। ইচ্ছে করলেই বহু বছর পরেও সেপারেট হওয়া যায়, সন্তান-সন্তুতির কথা কেউ ভাবে না? আর আমাদের সমাজে? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক সংসার টিকে থাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।…’’ ইভার ভাবনায় ছেদ পড়ে সামনে দাঁড়িয়ে হেদায়েতুল ইসলাম যখন বলল: হাই, মনে হয় খুব মজে গেছ? -মানে? মজে যাওয়া কেমন ভাষা? -এই ডুবে যাওয়া আর কি? -কোথায়? -কোথায় আর বইয়ে। -ও তাই বলো। যেভাবে বলছিলে... -এই হলো মেয়েদের বড় সমস্যা। সহজ কথা তারা নেয় না সহজে। -ছেলেরা কি সব কথা সহজে নেয়? তাদের কি কোনো সমস্যা নেই? -সমস্যা থাকবে না কেন? তবে, তবে... -শোনো, মেয়েদের অতীন্দ্রিয় শক্তি অনেক বেশি? তারা সহজেই অনেক কিছু আঁচ করতে পারে। এই যেমন তোমার কথাটি সহজ ছিল না, ছিল কি? -কী জানি? -হেঁয়ালি করছ কেন, স্বীকার করার সাহস নেই? -দুঃখিত। যদি তোমার এমনটি মনে হয়ে থাকে। -বাহ্‌! ভালোই ফর্মালিটিস শিখেছ: দুঃখিত বললেই সব অপরাধের ক্ষমা হয়ে যায়? ইট’স জাস্ট অ্যা সেয়িং টু হাইড স্টুপিডিটি। -স্টুপিডিটি? বলতে পারলে? -কিন্তু ইতোমধ্যে আমি জেনে গেছি ফর্মালিটিসের তেমন কোনো মূল্য নেই। -আরে তুমি তো দেখিছি আকাশ আহমেদ স্যারের এক ক্লাস করেই পুরোপুরি তার ভাবশিষ্য হয়ে গেছ। -হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? যে দিকে যাচ্ছিল দয়া করে যাও। -ক্লাস তো নেই, তুমিও চল আমার সঙ্গে। -না, বইটা পড়ব। প্রিয় কবির কবিতা। মনে গেঁথে নিতে চেষ্টা করছি। ‘‘মনে? কোথায় তোমার মন। বন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিতে পারো না।’’ -কে বন্ধু? তুমি তো ক্লাস মেট। -তুমি আমাকে হার্ট করছ। মনে রেখ: ক্লাসমেট শুধু ক্লাসমেট না, বন্ধু ও ভাই। তোমার বিপদে তোমার ভাইও এত তাড়াতাড়ি ছুটে আসবে না-যত তাড়াতাড়ি ছুটে আসবে একজন ক্লাসমেট। -তাই নাকি? এবার সে তাকায় হেদায়েতুল ইসলামের মুখের দিকে। -আরেকটা কথা মনে রেখ, আমি শেক্সপিয়ার থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি: যদি ‘‘কাউকে সারা জীবন ধরে রাখতে চাও? তাহলে প্রেম নয় বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখ। কারণ প্রেম একদিন হারিয়ে যায় কিন্তু বন্ধুত্ব কোনোদিন হারিয়ে যায় না।’’ -ভালোই ত বাইল শিখেছ। -বাইল? মানে? -মানে পটানোনোর কৌশল আর কি। ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের ভাষায়। -ভুল, বন্ধু হলো ঈগলের মত। এরপর পিঠে চড়িয়ে সাগর পাড়ি দেয়, কিংবা আরও দূরে নিয়ে আড়াল করে। -এতে বন্ধুর কোনো স্বার্থ থাকে। যা শেষ পর্যন্ত... যাহোক, আমি বলব, এভাবে বলেন একজন মা-তার সন্তানকে। মা কখনও বদলান না, সন্তানের বিপদে তো না-ই। সো, “I don’t need a friend who changes when I change and who nods when I nod…” -মায়ের কথা এখানে আসছে কেন? কথা হচ্ছে বন্ধুত্ব নিয়ে। প্রেম যদিও আসে বন্ধুত্বের অনেক পরে কিন্তু প্রেমের মৃত্যু হয় বন্ধুত্বের মৃত্যুর আগে। বন্ধুত্বের মৃত্যু হয় না। -ভুল, তোমার চিন্তা আগাগোড়াই ভুল। জতুগৃহের কথা ভাবো: স্বামী-স্ত্রীর তালাক হয়ে যাওয়ার সাত বছর পর একদিন স্টেশনে দু’জনের দেখা হয়। দু’জনেই তখন বুঝতে পারে, তাদের পরস্পরের জন্য তাদের ভেতরে অনেকখানি জায়গা রয়ে গেছে। আর ওই জায়গাটা কিন্তু বন্ধুত্বের নয়, ভালোবাসার, মমতার। প্রেম এসবের চূড়ান্ত ডেস্টিনেশন। ইভা বলল। হেদায়েত দূরের দিকে তাকিয়ে হেঁয়ালি করার মত বলল: মনে হয়, তোমরা সবাই অনেক অভিজ্ঞ, বিশেষ করে প্রেমের বিষয়ে। আমি একেবারে আনাড়ি। -এর জন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। এর প্রথমটুকু মানুষের সহজাত, কিছু শেখে দেখে, কিছু শুনে। আর কিছুটা শেখে বই পড়ে, সিনেমা দেখে। আরও কিছু শেখে বন্ধু, বান্ধবী বা ক্লাসমেটের সঙ্গে দুষ্টুমি ফাজলামো করতে করতে। আর ৮০% শেখা হয় বিয়ের পর। -৮০% ? ১০০% নয় কেনো? -২০% থাকে স্রষ্টার হাতে। আমি ওটাকে নাটাই নিয়ন্ত্রণ। ১০০% হয়ে গেলে তারা আল্লাহকে ভুলে যাবে। মাটির পৃথিবীতেই স্বর্গ রচনা করে ফেলবে। -ধন্যবাদ, ভালো বলেছ। প্রেম সম্পর্কে অনেক লেকচার শুনেছি, এটা নতুন শুনলাম। -তোমার খারাপ লাগছে? -ভালোও লাগছে না, দয়া করে এবার বুদ্ধিবৃত্তিক কচ্‌কচানি থামাও। একটু আগে যে বলছিলে কবিতাগুলো, মনে গেঁথে নেবে? মনে কিছু গেঁথে নেয়া যায় না, গেঁথে নিতে হয় স্মৃতিতে। আই মিন মেমোরিতে। -কোথায় থাকে মেমোরি? -এটা আসলে মাথার কোথাও। সমগ্র দেহসত্তায় নয়। -মাথার কোথাও? বুকের ভেতরের বস'গুলো ছাড়া-মাথা তো জাস্ট একটা ফুটবল। ভেতরে কতটা হিজিবিজ আঁঠাল আধাতরল পদার্থ। -কিন্তু ম্যাম, ওই আধাতরল পদার্থ ছাড়া বাকি সব বৃথা। যাহোক, তাহলে তুমি খুব পড়? -হ্যাঁ, যে বই ভালো লাগে শেষ করে তবে ছাড়ি। -‘‘তাহলে তো বিপদ...’’ (স্বগতোক্তি: সংসারের কাজ ফেলে খালি বই-ই পড়বে)। -অ্যাই বিড় বিড় করে কী বললে? -কিছু না। কথা বলতে বলতে বিড় বিড় করা আমার স্বভাব। হেদায়েত বলল। -তাই নাকি? ‘‘বাজে আর অদ্ভূদ স্বভাব।’’ ইভা বিড় বিড় করল। - অ্যাই কী বললে? -কিছু না। কথা বলতে বলতে বিড় বিড় করা আমারও স্বভাব। -(স্বগতোক্তি: এ জন্যই) -কী? -কথা বলতে বলতে আমি অনেক সময় কিছু একটা ব্যাপারে কোনো একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছি। এখন আমি তাই করেছি। কিছু মনে করো না। -তাহলে তো আমাদের মধ্যে অনেক মিল। -মোটেই না। ক্লাসে চলো, ঘণ্টা পড়েছে। -হা হা হা। ক্লাশ হবে না, কেশব স্যার নেই। -হাসলে যে? -এই ভেবে হাসছি যে, এত খবর রাখো নিজের ঘণ্টার খবরটা রাখো না। -অবশ্যই এ জন্য হাসনি। সত্যিটা বলো। -জীবনে অনেক কঠিন বই পড়েছি। এখন মনে হচ্ছে, তুমিই হচ্ছ সবচেয়ে কঠিন বই। -ঠিক ধরেছ। কারণ আমি আমি.. না না। -বলো, শেষ করো। -কারণ আমার হিয়ার মাঝে লুকোনো আছে আরও অসংখ্য কঠিন বই। আমি যে অসংখ্য বইয়ের সমাহার। -ওহ সো সুইট। এমন কঠিন বই-ই আমার পছন্দ। আচ্ছা বলত: বই সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? -বই আমার সেরা বন্ধু। আমি ভাবি: “A real friend is one who walks in when the rest of the world walks out.” -তাহলে ওইখানে চলো, ওখানে বসে তুমি পড়বে আমি শুনব। ঠিক আছে? হেমিংওয়ে যেমন বলেছেন: I like to listen. I have learned a great deal from listening carefully. Most people never listen.” -ওইখানে কোথায়? -একটু দূরে, এমন কোথাও নিবিড় ছায়াচ্ছন্নতা যে জায়গাকে ঘিরে থাকে। কিংবা আরও দূরে কোথাও... -একেবারেই অলস মস্তিষ্কের বিভ্রান্তিকর কল্পনা। -কেনো, কেনো? বিভ্রান্তিকর কল্পনা কেনো? -একদিন নিশ্চয়ই জানতে পারবে। -ঠিক আছে সেদিনের আশায় থাকলাম। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, হেমিংওয়ে সব পড়েছ? -আবার জিগায়। -কী কী? -ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী, এ ফেয়ারওয়েলস টু আরমস, দ্য সান অলসো রাইজেস ইত্যাদি। -‘ওল্ড ম্যান দ্য সী’ আমার প্রিয় উপন্যাস। -বলো, কেন? -কারণ এক বৃদ্ধ জেলে ৮৭ দিন বড়শি ফেলে রাখছে একটা বড় মাছের আশায়। আমাদের চ-ীদাসের মত। অবশেষে সেই মাছ ধরল। কী খুশি শিকারি। কিন্তু মাছটা যখন ডাঙায় ওঠালো তাতে কিছু কাঁটা ছাড়া কিছু নেই। হাঙর খেয়ে ফেলেছে। ওই হাঙর হলো পূঁজিপতি বা শোষকশ্রেণি, যারা গরীবের শ্রম শোষণ করে। জাস্ট প্রতীকি লেখা। উপন্যাসের এ বক্তব্য তখন স্তভিত করে দিয়েছিল সাহিত্য চিন্তার জগৎকে। -কিন্তু ওই সময়টাতে হেমিংওয়ে কিউবাতে থাকলেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্তি হয়েছিলেন-এমন কোনো নজির নেই। আসলে ওই সময়টাতে সাম্যবাদ বিশ্বজুড়ে বহু শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আবেশের মত আবেশ তৈরি করেছিলে, তখন এর বাইরে ছিল কেবল মনেপ্রাণে যারা কঠোর ইসলামিস্ট আর আমেরিকা-ইউরোপের পূঁজিপতিরা। -আসলে সময়, ওই সময়টাই তাঁকে উৎসাহিত করেছিল। পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তার মহার্ঘ্য হলো ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’। -হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। কিউবান উপসাগরে স্রোতে ভেসে আসা বিশাল এক মারলিন মাছ ধরেছিল তাঁর বড়শিতে। -তাঁর বড়শিতে না, তাঁর উপন্যাসের নায়ক সান্তিয়াগোর বড়শিতে। -হ্যাঁ, সান্তিয়াগোর। উপন্যাসটার আলোচনা হয়েছে বহুভাবে। কেউ সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ পুঁজিবাদী দৃষ্টিাকোণ থেকে। -অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন:‘‘এ উপন্যাসের নায়ক কে? বুড়ো সান্তিয়াগো নাকি সমূদ্র?’’ -অবশ্যই বুড়ো সান্তিয়াগো। -না, সমূদ্র। -পরিবেশবাদীরা কিন্তু বৃদ্ধ সান্তিয়াগোকে বলেছেন: নিষ্ঠুর, খুনি। একটি সুন্দর, বিশাল মাছকে দিনের পর দিন বড়শিতে আটকে রেখে নির্মম যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সহজে ডাঙায় তুলতে না পেরে মনে মনে যে হুঙ্কার ছেড়েছে সেটা নিয়েও আপত্তি উঠেছে: ‘‘যতই বড় হও, তোমাকে আমি মারবই। তোমার বিরাটত্ব আর বাহাদুরি আমি শেষ করবই।... তোমাকে আমি দেখিয়ে ছাড়ব মানুষ কী করতে পারে। মানুষের লেগে থাকার শক্তি কত ভয়ঙ্কর হয়।’’ -‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’ থেকে কিছু বিখ্যাত বাক্য আমি শিখেছি: * “Every day is a new day. It is better to be lucky. ** “But man is not made for defeat." *** “A man can be destroyed but not defeated.” -আসলে একটা মানুষের হার না মানার গল্প। ‘‘হার স্বীকার নয়, নিরন্তর সংগ্রামই জীবন। -ভুল। এটা হার না মানা মানুষের হেরে যাবার গল্প। -ভালো কথা, তোমার হাতের এ বইটার নাম কী? ইভা বইয়ের কভারটা দেখায়। -ও হেরমান হেসের প্রেমের কবিতা? খুব ভালো। নোবেল পুরস্কার ১৯৪৬ পাওয়া কবি-ঔপন্যাসিক। তার ‘সিদ্ধার্থ’ আমি পড়েছি জাফর আলমের অনুবাদে। -‘সিদ্ধার্থ’ আমিও খুঁজছি। কেমন বই? -ভিন্নরকম সৃষ্টি। ভারতীয় যুবক সিদ্ধার্থ এর নায়ক। সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ভাব বা দেশাচার দ্বারা যুবক-যুবতীরা অনেক সময় নেশাসক্ত হয়ে পড়ে। এমনই প্রভাবে ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত হওয়া কিংবা স্বর্গলাভের আশায় গৃহত্যাগী ‘সিদ্ধার্থ’, কিন্তু তিনি না ‘গৌতম বুদ্ধ’ না ‘ধর্মপ্রচারক’, তিনি রক্তমাংসের এক নতুন মানুষ। তথাকথিত বিশ্বাস, ধর্মীয় জ্ঞান, গৃহত্যাগী হয়ে সন্নাস ব্রত গ্রহণ করেন, কিন্তু এসবে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন নি যদিও সে পথেই পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু তার সচেতন বিবেক তাকে মানুষের দিক ফিরিয়ে প্রকৃতির দিকে নিয়ে গিয়েছে। বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করেও তিনি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন নি। প্রকৃতির নিয়মেই তিনি গৃহত্যাগী থেকে গৃহবন্দি হয়েছেন, নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঋষির বেশ থাকা সত্ত্বেও তার পিছু ছাড়েন নি। বন্ধুত্ববৎসল সিদ্ধার্থের সঙ্গে একবার যার বন্ধুত্ব হয়েছে কোনোদিন ভুলতে পারে নি। এ ছাড়া এতে রয়েছে ভারতীয় চিন্তা ও দর্শনের বিস্তর ছড়াছড়ি। -মানে? -হেস নিজেই বলেছেন: Siddhartha is my expression of liberation from Indian thinking. The pathway of liberation from all dogma leads upto Siddhartha and will naturally continue as long as I live. -অনুবাদটা তোমার কাছে আছে? -আছে। আছের ওপর জোর দিতে পারে না হেদায়েত। কারণ সে মিথ্যে বলছে। একই সঙ্গে মনে মনে ভেবে নিচ্ছে: ‘‘সংগ্রহ করে দিতে পারব? আমার কাছে কেউ যদি কিছু চায় না দিয়ে শান্তি পাই না। আর ‘সিদ্ধার্থ’ তো অতি মামুলি কিছু।’’ -অ্যাই কী ভাবছ? বইটা তোমার কাছে নেই এইতো? আমি সংগ্রহ করতে পারব। -না-না, আমি ভাবছিলাম, কোথায় রেখেছি বইটা...। -ও তাই বলো। - যাহোক, হেসের কবিতা পড় শুনি। আগে পড়িনি। -আমি পাঠ করি আপন মনে নিজেকে শোনানোর জন্য অন্য কাউকে না। ইভা বলল। -আহ্‌, শোনাও না! আকুতি হেদায়েতের কণ্ঠে। -ঠিক আছে, পড়ছি...। -না, না, দাও আমি পড়ি। তুমি শোনো। -এজ ইউ উইস। As every flower fades and as all youth Departs, so life at every stage, So every virtue, so our grasp of truth, Blooms in its day and may not last forever. … Even the hour of our death may send Us speeding on to fresh and newer spaces, And life may summon us to newer races. So be it, heart: bid farewell without end. -বুঝতে পেরেছ? হেদায়েতের প্রশ্ন। -থোড়া থোড়া। বরং আমি নিজে পড়লে বেশি বুঝি। -হ্যাঁ, এটা ঠিক যে নিজে পড়লে বেশি বোঝা যায়। আমি শেষের চার লাইনের অনুবাদ করছি শোনো: ‘‘এমনকি আমাদের মৃত্যুর সময়টিও অতি ক্ষিপ্রতায় আমাদের পাঠাতে পারে অন্য কোনো নতুন স্থানে এবং জীবন তখনও আমাদের ডেকে নেয় নতুন কোনো সৃজনে সুতরাং এই ভালো যে, প্রিয়জনকে বিদায় জানাও অশেষ প্রয়োজনে।’’ -নাইস, থ্যাঙ্কস। ইভা বলল। ॥৪॥ ওরা কয়েকজন। আসগর ইমতিয়াজ, মুক্তি সেরনিয়াবাত, হেদায়েতুল ইসলাম, সাগুপ্তা শারমিন ইভা, বোধিচন্দ্র সরকার, কুটিল সাংমা, গিরিধারি সেন, জহিরুল ইসলাম, রমেশচন্দ্র প্রমুখ বসে আড্ডা দিচ্ছে। সাগুপ্তা শারমিন ইভা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে: আরে ওই যে আকাশ স্যার যাচ্ছেন। চলো স্যারের সঙ্গে সঙ্গে যাই, কথা বলি। স্যারের কথা আমার খুব ভালো লেগেছিল: বাস্তব জীবনে ফর্মালেটিস দিয়ে কিচ্ছু হয় না। হেদায়েত: স্যার যদি কথা বলতে না চান? স্যার যেমন যেন কাঠখোট্টা। ইভা: কাঠখোট্টা? এটা আবার কেমন শব্দ? গিরিধারি: যাক কাঠখোট্টা বলেছ, কাঠঠুকরা বলোনি। মুক্তি: কাঠঠুকরা.. মানে. রমেশচন্দ্র: আরে কিছু বোঝো না? কাঠঠুকরা হলো পাখি, যে ঠোকরে ঠোকরে গাছে গর্ত করে। মুক্তি: ও, তাই বলো। জহির: আরে দার্শনিকের গু পাড়াইছে ত সাধারণ কথা বুঝে না। ইভা: এ্যাই তোমরা থামবে? জহির: এই যে থামলাম। হেদায়েত: আমি বলছিলাম কি, ওদিন ক্লাসে স্যার কেমন শক্ত শক্ত কথা বলেছিলেন... মুক্তি: আরে যাও না দেখি। ক্লাসের বাইরে স্যারের কথা তো ভিন্নরকমও হতে পারে। তারা ক’জন দৌড়ে গিয়ে স্যারের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। আকাশ স্যার চিন্তিতভাবে থমকে দাঁড়ালেন। চিনতে পেরে বললেন: ওহ তোমরা? আমি আরও ভয় গিয়েছিলাম? ইভা: ভয়? কেনো স্যার? বোধিচন্দ্র: আমরা ক’জন ছাত্র-ছাত্রী হঠাৎ আমার দিকে দৌড়াচি লাম না...? আসগর: সরি স্যার। আকাশ স্যার: বোধি যথার্থ। আসলে সময়টা তো খারাপ। ইভা: সরি স্যার। আকাশ স্যার: কেমন আছ? সবাই ভালো তো? আসগর: আমরা ভালো আছি স্যার। আপনি ভালো আছেন? আকাশ আহমেদ: ভালো আছি, পরম করুনাময়ের দয়ায়। বোধিচন্দ্র: মানে আল্লার রহমতে? স্যার, আপনি স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন? আকাশ আহমেদ: আমি আল্লায় বিশ্বাস করি। কেনো, তুমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করো না? বোধিচন্দ্র: করি স্যার, খুব করি। কিন্তু সন্দেহও করি। বিশ্বের বহু কবি, দার্শনিক, বিজ্ঞানি বিশ্বাস করেতন না, সেইসব কারণে আমি সন্দেহ করি কিন্তু অবিশ্বাস করি না। আগসর: অবিশ্বাস আর সন্দেহ, ওই একই হলো। ইভা: অবিশ্বাস আর সন্দেহ একই হবে কেনো? অবিশ্বাস ক্লিয়ার কনসেপশন, মানি না। আর সন্দেহ, অন্তর্দ্বন্দ্ব। আছে কি নেই। আকাশ আহমেদ: ইভা ভালো বলেছ। আমি বলি: সন্দেহ করো কিন্তু অবিশ্বাস করো না। দার্শনিক চিন্তা মূলত সন্দেহ থেকে। অবিশ্বাস হলো চূড়ান্ত গন্তব্য। অবিশ্বাস থেকে ফেরার পথ প্রায় থাকে না। কিন্তু সন্দেহ থেকে ফেরা খুব সহজ। আগে তোমাকে স্থির করতে হবে: কোন দিকে তুমি যাবে। বিশ্বাস না অবিশ্বাসের পথে। যদিও সি'র করা কঠিন। আমার জন্ম মুসলমান পরিবারে। ইসলাম ধর্মের পূর্ণতাবোধে আমার আস'া। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দাবরিশ ছিলেন একজন কম্যুনিস্ট। কম্যুনিস্ট দর্শন নাস্তিক্যবাদেরই দর্শন। কিন' তিনি তাঁর নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করতেন। গর্বভরে বলতেন: ‘‘আমার জন্ম মুসলিম সংস্কৃতিতে।’’ আমি মনে করি: কেউ ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস নাও করতে পারে, উত্তরাধিকার সূত্রে, তার ভেতরে ওটা থাকে। অবচেতনে এটা তার ভেতরে কাজও করে। নব্য নাস্তিক বা অবিশ্বাসী বা সন্দেহবাদী সকলের অবস্থা একই। যদিও তাদের মত বা ভান ভিন্নরকম হতে পারে। গিরিধারি সেন: দারুণ বলেছেন স্যার। মত বা ভান ভিন্নরকম হতে পারে। হ্যাঁ, হয়-ই তো। স্যার, আমাদের বাংলাদেশিদের চরিত্রে ভানটা অনেক বেশি। বিশেষ করে হিপোক্রেটিক ভান। এ বিষয়টা নিয়ে আমরা একদিন আলাদাভাবে আলোচনা করতে পারি। আকাশ স্যার: হ্যাঁ, ভান, হিপোক্রেটিক ভান, অভিনয়, লুকোচুরি এইসব শব্দ এ দেশীয় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হতে পারে। কিন্তু হিপোক্রেটাসকে আমরা শুধু শুধ দোষারোপ করি। -স্যার আপনি কি কনফার্ম? -শক্ত অবস্থান নিতে পারছি না। সত্য বলতে বিষয়টা আমি খুঁজে পাইনি। মানুষ কেনো বলে, ‘‘তুই একটা হিপোক্রেট।’’ আমি খুঁজেছি, যা পেয়েছি, আমার প্রবন্ধে লিখেছি: The name in question is 'Hippocrates', and has no relation to the term 'hypocrite', aside from being near homonyms. 'Hypocrite' comes from the Greek roots for 'under' and 'act' (as in the theater); assumedly it was a reference to pretending to have higher ideals than one actually has. 'Hippocrates' may have come from the Greek roots for 'horse' and 'power', possibly referring to a family trade working with horses, the way the English name 'Smith' derives from blacksmithing or 'Cooper' derives from barrel making. According to the Collins Dictionary & Thesaurus, the word “hypocrite”, meaning a person who pretends to be what he is not, has its origin in the thirteenth century, from Old French ‘ipocrite’, via Late Latin, from Greek ‘hupokritēs’ one who plays a part, from ‘hupokrinein’ to feign, from ‘krinein’ to judge .The origin of the word, an actor on a stage, changed even in Greek to the negative connotation it carries today. গিরিধারি সেন: স্যার আমি জানি। আমার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক বাবা বলেছিলেন। ওই দার্শনিক হিপোক্রেটাসই হিপোক্রেসির জন্মদাতা। কিন্তু তিনি যা করেছিলেন সেটি ছিল পজেটিভ অর্থে। আর আমরা সেটিকে ব্যবহার করছি নেগেটিভ অর্থে। আকাশ স্যার: যেমন...। গিরিধারি সেন: আমরা জানি Hippocrates চিকিৎসা বিদ্যার জনক। তিনি তাঁর সময়ের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি প্রচলিত পদ্ধতির নামকরা সব চিকিৎসকের কাছে গিয়ে, তারা কীভাবে চিকিৎসা করেন, কী কী ওষুধ দেন, কীভাবে খেতে বলেন সেসব নোট করতেন। এবং তিনি তার করতেন একজন অনুগত ভাবশিষ্যের মত। না হলে তারা সে সব তাকে কেনো জানাবেন? কেনো শেখাবেন? তিনি দেখলেন: কেউ জ্বরের জন্য রোগীকে ঠাণ্ডা পানিতে চুবাত, ঠাণ্ডা রোগী গরম পানিতে চুবাত। কেউ রক্ত দোষণ দূর করার জন্য জোক থেরাপি দিত, কেউ রগ কেটে শরীর থেকে রক্ত বের করে দিচ্ছে। বমি করানোর জন্য দুর্গন্ধযুক্তচড়ংরবং খাওয়ানো হত। চিকিৎসকদের এমন উদ্ভট কর্মকাণ্ড তাঁর মোটেই পছন্দ হলো না। এরপর অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি সংগ্রহ হওয়ার পর তিনি ওগুলোর তুলাধুনা বিশ্লষণ ও সমালোচনা করে পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেন। তিনি দেখালেন নামকরা সব চিকিৎসকদের অনেকের পদ্ধতিরই কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। জাস্ট কল্পিত, মনগড়া পদ্ধতিতে যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছেন তারা। তিনি লিখেন: তাদের কর্মকা- রোগীদের সঙ্গে স্রেফ প্রতারণা। যা তারা করছেন স্রেফ গাঁজাখুরি। তাঁর এই সমালোচনা তৎকালিন গ্রিসের চিকিৎসক সমাজ ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়। বহু বছরের প্রচলিত পদ্ধতি ও বিশ্বাসে তাঁরা মারাত্মক ধাক্কা খান। চিকিৎসকদের মধ্যে যাঁরা তাঁকে বিশ্বাস করে গোপন কথা বলেছিলেন, তাঁরা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। হেপোক্রিট শব্দটির বহু অর্থ: ভাওতাবাজী, প্রতারণা, মিথ্যা ভান, বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি। ইংরেজিতে সেটি এভাবে বলা হয়েছে: : A person who pretends to be what he or she is not; specif., one who pretends to be pious, virtuous, etc. without really being so. আর এভাবেই Hippocrates নামের সঙ্গে Hypocrite শব্দটা যোগ হয়ে গেল। আকাশ স্যার: জানতাম না, সত্যি ভালো বলেছ। ধন্যবাদ। জহির: স্যার, বিশ্বাস নিয়েও আমার মনে বিরোধ আছে। আকাশ স্যার: কেমন? জহির: আমি সব সময় ভাবি ঈশ্বরের বিশ্বাস দিয়ে কী হয়? আমি যদি অলসতা করি, পড়াশোনা না করি আল্লাহ কি আমাকে দিয়ে পড়াশোনা করিয়ে নেবেন? আমি মনে করি, আমার জীবন আমার। বিশ্বাস করলেও যা না করলেও তা। বেঁচে আছি, অসুস্থ হলে মরে যাব এখানে ঈশ্বরের ভূমিকা কোথায়? একজন নাস্তিক জীবন যাপনের জন্য যা করে আমিও তো তাই করি। পৃথিবীর অনেক জাতি গোষ্ঠীর মানুষের কাছে এখনও সভ্যতার আলো পৌঁছেনি। তারা না শুনেছে আল্লার নাম না শুনেছে ঈশ্বরের না। তাদেরও তো চলে যাচ্ছে। সত্যেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত একটা দারুণ উদাহরণ দিয়েছিলেন: চেরাপুঞ্জিতে এত বৃষ্টিপাত হয় আর সাহারা মরু ভূমিতে এক ফোঁটাও না। ঈশ্বর থাকলে এমন বৈষম্য হত না। বছরের পর বছর ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিরোধ চলছে। আল্লাহ উভয় পক্ষকে মিলিয়ে দিচ্ছেন না কেনো? এত মানুষের রক্তপাত দেখে কেনো তার মনে দয়ার সৃষ্টি হয় না? তিনি না পরম দয়ালু। তার ইশারাতেই তো সব হয়ে যেতে পারে। আকাশ স্যার: খুব জটিল আর বহু বছরের অমিমাংসিত বিষয়ে প্রশ্ন করলে। এমন প্রশ্নে জগতের মানুষ আজও বিভক্ত। আমি শুধু আমার বিশ্বাস থেকে বলছি: ধরো, একটি দেশের সরকার না থাকলে কী হয়? জহির: অরাজকতা, খুনোখুনি, হানাহানি। আকাশ স্যার: যদি সেই অরাজকতা, খুনোখুনি, হানাহানিতে তোমার কোনো অংশগ্রহণ নাও থাকে। ঈশ্বরের জগতেরও একই অবস্থা হয়। তবে, মানুষকে তার প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করে ঈশ্বর তাদের গাইডলাইন দিয়ে বলেছেন: ঠিক এইভাবে চলবে। তোমার চলার ওপর আমি কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখলাম না। আমার নির্দেশের রকমফের করবে না। করলেই রয়েছে চরম শাস্তি পেতে হবে।...কোনো ব্যাপারেই সীমালঙ্ঘন করবে না, করলেই একসময় ধরা হবে। কঠোর আজাবের মুখোমুখি করা হবে। আসলে ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে তিনি আছেন না করলে তিনি নেই। এটা যার যার ব্যাপার। অন্যায়, অপরাধ করে জগতেই অনেক শাস্তি পাচ্ছে, পাচ্ছে না? জহির:পাচ্ছে স্যার। আপনি তো আপনার ধর্ম বিশ্বাস থেকে কোরান হাদীস থেকে বলেন। কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীরা কী করবে? আকাশ স্যার: আমি আমার ধর্ম বিশ্বাস থেকে এ জন্য বলি যে, আমারটা সর্বশেষ। অন্তত আমি এটাই জানি এবং মানি। অন্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের নিজস্ব ধর্মের কোড মেনে চলবে। কোনো ধর্মেই কিন্তু জোর জুলুমের কথা বলা নেই। জহির: কিন্তু আপনি বরাবরই বলে আসছেন আপনারটাই সেরা। আকাশ স্যার: আমারটাকে আমি সেরা ভাবলে তোমার তো কোনো ক্ষতি নেই। তবে হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস আর মত আমি কারও উপর চাপিয়ে দিই না। আমার সঙ্গে একমত হতে জোর খাটাই না। এই জোর খাটানোটাই আমার মতে অপরাধ। কারণ আমার ধর্ম আমাকে অন্যের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর আঘাত করার সুযোগ দেয় নি। বরং আমি যদি অন্যায়ভাবে অন্য ধর্মাবলম্বী আমার কোনো দুর্বল প্রতিবেশীর এক ইঞ্চি জায়গাও জোর করে দখল করি, হাসরের মাঠে, সেই পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে আমার কাঁধে তুলে দেয়া হবে। এটাই কোরানের কথা আর আমার বিশ্বাসও তাই। আসগর: স্যার বিশ্বাস নিয়েও মনে হয় আমাদের কিছু কথা হওয়া উচিত। বহু ধরনের বিশ্বাস আমাদের চারপাশে। অর্জিত, পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া, চাপিয়ে দেওয়া আর ওই যে বললেন-ভান, ভান বিশ্বাস বা বিশ্বাসের ভান। আমি অনেক লোক দেখেছি: যারা প্রকৃতই বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসের ভান করে। এরা কিন্তু ভয়ঙ্কর। স্যার, পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া বিশ্বাসের একটি উদাহরণ দিতে পারি। আমি দেখেছি লেখক হুমায়ুন আহমেদ এমনিতে আল্লাহ কিংবা পরকালে বিশ্বাস করতেন না। বহু জায়গায় তিনি সেটা বলেছেন। যেমন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: ‘‘মৃত্যুর পর আর কিছু নেই। এখানেই শেষ। এসব কথা বলে আমি এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে কষ্ট দিতে চাই না।’’ কিন্তু শিশুকিশোর মাসিক টইটম্বুর এর সম্পাদক সেলিমা সবিহ্‌ লিখেছেন: ‘‘যখন সম্মানী দিতে গিয়েছি, তিনি (হুমায়ূন আহমেদ) বলেছেন: লাগবে না, আল্লাহ আমায় অনেক দিয়েছেন।’’ মুক্তি: আসলে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বিশ্বাস নিয়ে কথা বলা কিংবা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন। আকাশ স্যার: হ্যাঁ, ঠিক। সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন তা হলো তার ‘অর্জিত বিশ্বাস’ আর টইটম্বুরের সম্পাদককে যা বলেছিলেন: এটা হলো তার পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া বিশ্বাস। এখানে কোনো ভান নেই। গিরিধারি: স্যার, প্রকৃত নাস্তিকরা কিন্তু কারও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে জোর খাটান না। তারা শুধু দর্শন আর বিজ্ঞান থেকে যুক্তি দেন। ইভা: মানে যেন তেন একজন লোক নাস্তিক হতেই পারে না? আকাশ স্যার: না, কারণ নাস্তিকতার পক্ষে সে কোনো যুক্তি দিতে পারবে না। বোধিচন্দ্র: স্যার, আপনি বলতে চাচ্ছেন, নাস্তিক হওয়া কঠিন? কোনো এক ব্যক্তি বলল: ‘‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না-তাহলেই সে নাস্তিক হয়ে গেল না।’’ আকাশ স্যার: হ্যাঁ, ঠিক তাই। শুধু নাস্তিক না, ভালো ধার্মিক হওয়াও কঠিন। এই যে, আমরা আমাদের চারপাশে এত ধার্মিক দেখছি, মন্দির, মসজিদ, গির্জা ভরা লোক দেখছি তাদের বেশিরভাগ মানুষই প্রকৃত ধার্মিক না। প্রকৃত ধার্মিক হওয়ার জন্য প্রকৃত সৎ হওয়া অপরিহার্য। ভালো মানুষ অসৎ হতে পারে না। আর ভালো মানুষ না হয়ে একজন ভালো ধার্মিকও হতে পারে না। আর এ কথা অতি সম্প্রতি ডা. জাকির নায়কও বলেছেন। আসগর: স্যার, আপনি কি জাকির নায়েককে সমর্থন করেন? আকাশ আহমেদ: কেন করব না, ধর্ম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে যার এত দখল আমি কেন তাকে সমর্থন করব না? তবে হ্যাঁ, কখনও হয়তো তাঁর কিছু বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি। সোজা কথা, তার উগ্র সমালোচকদের সঙ্গে আমি একমত নই। আসগর: স্যার, তাহলে আপনার বক্তব্য হলো, যে কোনো অবস্থাতে আমাদের নিজস্ব ধর্মের মধ্যেই থাকা উচিত? আকাশ স্যার: হ্যাঁ, সেরা কাজটা সে তার ধর্মের মধ্যে, দেশের মধ্যে, সমাজের মধ্যে থেকেও করতে পারে। তবে করাটা কঠিন। জ্ঞান অর্জনের জন্য, নিজের ভেতরের শক্তি ও ক্ষমতা আবিষ্কার করার জন্য তোমাকে পথে বের হতে হবে। কারণ তুমি যদি তোমার কর্মের মূল্যায়ণ না পাও কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ইউরোপীয়রা কাজের, যোগ্যতার মূল্যায়ণ পায়। যাহোক, ‘মহাভারত’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিতে পারি। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন: ‘‘কেউ আমার অতি আপন নয় কেউ আমার অতি পরও নয়, কিন্তু যখন ধর্ম ও অধর্মের মাঝে যুদ্ধ হয় তখন আমি স্বাভাবিকভাবেই ধর্মের পক্ষে অবস্থান করি।’’ আমারও একই কথা। শাদা-সিধেভাবে, সহজ সরল পথে। ইভা: ধন্যবাদ স্যার আপনার অবস্থান ক্লিয়ার করার জন্য। মুক্তি: স্যার, প্রথমদিকে বোধিচন্দ্র ‘সময়’ নিয়ে একটা কথা বলেছিল: ‘‘এখন সময়টা তো খারাপ।’’ আসলে কোনো কালেই সমসাময়িককাল সেই সময়ের লোকদের কাছে ভালো ছিল না। কোনো কালের সিনেমা-নাটকই সবশ্রেণির মানুষের মন জয় করেনি। আকাশ স্যার: হ্যাঁ এটাও ঠিক, এমন বক্তব্য সর্বকালেই পাওয়া গেছে। আবার একই ব্যক্তি তার পেছনের দুঃখের দিনগুলোর স্মৃতিচারণও কত মধুর করে তুলে। মুক্তি: আপনার এ কথাও সত্য। আসগর: স্যার আপনি কি খেয়াল করেছেন, আমরা যারা ধর্মানুসারী সবাই বলে থাকি: নিজে সৎ কর্ম করো অন্যকে সৎকর্ম করার পরামর্শ দাও। কিন্তু প্রকৃতই আমরা কেউ সৎকর্ম করি না কিন্তু পরামর্শ দিই। কেনো স্যার? আকাশ স্যার: কারণ উপদেশ দেওয়াটা সহজ। জহির: উপদেশে কাজ হয় স্যার? আকাশ স্যার: কিছু কাজ যে হয় না, বলা মুশকিল। শিশুদের মন খুব কোমল থাকে। নীতিগল্পের নীতিকথাগুলো যা তারা শুনে সারাজীবন মনে রাখে। এমনও হয়, একটা বাক্য তার সাজীজীবনের পরিচালনা শক্তি হয়ে যায়। কুটিল সাংমা: কিন্তু তাহলে কেনো বলা Example is better than precept? অর্থাৎ উপদেশের চেয়ে উদাহরণ ভালো। ইভা: আমার মনে হয়: উদাহরণ মানে নজির। নজিরটা সবাই দেখতে পায় বলে। এটা তাদের উদ্বুদ্ধ করে। আসগর: স্যার, আমি আপনাদের সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি, অনেকেই নয় বেশিরভাগ মানুষ সৎ কর্ম করে এবং করার জন্য অন্যকে পরামর্শ দেয়। তবে সৎ কর্ম যারা করে চুপিচুপি করে মাইক বাজিয়ে করে না। ফলে তাদেরটা আমরা দেখতে পাই না। আকাশ স্যার: আমি এভাবে বলে থাকি: ‘‘তুমি ঠিক তো সব ঠিক। শিশুদের কাছে Example বা দৃষ্টান্ত হও তারা তোমায় অনুসরণ করবে।’’ মুক্তি: স্যার, দৃষ্টান্ত হওয়া কঠিন। আজকাল দৃষ্টান্ত হচ্ছে মারদাঙ্গা সিনেমার নায়করা। সিলভাস্টার স্ট্যালোন, ব্রুস লি, জেট লি, স্ট্যান লি, শাহরুখ-আমির-সালমান খান। তারা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া। ক্ষমার দৃষ্টান্ত খুব কম ছবিতেই আছে। অথচ ব্যক্তি জীবনে মারামারি করতে হয় খুব কম লোকের। কিন্তু ক্ষমা করতে হয় অনেক লোকের। মারামারিতে নায়ক শরীরের চেয়ে বুদ্ধির কৌশল প্রয়োগ করে বেশি। কিন্তু দর্শকরা দেখে নায়কের সিক্সপ্যাক শরীর। এটাই সমস্যা। হেদায়েত: তাহলে এক গালে চড় দিলে আরেকগাল পেতে দাও। ধর্ম ও দর্শনের এ বাক্য অনুসরণ করবে কে? আকাশ স্যার: এটা যিশু খ্রিস্টের কথা, পরে গান্ধীও বলেছেন। তারা জগৎকে ক্ষমার শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। ও হ্যাঁ, ভালো কথা। আজ ‘দ্য ন্যাশন’ পত্রিকায় আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছে। পড়ে দেখতে পার। যদি মনে কোনো প্রশ্ন জাগে সেটা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। আসগর: কী বিষয় স্যার? আকাশ স্যার: বিষয় ‘ফর্মালিটিস’। মানে ‘আনুষ্ঠানিকতা’ বা ‘লৌকিকতা’। মুক্তি: মানে সেদিনের আপনার ক্লাসের প্রতিধ্বনি? আকাশ স্যার: হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। আসগর: অবশ্যই পড়ব স্যার। এখনই আমি পত্রিকা সংগ্রহ করব। -ঠিক আছে ধন্যবাদ। ॥৫॥ বন্ধের দিন। কংসের তীরে ওরা ক’জন কুটিল সাংমা, জহিরুল ইসলাম, মোমিনূল হক, তুফান শেখ, আসগর ইমতিয়াজ, হেদায়েতুল ইসলাম, সোহাগ সাগর, রমেশ ও বোধিচন্দ্র এলোমেলোভাবে বসে যে যার মত দূরের দিকে তাকিয়ে আত্মমগ্নতায় ডুবে আছে। শরতের দুপুরে সবাই কেমন উদাসীনতার জ্বরে আক্রান্ত। আলোচনা শুরু হতে পারছে না সবার না আসার কারণে। এ সময় দূরে দেখা যাচ্ছে সাগুপ্তা শারমিন ইভা আসছে। তার সঙ্গে তার ছোট বোন মারিয়া। তারা বেশ সাজুগুজু করেছে এসেছে। কাছাকাছি পৌঁছলে সবার দৃষ্টি তাদের ওপর স্থির হলো। রমেশচন্দ্র: দু’বোনকে খুব সুন্দর লাগছে। জহির: খুব না ভীষণ সুন্দর লাগছে। শরতের ঝিমিয়ে পড়া দুপুর দু’বোনকে পেয়ে নান্দনিকতায় ভরে উঠেছে। ইভা: বেশি বলা হচ্ছে। তোমাদের কাছে যা সুন্দর আর নান্দনিতায় ভরা অন্যের কাছে নাও হতে পারে। একটা বিষয়: মারিয়া বার বার হেদায়েতের দিকে তাকাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ইভার মুখে হেদায়েতের কথা শুনে মারিয়া হেদায়েতকে দেখতে এসেছে। এটাই রহস্য। কিন্তু হেদায়েতের মন খারাপ। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে। সে এসেছে সবার আগে। আশা করেছিল, ইভাও আগে চলে আসবে। কিন্তু আসিনি। রমেশ: কীরে হেদায়েত মরমে মরে গেছিস নাকি? মারিয়া এসেছে-কিছু তো বল। হেদায়েত: আমি কী আর বলব। তোরাই তো সব বলছিস। ইভা: অনেক হয়েছে আর প্রশংসা শুনতে চাই না। এবার কাজের কথা বলো। আসগর: আগে একটা গান হতে পারে। মারিয়া তো অনেক ভালো গান করে। কীরে, কী বলিস তোরা? সোহাগ সাগর: ইয়েস, কবির প্রস্তাব যথার্থ, হেদায়েতের মন তো এমন কিছুর জন্যই উদাসীন হয়ে পড়েছে। বোধিচন্দ্র: আমি চাই একটু বিনোদন, একটু প্রশান্তি। রমেশ: ব্যর্থ প্রেমিকদের জন্য: মিউজিক ইজ দ্য মেডিসিন অব দ্য ব্রোকেন হার্ট। কুটিল সাংমা: আমাদের মধ্যে ব্যর্থ প্রেমিকও আছে? জহির: কেউ কেউ আছে। হেদায়েত: রমেশইয়া আর জহিরইরা নাম বলতে হবে। নাহলে তোদের এমন ছ্যাঁচা দিয়াম... আসগর: বন্ধু হেদায়েত, ফুলের জলসায় আজ কেনো তুমি নীরব? সোহাগ সাগর: এবার তোরা বকবকানি বন্ধ কর। মারিয়া আপু গান শুরু করছে। মারিয়া এতক্ষণ মাথা নিচু করে আপুর ক্লাসমেটদের বকবকানি শুনছিল। বড়রাও যে ছোটদের মত ঝগড়া করতে পারে দেখে সে খুব মজা পাচ্ছিল আবার তার লজ্জাও করছিল। ঘোষণা শুনে মুখ তুলে একবার সে সোহাগ সাগরকে দেখল এবং পরক্ষণেই তার আপুর দিকে তাকাল। তার সুন্দর মুখটায় কচি কলাপাতার কোমলতা। মোমিনূল হক: মাশাল্লাহ, মারিয়া ইভার চেয়ে অনেক সুন্দরী। ইভা: ছাত্রী হিসেবেও সে অনেক ভালো। এসএসসিতে জিপিএ গোল্ডেন পেয়েছে। বোধিচন্দ্র: আমরা কামনা করছি-কাশফুলের পবিত্র শুভ্রতায় ভরে উঠুক মারিয়ার জীবন চলার পথ। মারিয়া: ধন্যবাদ ভাইয়া। তুফান শেখ: একটি আধুনিক গান হোক। আসগর: প্রস্তাবটা আগে আমি করেছি, তাই আমার দাবী অগ্রগণ্য। আমি শুনতে চাই দেশের গান। তুফান শেখ: হ্যাঁ, মারিয়া দেশের গানও ভালো করে। আমি শুনেছি। গত বছর একুশে ফ্রেবু্রয়ারিতে মারিয়া তার কলেজের অনুষ্ঠানে দেশের গান গেয়ে পুরষ্কার পেয়েছিল। তাই না? মারিয়া: জি ভাইয়া। ইভা: তাহলে একটি দেশের গানই আগে কর। আমারও দেশেরও মাটিরও গন্ধে ভরে আছে সারা মন...। মারিয়া গান ধরলো। সত্যি সে ভালো গায়। গান শেষ হলে আসগর জানতে চাইল: মারিয়া, জানো তো এ গানের কথা কে লিখেছিলেন? মারিয়া: জি, মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান। আসগর: অনেক ধন্যবাদ। তুফান বলল: এবার একটি আধুনিক গান করো? যেটি তোমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। মারিয়া: আধুনিক আর ফিল্ম যা বলেন তিনটি গান আমার খুব পছন্দের। গান তিনটি হলো: আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল, তুমি চেয়েছিল ওগো জানতে, বাঁকা চাঁদ আকাশে। আসগর: তাহলে তো সবক’টিই শুনতে হয়। ইভা: না, যে কোনো একটি। মারিয়া গান ধরল। ‘‘তুমি চেয়েছিল ওগো জানতে, কেনো এত ভালো লাগে তোমাকে...। গান শেষ হলে হেদায়েত হেসে হাততালি দিলো। বলল: এটা আমাও খুব প্রিয় গান, মারিয়া। তুফান: অনেক ধন্যবাদ মারিয়া। গান করলেও তুমি জীবনে ভালো করবে। সোহাগ সাগর: গান তো হলো। এবার...? তুফান শেখ: আজ তো মুক্তি এলোই না। আসগর: শোন, মুক্তি ইচ্ছে করলেই আসতে পারে না। দূর থেকে সে আসে। যান-বাহনের মর্জির ওপর অনেকটা নির্ভর করতে হয় তাকে। পা ফেলতে হয় ভেবে চিন্তে। বাসের চালক-হেলপাররাও সুযোগ নিতে চায়। জহির: এটা ঠিক। আমাদের দেশের রাস্তা-ঘাট এখনও মেয়ে বান্ধব হয়ে উঠলো না। আমরা ভাগ্যবান যে, আমরা দর্শন পড়তে এসেছি। আর দেশের ৫০%-৬০% লোক এখনও দর্শন বলতে ‘দেখা’র বাইরে কিছু বোঝে না। তাছাড়া সে প্রচুর পড়াশোনা করে, ভালো সিনেমা দেখে, ঘর-গৃহস্থালির কাজ করে। আমাদের মত ভঙভাতালাইম করে না। জহির: আমরা ভঙভাতালইয়াম করি? আসগর: তুই না করিস, আমি করি। আচ্ছা, সংসারের কোন কাজটা তুই করিস? বাবা-মাকে সাহায্য করিস? মুক্তি সব করে। সবকিছুতেই তার প্রচুর আগ্রহ আর আনন্দ। এমনকি অবসর সময় সে মামাকে ডাক্তারিতেও সাহায্য করে। ম্যাডাম যে ক্লাসে একদিন বলেছিলেন: ‘‘পড়াশোনা আর কাজ যা কিছু করো আনন্দের সঙ্গে করবে। তাহলেই দেখবে, মজা পাচ্ছ। জীবনের কর্ম সাধনে এই মজার গুরুত্ব অনেক। দেখবে কঠিন পাঠও সহজ হয়ে যায়। শুধু মনের বিরুদ্ধে যেও না।’’ মুক্তি প্রায়শই ম্যাডামের এ কথাগুলো আওড়ায়। সোহাগ সাগর : মনে হয় ম্যাডামই মুক্তির মাথাটা খেয়েছে। ইভা: মাথাটা খেয়েছে বাক্যটি ভালো হয়নি। আমি মনে করি, মুক্তি এতে লাভবানই হবে। গ্রামের মেয়ে আদাজল খেয়ে পড়াশোনায় লেগে পড়েছে। এটা খারাপ কী, বরং ভালো। তোমরা এটার সমালোচনা করছ কোন চিন্তায় বুঝতে পারছি না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি আড্ডা মারতে এসেছি? আসগর: মুক্তি একদিন আমায় বলেছিল: ম্যাডামের মত স্পিড সে অর্জন করবে। সে বলেছিল: জীবনে স্পিড না থাকলে কিছু থাকে না। আর স্পিডের জন্য চাই জ্ঞান আর অর্থ। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার জন্য যা প্রয়োজন সব ম্যাডামের আছে। তুফান শেখ: এক কথায় ম্যাডাম তাকে ভেতরে বাইরে বদলে দিয়েছেন। ইভা: এই বদলের প্রয়োজন ছিল। জহির: ওই তো মুক্তি এসে গেছে। মুক্তি ইভার বিপরীত পাশে বসতে বসতে বলল: কে কাকে বদলে দিয়েছে? ইভা: কাকে আর, তোমাকে। মুক্তি: কে? ইভা: ম্যাডাম। মুক্তি: তাই? আমি কি সত্যি এতটুকু বদলে গেছি? ইভা: একটু না অনেকখানি। মুক্তি: ঠিক আছে, সবার দৃষ্টি আমার ওপর থাকায় আমি খুশি। এখন বলো, এতক্ষণ কী বিষয়ে আলোচনা চলছিল? নাকি পর চর্চাই সার? আসগর: পর চর্চায় যে অনেক মজা। কুটিল সাংমা: মনে হয় আসগরের খুব লেগেছে? রমেশচন্দ্র: ইভাকে বললে যেমন হেদায়েতের লাগে। হেদায়েত: -হা, হা, হা, তাই নাকি? আরে ক্যামনে লাগে আমি যে টের পাই না। তুফান: আজ থেকে পাবে। ইভার মুখটা একটু সংকোচিত হয়ে যায়। সে বলে: আমি শুধু আমারটা জানি। মুক্তি: আমিও। একটা কথা: আমার জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে। সে উদ্দেশ্য পুরণ করতেই এখানে এসেছি। তোমরা আমার সহপাঠী, বন্ধু, সঠিক গাইডলাইনও। ভুল পথে ঠেলে দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে কথা কাটাকাটি করে মনোমালিন্য সৃষ্টি করা বরং আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমরা বরং সৃজনশীলতার বিষয়ে কথা বলব। কেউ যদি একটা ভালো সিনেমা দেখে আসো সেটাও শেয়ার করো। কেউ যদি ধর্মীয় বিষয়েও ভালো কিছু শিখো সেটাও বলবে। আমরা আমাদের জ্ঞান বহুমুখী করতে হবে। সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতা আমাদের চারপাশে করোনার জীবানুর চেয়ে ভয়াবহ আকারে বিরাজ করছে। আমাদের সে সবরে ওপরে উঠতে হবে। আর হ্যাঁ, এ মুহুর্তে প্রেম-ভালোবাসা আমার জন্য অপ্রয়োজনীয় সৌখিনতা। আমি চিন্তাই করতে পারি না। তবে, কাউকে যদি সবদিক থেকে খুব বেশি মনে ধরেই ফেলে তাকে মনের কথাটি বলে ফেলব। ফিরিয়ে দিলেও। আমাকেও কেউ বললে, পছন্দ না হলে, বুঝিয়ে বলব আমার অপারগতার কারণ। তুফান: ধন্যবাদ মুক্তি। এবার আমরা আলোচ্য বিষয়ে যেতে চাই। আজকের আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল: ‘‘সৃজনশীলতার মূল্য কবিতা, সঙ্গীত ও শিল্পে’’। মুক্তি: বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সোহাগ সাগর: তুমি আগে আসলে আলোচনাটা অন্যদিকে যেত না। মুক্তি: তোমরা তো জানো আমি অনেক দূর থেকে আসি। সবদিন হয়ত আসতেও পারব না। তোমরা একজন দায়িত্ব নিয়ে আলোচনাটা চালিয়ে যাবে। তুফান: ঠিক আছে। ভবিষ্যতে চেষ্টা করব। মুক্তি: ‘সৃজনশীলতার মূল কথা’ বিষয়ে প্রথম কে বলবে? হেদায়েত: তুফান তুমি বলো। প্রতিদিন আসো, চুপচাপ চলে যাও। আজকে যখন মুখে কথা ফুটেছে কিছু বলো, শুরুটা করে দাও। তুফান: আমি পারব? ইভা: চেষ্টা করো। না পারলে তোমাকে তো কেউ জেল ফাঁসি দেবে না। তুফান: সৃজনশীলতা হলো যে কোনো কাজে ব্যক্তির বিশেষের নতুনত্ব, যা সে উপহার দেয়, যা দ্বারা অন্য ব্যক্তি থেকে তাকে পৃথক করা যায়। সৃজনশীলতা অবশ্যই ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হবে, হওয়া আবশ্যক। চিন্তায়, অবকাঠামোয়, উপস্থানপনে যার নতুনত্ব যত বেশি তিনি তত সফল সৃজনশীল। তিনিই সবার দৃষ্টি কাড়েন, মূল্যায়ন পান, শেষে বিখ্যাত হন। কেবল কবিতা, সঙ্গীত কিংবা চারু-কারু-চিত্র শিল্পেই নয়, সৃজনশীলতা থাকে সৃষ্টির সর্বত্র, একজন কৃষক সেটি প্রয়োগ করেন তার কৃষি খামারে, একজন গৃহিনী তার রান্নায়। আমার মনে হয়, উঁচুমানের সৃজনশীলতা কেবল মানুষের মধ্যেই থাকা সম্ভব। ইতরপ্রাণীরা যত বুদ্ধিমানই হোক তাদের মধ্যে উঁচুমানের সৃজনশীলতা আশা করা যায় না। আলোচ্য বিষয়ের দ্বিতীয় অংশের প্রশ্নটা হলো: কবিতা, সঙ্গীত ও শিল্পে সৃজনশীলতার মূল্য কী? যে কোনো শিল্পে সৃজশীলতাই আসল, যা মানুষকে নতুত্বের স্বাদ দেয়, নতুন নতুন সৃজনে ও চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে। বর্তমান যুগে কৃষিও একটি শিল্প। যে কৃষকের উদ্ভাবনীশক্তি যত বেশি সে তত সফল। সোহাগ সাগর: ওহ্‌, দারুণ বলেছ। মুক্তি: কোনো কথাই বাকি নেই। সব বলে ফেলেছে। এত জানো, বলতে পারো তাহলে প্রতিদিন পেছনে চুপচাপ বসে থেকে চলে যাও কেন? আর কে বলবে? আসগর চুপ করে আছ কেনো? আসগর: আজ আমি শুধু শুনব। মুক্তি: কেনো, মন খারাপ? বন্ধুরা মন খারাপ করে দিয়েছে? রমেশ: আসগর দেখ, মুক্তি তোর ভেতরটা পড়তে পারছে। হা হা হা। আসগর: পড়তে পারে নাকি? পড়ে কী পায় ছাই না ভস্ম? মুক্তি হাসে। কিন্তু কোনো উত্তর করে না। সোহাগ সাগর: অ্যাই আর কিছু বলিস না। আসগর কিন্তু কেঁদে ফেলবে। মুক্তি: নাহ্‌ তোমাদের নিয়ে আর পারা গেল না। ফাঁকফোকর পেলেই শিশুদের মত খোঁচাখুঁচি শুরু করো। রমেশচন্দ্র: আরে একটু মজা করছি আর কি। না হলে তো শেখায় আনন্দ নেই। বিদেশীরা দেখো না কেমন হাসি-খুশির মাঝ দিয়ে শেখে? মুক্তি: আমাদের দেশের বাস্তবতায় ওদের সব গ্রহণ করা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে: মুসলিম কান্ট্রিগুলোর বাস্তবতা ভিন্নরকম। মোমিনূল হক: মুসলিম প্রধান দেশের মানুষদের মধ্যে একটা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য থাকা উচিত। প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর শিক্ষা-বিনোদন ওজনদার হওয়া উচিত। কথাবার্তায়, আচরণে সদাচার থাকবে, হাস্যরস থাকবে কিন্তু হালকামি, ছ্যাবলামি, নগ্নতার প্রদর্শনী থাকবে না। তাদের পোশাক ও চাল-চলনের ধরন দেখে তাদের চেনা যাবে। এমনকি ভিন্নধর্মীদের সঙ্গেও তাদের আচরণ হতে হবে উন্নত, মার্জিত। কথায় কথায় তাদের জাহান্নামে পাঠানো যাবে না। বোধিচন্দ্র: ঠিক বলেছ মোমিনূল হক। আমি মনে করি, প্রত্যেক ধর্মের লোকদেরই নিজস্বতা ও আত্মমর্জদা বজায় রেখে চলায় উচিত। মুক্তি: আমাদের আলোচনা জমছে না। কেমন রসকসহীন হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা জীবনের সফলতা সম্পর্কে কে বলবে। ইভা: জীবনের সফলতার সংজ্ঞা জীবনের সংজ্ঞার মত সুনির্ধারিত নয়। হাজার রকম হতে পারে। দেশ ও ব্যক্তিতে রকমফের হতে পারে। আসগর: আমি আইনস্টাইন থেকে কিছু বলতে পারি। তিনি বলেছেন: A=X+Y+Z. X is work. Y is play. Z is keep your mouth shut." তুফান: আমি জানতাম না আইনস্টাইনের সফলতার এ সূত্রটি। জানলে আমিও চুপচাপ থাকতাম। রমেশচন্দ্র: ও এ জন্যই হেদায়েত এতক্ষণ চুপ করে আছে? জানলে, জানলে আমিও চুপ মেরে যেতাম। হেদায়েত: তোমরা সত্যি যদি আমার মধ্যে আইনস্টাইনীয় কিছু দেখে থাক তাহলে নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। কিন্তু আমি চুপচাপ ছিলাম আমার অজ্ঞতার জন্য। সত্যি বলছি যে, আমি জানি যে, সৃজনশীলতা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সোহাগ সাগর: বাহ্‌ দারুণ! সক্রেটিসীয় বাহাস: ‘‘I know that I know nothing.’’ হেদায়েত: সক্রেটিস মিথ্যে বলেননি। তিনি কি সবকিছু জানতেন? জানতেন না। তবে তাঁর দেখার ক্ষমতা ছিল সুদূর প্রসারী। সমাজ-রাষ্ট্রের অসঙ্গতিগুলো খোলা চোখে তিনি দেখতে পেতেন। স্পার্টাকাসের মত তিনি সরাসরি বিরোধীতাও করেন নি। শুধু প্রশ্ন করেছেন, তরুণদের প্রশ্ন করতে শেখাতে চেয়েছেন। রাষ্ট্র ও ধর্মবেত্তাদের চোখে ওটাই ছিল তাঁর অপরাধ। আর সেই কল্পিত অপরাধকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্র বিচারের নামে যে প্রহসন করেছে, জুলুম করেছে সেটাই সক্রেটিসের বিশ্বখ্যাতির মূল কারণ। মুক্তি: ভালো বলেছো, ধন্যবাদ হেদায়েত। জীবনের সফলতা সম্পর্কে আর কেউ কিছু বলবে? রমেশ কিছু বলো। রমেশ: রমেশ ক্যামকর্ডারের লুকিংগ্লাসে চোখ রেখেই বলল: আমি মনে করি, যে যাকে কিংবা যা কিছু চায় তাকে কিংবা সেই সবকিছু পেলে সে সফল হয়। সেই গানটির মত: ‘‘...দিও না তুমি কিছু দিও না আমায় সব কিছু পাওয়া হবে পেলে গো তোমায়।’’ মুক্তি: ভালো বলেছে। কিন্তু খুব সহজেই তাকে পেয়ে গেলে কারও কারও মন আবার অন্যদিকে চলে যায়। বলে: ‘‘যা পেয়েছি ভুল করে পেয়েছি।’’ হেদায়েত: আজ থেকে রমেশ সেবামূলক রেকর্ডিংয়ের কাজ শুরু করেছে। রমেশ: ‘সেবা’ শব্দটিতে আমার আপত্তি আছে। হেদায়েত: আমাদের বক্তব্য রেকর্ড করে সত্যিই তুমি অনেক উপকার করছ। এটি একটি সেবামূলক কাজ নয় কেনো? সরকারের দেয়া ত্রাণসামগ্রি গরীবদের মাঝে বিতরণ করে গরীবদেরই ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বার যখন মনে করে অনেক সেবা করে ফেলছে। তাহলে তোরটাকে সেবা বলতে বাধা কোথায়। পরে প্রয়োজনে আমরা রেকর্ডটি বাজিয়ে শুনতে পারব কে কতটা বকবক করেছি। জহির: আর আসগর কবি যদি সত্যি একদিন বিখ্যাত হয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। বহুমূল্যে মিডিয়া এই রেকর্ডটি কিনে নেবে। আসগর: যাহ্‌ শালা, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল আর কাকে বলে। রমেশ: শোন, রাজনীতিতে ‘সেবা’ শব্দটির অপপ্রয়োগ দেখে, ভালো কাজেও এর ব্যবহার এখন খুব যেনতেন লাগে। মুক্তি: হ্যাঁ, একনিষ্ঠ সমাজ ও মানবসেবক, জরদরদী, গরীবের বন্ধু ইত্যাদি ইত্যাদি। রমেশ: হ্যাঁ, যা বলেছ...। এগুলো আসলে বাংলা ও ভারতের আখের গোছানো ধোকার রাজনীতিতে ব্যবহৃত গণপটানো শব্দ। ইভা: বাদ দাও ‘সেবা’ প্রসঙ্গ। ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে কথা বলো। রমেশ: আজ তুফানকেই বলতে দাও। মুক্তি: তুফান শেখ আজ ফ্লোর তোমার ফেবারে। তুফান: ঠিক আছে, যথা আজ্ঞা। Creativity হলো: the use of imagination or original ideas to create something; iventiveness. অন্য কথায়: Creativity is the act of turning new and imaginative ideas into reality. It is characterised by the ability to perceive the world in new ways, to find hidden patterns. একমাত্র আমার কর্মই আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। রুনা-সাবিনার কথা ধরো, তাদের গান যখন আমরা শুনি, তাদের, মা, বাবা, সন্তান কারও কথা ভাবি না। আমরা তাদের দেখি, তাদের কণ্ঠ শুনি। থমাস আলভা অ্যাডিসের কথা ভাব, বিদ্যুৎ বাল্বটা যখন মাথার ওপর জ্বলে উঠে তখন আমরা তার কথা ভাবি। পৃথিবী জুড়ে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ তার অবদানের জন্য তাকে মনে করে। সবই তাদের সৃজনশীলতা বা সৃষ্টিশীলতার জন্য। মুক্তি: অনেক সুন্দর বলেছ তুফান শেখ।হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক, আমার সৃষ্টিই হবে জগতে আমার নামের স্মারক। কথাটা আমি এভাবেও বলতে পারি তাই না? তুফান: হ্যাঁ পারি। আর এ জন্যই তো মানুষ এত বেশি সৃজনপাগল। এজন্যই রবীঠাকুর ভবিষ্যৎ ভেবেছেন: যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এ বাটে...। সেদিন শাকুয়াই হাটবার। বিকেল হয়ে আসায় বাজারি লোকেরা তাদের নিজ নিজ জিনিসপত্তর নিয়ে হাটের দিকে যাচ্ছে। মুক্তি রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল: দেখো কী সুন্দর পাকা কলা খাঁচায় ভরে হাটে যাচ্ছে লোকটা। কেউ একজন আমার সঙ্গে এসো কলা কিনে নিয়ে আসি। তুফান: চলো আমি যাব। মুক্তি: চাচা, আপনার কলার নাম কী? কলাওয়ালা: গেরাসুন্দরী। মুক্তি: এত সুন্দর নাম, মানে কি চাচা? কলাওয়ালা: মানে গেরামের সুন্দরী। মুক্তি: ও তাই বলেন। তিন হালী দেন। খাঁচা থেকে তুফান কলার কান্দা তুলে মুক্তির হাতে দেয়। এভাবে মুক্তির হাতে তুফানের হাতে দু’বার স্পর্শ লেগে যায়। দু’জনেই তারা কেউ-ই বুঝতে পারে না কেউ কি ইচ্ছে করে লাগিয়েছে কিনা। এ দ্বন্দ্বেই তারা পরস্পর চোখচোখি হয়ে যায়। বিষয়টা কলাওয়ালার চোখ এড়ায় না। কলাওয়ালা: আপনেরার দুইজনরে খুব মানাইছে। মুক্তি তার পার্সে টাকা খুঁজছে। তুফান: টাকা আমি দিচ্ছি। মুক্তি: না, আমি দেব বলে এসেছি। তুমি খাওয়াবে আরেকদিন। তারা আরেকবার চোখাচোখি হয়। খুব কাছে থেকে। মুক্তির মনে হলো তুফানের সঙ্গে তার চোখের দুরত্বটা খুব কম। কেমন আচমকা একটা কাঁপুনি দেখা দেয় তার ভেতরে। সে থতমত খায় এবং টাকাটা কোনোরকমে দিয়ে তুফানকে পেছনে রেখেই দ্রুত নদী তীরে ফিরে যায়। মুক্তি: নাও সবাই কলা খাও। আমার আর তুফানের পক্ষ থেকে। তুফান: না, না। আমি শুধু বহন করেছি। আসগর: মানে বিস্ট অব ভার্ডেন? প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ আসগরের কথার মধ্যে। রমেশ, জহির, মোমিনূল, বোধি ওরা কেউ-ই বুঝল না আসগরের কথার মধ্যে যে তুফানের প্রতি বড় ধরনের বিদ্রুপ রয়েছে। কিন্তু মুক্তি ও তুফান ঠিকই বুঝেছে: মুক্তির সঙ্গে তুফানের কলা কিনতে যাওয়াটা আসগরের ভালো লাগেনি। তখনই সেখানে ঝালমুড়িওয়ালা এসে হাজির হয়। তুফান বলল: ঝালমুড়ি আমিই খাওয়াচ্ছি। ॥৬॥ জহির, রমেশ ও হেদায়েত অলস-ক্লান্ত ভঙ্গিতে ক্যাম্পাসে হাঁটছে। পরবর্তী ক্লাসের জন্য অপেক্ষা। এক কিশোর হটপটে চা ফেরি করছে। জন থেকে জনে গিয়ে জিগগেস করছে। আবার আপন মনেই ডেকে যাচ্ছে: এ্যাই চা খাবেন, গরম চা। চা খাবেন, গরম চা। রমেশ: কীরে তোর চা গরম আছে? হটপটওয়ালা: জি স্যার, এই যে কতক্ষণ আগে বানাইয়া আনছি। খাইলেই তো বুঝবেন স্যার। জহির: দে, তিনজনরে তিন কাপ দে। রমেশ: এ্যাই চায়ের মধ্যে কী কী দিয়েছিস? হটপটওয়ালা: স্যার, লেবু আর দারুচিনি। রমেশ: তোর লিকার খুব হালকা। কী বলিস আসগর। জহির: হ্যাঁ, হালকাইতো। হেদায়েত: তোমার নাম কী? হটপটওয়ালা: জাফর স্যার। হেদায়েত: স্কুলে যাও না জাফর। হটপটওয়ালা: যাই তো স্যার। হেদায়েত: এখন তো স্কুলের সময়, তুমি এসেছ চা বেচতে। রমেশ: মিথ্যে বলছে বোধহয়। হটপটওয়ালা: না স্যার, ক্লাস ফাইভে পড়ি। ২টা থেকে ক্লাস। হেদায়েত: খুব ভালো ছেলে। তোমার বাবা কী করেন? হটপটওয়ালা: রিকশা চালায়। হেদায়েত: আর মা? হটপটওয়ালা: মানুষের বাড়ি কাজ করে। হেদায়েত: তাহলে তুমি পড়াশোনা বাদ দিয়ে চা বেচ কেনো? হটপটওয়ালা: কী করতাম স্যার, বাবা-মা দুইজনে খাইটাও সংসার চলে না। সকাল ৯টা থেকে ১২টা আমি দুই ফ্লাক্স চা বেচি। এতে আমাদেও পরিবারের অনেক সাহায্য হয়। হেদায়েত: আমি যদি তোমার বয়সে চা বেচার সুযোগ পেতাম তাহলে এতটা অলস হতাম না। হটপটওয়ালা: কী বলছেন স্যার, আপনি কেন চা বেচবেন? চা টাকা দেন অন্যদিকে যাই। রমেশ: কত হইছে? হটপটওয়ালা: পনেরো টাকা স্যার। হেদায়েত একটা ৫০টাকার নোট বের করে তার হাতে দেয়। হটপটওয়ালা: স্যার, ভাঙতি দেন। অত টাকার ভাঙতি আমার কাছে নাই। হেদায়েত: তুমি সবটাই নিয়ে নাও। হটপটওয়ালা: না স্যার, এভাবে টাকা নিতে আমার বিবেকে লাগে। আপনাদের কাছে ভাঙা না থাকলে পরে দিয়েন। হেদায়েত: তুমি টাকাটা তোমার কাছে রেখে দাও। আরও কয়েকদিন না হয় চা খাওয়া যাবে। হটপটওয়ালা: ঠিক আছে তাইলে নিলাম। মনে কইরা চা খাইয়েন কিন্তু। হেদায়েত: আচ্ছা খাব। তারা কংসের তীর ধরে কদমতলার দিকে হাঁটছে। জহির: কীরে হেদায়েত, ওই চা-ওয়ালা ছেলেটারে আমি আর রমেশ তুই কইরা কইলাম আর তুই কিনা তুমি কইলে। হেদায়েত: এটাই আমার স্বাভাব। শিশু-কিশোরদের তুমি করে বলি। একটা শিশুকে তুই বলতে আমার রুচিতে বাধে। আচ্ছা, তোদের একটা প্রশ্ন করি? ছেলেটা যদি গরীর চা-ওয়ালা না হত, কোনো বড় লোকের সন্তান হতো তোরা কি তুই করে বলতি? রমেশ: স্থান-কাল-পাত্র বলে একটা কথা আছে না। হেদায়েত: এটা আমার আম্মা মহান নূরজাহানের শিক্ষা। তিনি বলতেন: ছোট বাচ্চাদের তুমি করে বলতে হয়। শিশুরা ফেরেস্তাদের মত নিষ্পাপ। তোরা লক্ষ্য করেছিস, মা ভালো হলে যে সন্তানও যে ভালো হয়? চা-ওয়ালা ছেলেটা গরীব কিন্তু তার আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর। এই বয়সে সে, বাবা-মাকে সাহায্য করছে। দেখিস, এ ছেলে বড় হয়ে ভালো কিছু করবে, ঠিকবে না। । জহির: আর আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলো পিচ্ছি বাচ্চাদের পাঠিয়ে দেয় ভিক্ষা করতে। ভিক্ষাবৃত্তিটা এদের মজ্জাগত হয়ে যায়। হেদায়েত: এর পেছনেও কারণ আছে। এরা চলেই ভিক্ষায় চালে, টাকায়। সত্য বলতে খুবই দীনহীনভাবে। জহির: গ্রামে-গঞ্জে আমি দেখেছি, মাদ্রাসার ছেলেমেয়ে পাঠানো মা-বাবারাও কেমন যেন। মাদ্রাসায় বাচ্চাদের পাঠিয়েই দায় সারে। হেদায়েত: এরও কারণ আছে। যাহোক বাদদে। রমেশ: এ্যাই হেদায়েত, পরের ক্লাসটা আউটডোর না ইনডোরে? হেদায়েত: আউডডোরে। জহির: কোনো স্যারের? হেদায়েত: হাবিবুল্লাহ বাহার স্যারের। রমেশ: চল চল সময় হয়ে গেছে। তারা কদমতলার গোল চক্কওে গিয়ে দেখল সব ছাত্র-ছাত্রী হাজির। স্যারও কথা বলা শুরু করেছেন। আজগর: যুক্ত হতে পারি স্যার? স্যার পেছন দিকে তাকিয়ে বললেন: ও তোমরা? এসো, এসো। আচ্ছা তোমরা জানতে না ক্লাস আছে? একটু পানচুয়েল হও। জীবনটা আড্ডা মেওে, ফাও আলাপ করে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। টপিক্‌স ফলো করে। ইন্টারনেটা ভরা টপিক্‌সে। ভালো কিছু শেখার মাধ্যমে জীবনকে আনন্দ ও অর্থপূর্ণ করা যায়। আমাদের সময় এত বই, এত সুযোগ ছিল না। বই কেনার পয়সা ছিল না। আর এখন ইন্টারনেট আছে, সকল জ্ঞানের জন্য ইন্টারনেটই যথেষ্ট। জ্ঞান, তর্ক-বিতর্ক, প্রশ্ন, উত্তর, খারাপ হওয়ার গরম মশলা সব আছে ইন্টারনেটে। রশেম: স্যার, প্লিজ কিছু মনে করবেন না। একটা কথা বলি। আমি মনে করি, জীবনে খারাপ হওয়ারও দরকার আছে। হা. বাহার: মানলাম খারাপ হওয়ার পক্ষে তোমার কাছে যুক্তি আছে। কিন্তু খারাপটা হবে কে? তুমি? তুমি হবে? রমেশ: না মানে, স্যার। কাউকে না কাউকে তো হতেই হবে। হা. বাহার: অন্যকে খারাপ হওয়ার জন্য বা করার জন্য উৎসাহিত করো না? নিজে হও, আমি ওয়েলকাম জানাব। ইভা: খারাপ হওয়ার জন্য কী করতে হবে? হা. বাহার: অন্যেরা যা করে। কথায়-কাজে মিল থাকবে না, কোনো কারণ ছাড়াই নিরীহ মানুষকে অপমান অপদস্ত করবে, দোকানে বাকি নিয়ে দেবে না। পথেঘাটে মেয়েদের টিস করবে। লোকেরা ধরে চড়থাপ্পর দিলে মাউন্ড করবে না। চুরি ছিনতাই করবে। মহিলাদের পার্স, মোবাইল, গলার চেন ধরে টান দেবে। কিন্তু মনে রেখ, এগুলো এত সহজ না। ইচ্ছে করলেই পারবে না। এগুলোর জন্যও বাড়তি যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। কঠিন করে বললে বলতে হয়: দেহ-মন একাত্ম করে নিবেদন করতে হয়। না হলে, অল্প দিনের মধ্যেই এমন প্যাদানি খেতে হয় যে, বাপের নাম ভুলে যেতে হয়। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের খারাপ বা নষ্ট হওয়া অনেক সহজ। মঞ্চে কিংবা মঞ্চের বাইরে খারাপ হওয়ার অভিনয়ও সাত দিন করলেও আর ফেরা যায় না। রমেশ: স্যার, আপনি তো রেগে যাচ্ছেন। হা. বাহার: কারণ তোমরা আমাকে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলাচ্ছ। রমেশ: স্যার, অনেক খারাপ ছাত্র, খারাপ লোক মহৎ কাজ করে দেখিয়েছে। হা. বাহার: মানছি, খারাপ হওয়ার পক্ষে তোমাদের কথায় অনেক যুক্তি আছে। কিছু খারাপ, নষ্ট লোক জীবনের আলপথ থেকে রাজপথে উঠে এসেছে। কুঁড়েঘর থেকে প্রাসাদে উঠে এসেছে। পথের ফকির আমির, রাজা-বাদশা হয়েছে। কিন্তু সংখ্যায় তারা অতি নগণ্য। হয়তো বলবে: শেকসপিয়ার বলেছেন, ‘‘খারাপ বলে কিছু নেই। একটা বস' তখনই খারাপ যখন আমরা সেটাকে খারাপ বলে মনে করি।’’ পৃথিবীতে সবকিছু আপেক্ষিকভাবে খারাপ কিংবা ভালো। কিন্তু বন্ধুরা, ওই দার্শনিক অবস্থাননে তুমি বাস্তবে জীবন যাপন করো না। এখানে ভালোমন্দের একটা মাপকাঠি আছে। স্ট্যান্ডার্ট আছে। তুমি সেই স্ট্যান্ডার্টের কথা ভাব। তুমি খারাপ হয়ে গেলে, লসটা তোমার। না না তোমার একার নয়, তোমার পিতা-মাতার, তোমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যার। তোমার সমাজের, রাষ্ট্রের। আসগর: ইয়েস স্যার। সবকিছুর সঙ্গে আমাদের ভ্যালেন্স করে চলতে হয়। না হলেই দুর্ঘটনা ঘটে। মহাসড়কে একজন বাস চালকের ক্ষণিকের অসর্তকতা, হেঁয়ালি অনেক মানুষের মৃত্যুও কারণ হতে পারে। হা. বাহার: দারুণ একটা উদাহরণ দিয়েছ তুমি আসগর। আমি যদি কখনও মহাসড়কে বাসে চড়ি, ড্রাইভারদেও দক্ষতা ও নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। বিপরীত দিক থেকে আসা শত শত বিশাল বাস অবলীলায় কেটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আমার ড্রাইভার। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়, এই বুঝি একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে গেল, দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু ড্রাইভারের মধ্যে এসব নিয়ে কোনো ভাবান্তর নেই। সে আপন মনে, খেয়ালে বিশাল খেলনাটিকে নিয়ে সামনের গন্তব্যে দিকে ছুটে যাচ্ছে। মোমিনূল হক: স্যার, এ প্রসঙ্গে আমি কিছু বলতে পারি? হা. বাহার: নিশ্চয়ই বলবে। মোমিনূল হক: স্যার, আমি মনে করি, এই ডাইভারের হাত অলক্ষ্য থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন আমার মহান আল্লাহ। শুধু এটাই না, পৃথিবীর যত মহৎ কর্মযজ্ঞ প্রতিমুহূর্তে সম্পন্ন হচ্ছে সে সবের পেছনে রয়েছে তাঁরই কৃপামূলক ইশারা। না হলে, কয়েকফুট উঁচ্চতা ও আয়তনের মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব হত না। এ জন্য আধ্যাত্মবাদীরা মনে করেন: পৃথিবীর সমস্ত জীবনীশক্তির চালনা স্রোত হলেন সর্বশক্তিবান আল্লাহ। বোধিচন্দ্র: মোমিনূল হকের কথা ফেলে দেয়ার উপায় নেই স্যার। একজন ড্রাইভার সে যে ধর্মেরই বিশ্বাসী হোক, বাস ছাড়ার আগে একটি অন্তত প্রার্থনা করে, তার সৃষ্টিকর্তার নাম নেয়। আর এই প্রার্থনাই তাকে পদে পদে বিপদমুক্ত রাখে। মোমিনূল হক: ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের প্রার্থনার অর্থ হলো তাকদিরের ওপর নিজেকে সপে দেয়া। মানে বিশ্বাস করা: ‘‘ভালো-মন্দ সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়’’। আর এ জন্যই আল্লাহ সর্বদা তার সঙ্গে থাকেন। মুক্তি: জি স্যার, আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। বান্দা যখন কঠিন কাজ সামনে নিয়ে তাঁর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে, সে প্রার্থনা যত কম সময়েরই হোক, তিনি তার কঠিন কাজ সহজ করে দেন। হা. বাহার: আমি রমেশের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে আরও কিছু বলতে চাই। জ্ঞানার্জন শেষ হলে যার যা ইচ্ছে, করো, হও। এরপর যদি তুমি বোহিমিয়ার রাস্তা ধরে হাঁটো, পাগলের বেশ ধরে ঘুরে বেড়াও, বারণ করব না। বরং সম্মান করব। ধরে নেব: এরও প্রয়োজন আছে। এ কাল ক্ষেপণ অর্থহীন নয়। কিন্তু মূর্খের জ্ঞানী হওয়ার ভানটা ধরা পড়ে যায়। ইভা: ইয়েস স্যার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উৎযাপন উপলক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসেছিল: ‘‘২০-২২ বছর বয়সে আমি এবং আমার কয়েকজন বন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিলাম। অনশন করেছি। জেলেও যেতে হয়েছে। এই স্বাধীনতার জন্য আমাদের বুকেও ততটাই অপেক্ষা ছিল যতটা আপনাদের ছিল।’’ প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অংশ গ্রহণের বিরোধী। এই বিরোধীতার জন্যই তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। আর বক্তব্য দেওয়া সময় বলছে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা। এ থেকেই ভারত বাংলাদেশের আপামোর মানুষ বুঝে নিয়েছে কত বড় ভানকারী ভ- সে। হা. বাহার: যাহোক বাইরের আলাপ অনেক হয়েছে। এবার বল, গত ক্লাসে আমরা কোথায় শেষ করেছিলাম। -স্যার, দর্শন আলোচনার মূল সমস্যা কী? হা. বাহার: কেউ বলো। কে বলবে? মুক্তি: দর্শন আলোচনার মূল সমস্যা হলো বিশ্বাস নিয়ে, বস'বাদ-ভাববাদের দ্বন্দ্ব-কলহ: কে বড়, কে আগে? অর্থাৎ দেহ না আত্মা? অন্য কথায়: ভূতপদার্থ না ভূতআত্মচৈতন্য? বস'বাদী বা দেহবাদীর মতে: ভূতপদার্থ বা দেহ-ই প্রধান। দেহের বাইরে আত্মার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই ভূতপদার্থ বা দেহ থেকেই কোনো না কোনোভাবে চৈতন্যের বা আত্মার উৎপত্তি হয়। অপরদিকে, আত্মবাদীদের মতে, দেহ বা পদার্থ জড়। চৈতন্য আছে বলেই দেহ একটি পূর্ণাঙ্গ সত্তা। ভূতপদার্থ বা জড়দেহের অন্য নাম মায়া। জড় সতত পরিবর্তনশীল। যেমন শিশু, যুবক ও বৃদ্ধ। এই আছে এই নেই। কিন্তু আত্মা চিরকালের। হিন্দু দর্শন এটাকে এভাবে বলেছে: দেহ পরমব্রহ্মরূপে চেতনপদার্থের কোনো একটি প্রকাশ বা বিকাশমাত্র। এখানে মনে রাখতে হবে যারা দেহবাদী তারাই বস'বাদী আর যারা আত্মবাদী তারাই ভাববাদী। যদিও তাদের মধ্যেও ধনী-গরীব আছে, জাতপাতের ভাগ আছে, বর্ণের অহঙ্কার আছে। যদিও তারা মত ও পথে শতধারায় বিভক্ত। আসগর: তাহলে স্যার, বস' বা ভাববাদের মধ্যে কোনটি শ্রেয়? হা. বাহার: এর সিদ্ধান্ত যার যার। আমি মনে করি, এসব মতবাদ দিয়ে কিচ্ছু হয় না। শুধু আলোচনা-সামলোচনা, ঠেলা-ঠেলি, মারা-মারি, কাটা-কাটিই সার। হা হা হা। হেদায়েত: স্যার, তো এদ’ুয়ের মধ্যে কোনোটি মানুষ বেশি গ্রহণ করেছে? অর্থাৎ বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়েছে? হা. বাহার: আমার বিচারে ভাববাদীরাই সংখ্যায় ভারী। ইভা: জগতের কল্যাণ সাধনে কোনটি বেশি পারঙ্গম? হা. বাহার: বলা মুশকিল। রমেশ ও বোধিচন্দ্র তোমরা কী বল? রমেশ: স্যার, ঈশ্বর বিশ্বাস যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে আমাদের কোনো কাজে লাগে না। কাজেই আমি বস'কেই প্রধান্য দেব। কারণ বস'কে আমরা প্রয়োজনের সময় পাই। বস' আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি না করেই সাহায্য করে। পাশে দাঁড়ায়। যেমন ধরুন, একটি নৌকার কথা। আকার আয়তনে যত ছোটই হোক, নদী পার হতে আমাদের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে। কল্পনার চেয়ে এটিই আমার কাছে শ্রেয়। এদিক থেকে আমি বরং মনসুর হাল্লাজের: আইনাল হক বা আমিই আল্লায় বিশ্বাস করি। কারণ: আমার কাজের কর্তা আমি নিজে। বোধিচন্দ্র: রমেশ যে নৌকার কথা বলেছে, এটি দৃশ্যমান। এই জীবনের আপতকালে দৃশ্যমান নৌকাটি হয়তো আমাদের সাময়িক সাহায্য করে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এ জীবন এখানেই শেষ নয়, পরম পর জীবন আছে, যার মিলনাকাঙক্ষা আছে। পরমাত্মা তার টার্গেট। কারণ পরমজীবন পরমাত্মার অংশ। আপাত জীবনের আপতকালে দৃশ্যমান কোনো সাহায্য তার কাছ থেকে না পেলেও আমার চলবে। আমি বরং বিদ্যাসাগরের মত সাঁতরে নদী হব। কিন্তু বৃহত্তর জীবন সায়রে পার করার ব্যাপারে পরম নৌকার বিশ্বাস আমি হারাব না। হা. বাহার: বাহ্‌, দু’জনেই সুন্দর বলেছে। নিজ নিজ বক্তব্যের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তিও দিয়েছ। এবার আমরা মোমিনূল হকের কথা শুনব। মোমিনূল হক: স্যার, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, আইজ্যাক নিউটন, স্টিফেন হকিন্স, মনসুর হাল্লাজ, ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, আল গাজ্জালী, শঙ্করাচার্য, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র আমি সবাইকে কমবেশি পড়েছি। নাস্তিক্যবাদীরা আমাকে এমন কোনো যুক্তি দেখাতে পারেনি যে, আমাকে থমকে দাঁড়াতে হয়েছে। আমি বরং আমার ধর্মবিশ্বাসের বাইরে শঙ্করাচার্য, বিবেকান্দ, গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। তারা কেউই উপমহাদেশীয় জলবায়ুতে পুষ্ট হয়ে উপমহাদেশীয় জ্ঞানের বৈতরণীতে কুঠারাঘাত করেন নি। অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি: তারা অবিশ্বাসের পথে পা বাড়াননি। আমাদের মুসলিম মনীষিগণ যেমন ইকবাল, গালিব, নজরুলের কথা বাদই দিলাম। স্যার, দেহবাদী বা বস'বাদী মতে, দেহ ভিন্ন স্বতন্ত্র কোনো আত্মার অস্তিত্ব নেই। তাদের মতে, দেহ পঞ্চভূতে গঠিত। .. পঞ্চভূত হলো: ..এখানে আত্মার স্থানন নেই। নৈয়ানিকদের ন্যায়সূত্র মতে, পৃথিবীপন্তেজো বায়ুবাকাশমিতি ভূতানি।’’ অর্থাৎ মাটি, জল, তেজ(অগ্নি),বায়ু, আকাশ এই পঞ্চভূতে দেহ গঠিত। এখানেই আত্মা নেই। কিন্তু পবিত্র কুরানে আছে: মাটি-জল-তাপ দিয়ে দেহ তৈরি করে তাতে স্বীয় সত্তা ফুঁ দিয়ে প্রবেশ করে। বাইবেলেও দেহ গঠনের উপাদান তিনটি।.. কুটিল সাংমা: মোমিন ভাই, নৈয়ানিক দার্শনিকদের সম্পর্কে একটু বলুন। নৈয়ানিক একটি ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়। ন্যায়শাস্ত্রে যারা পণ্ডিত তাদের বলা হয় নৈয়ানিক, কুতার্কিক বা ন্যায়বাগিশ। ন্যায়দর্শনের প্রাচীন গ্রনে'র নাম: ন্যায়সূত্র (Nyayasutras)| কুটিল সাংমা: ধন্যবাদ মোমিন ভাই। স্যার, চার্বাকদের সম্পর্কে আপনি যদি কিছু বলতেন। হা. বাহার: চার্বাকদের মতে, মাটি, জল, পানি ও আগুন এই চার উপাদানে শুধু মানবদেহ নয়, পুরো বস'জগতের সৃষ্টি। চার্বাকরা আত্মা ও আকাশ স্বীার করে না। কারণ আত্মা ও আকাশ দেখা যায় না। চার্বাকদের মতে: যে ঈশ্বর দেখা যায় না তা যথার্থ নয়। একই সূত্রে তারা দিক, কাল, ও মন স্বীকার করে না। কী কুটিল সাংমা, যা বলেছি ক্লিয়ার? কুটিল সাংমা: ইয়েস স্যার। হা. বাহার: আজকের আলোচনা এখানেই শেষ হোক। কী বলো? একটা লোক দৌড়ে এলো। স্যার স্যার, আমি আপনাদের সাহায্য চাই। দেখুন আমার বউটা আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। এমনিতেই ঘরে খাবার নেই, পকেটে টাকা নেই। সে যেতে চাচ্ছে তার বাপের বাড়ি। তার বড় বোন অসুস' তাকে দেখতে। আমি না করছি, কিন্তু সে যাবেই। এখন আপনারাই বলেন, এখন আমি কী করি। আমি কি আমার অবাধ্য স্ত্রীকে তাকে তালাক দেব? মোমিনূল হক: নাউজুবিল্লা। এই কারণে তুমি বউ তালাক দিবা? লোক: হ দিয়াম। হেদায়েত: তুমি একটা গরু। না সরি, গরুও এর চেয়ে ভালা। আসগর: তুমি একটা খারাপ লোক। ভাত দেবার মুরোদ নাই কিল মারনের গোঁসাই। তুমি বউরে খাওন দিতে পার না, অসুস' বইনেরে দেখতে যাওয়ার জন্য কিছু পয়সা দিতে পার না, তুমি কইতাছ বউরে তালাক দিবা। তোমার বউয়ের জায়গায় আমি অইলে কবে তোমার মত অকর্মারে তালাক দিয়ে চইলা যাইতাম। হা. বাহার: আচ্ছা মানলাম, তুমি বউরে তালাক দিবা। ত আমারার কাছে আইছ কেল্লাগি? লোক: তালাকের ফতোয়া জানার লাগি। রমেশ: স্যার এর লাগি আমি ধর্মে নাই। বীজ গণিতের সূত্রের মত বউ তালাকেরও সূত্র আছে। মোমিনূল হক: শোনো রমেশ, এ দোষ ধর্মের না, আমাদের। কাজী নজরুল ইসলাম এ জন্যই লিখেছিলেন: ‘‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও পিছে, বিবিতালাকের ফতোয়া খুঁজছি হাদীস ও ক্বোরাণ চষে। বাহিরের দিকে যত মরিয়াছি ভিতরের দিকে তত গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু-ছাগলের মত।’’ হা. বাহার: এ্যাই শোনো, তোমার নাম কী? লোক: আসমত স্যার। হা. বাহার: বউ তালাক দেওয়া কি বেশি জরুরি? লোক: না, স্যার। কিন্তু কথা মানে না যে.. হা. বাহার: এই নাও কিছু টাকা। এই তোমরাও দশ টাকা করে দাও। ওর সংসারটা টিকুক। টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় লোকটা সালাম দেয়। কুটিল: এই শোনো: সালামের অর্থ জানো? লোক: জানি স্যার। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। কুটিল: তোমার তো নিজেরই ঘরে শান্তি নাই। লোক: তবু আপনাদের জন্য দোয়া করলাম। যদি বিনিময়ে আমার ঘরে শান্তি আসে। হা. বাহার: এইতো বুদ্ধি খুলেছে। যাও, কাজ করে খাও, বউকে সুখে রাখ নিজেও সুখে থাক। লোক: দোয়া করবেন স্যার। হা. বাহার: আচ্ছা মোমিনূল হক, ভালো একটা প্রসঙ্গ এসেছে। বউ তালাকের দর্শনটা কি আমরা খুঁজতে পারি না? মোমিনূল হক: পারি স্যার। Continue

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন