রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০২০

এইডসের বিভীষিকা

এইডসের বিভীষিকা

টাম ম্যাগাজিন থেকে অনুবাদ

গাজী সাফুল সলাম

১৯৯৯ সালের কথা। একজন পর্যটক রুয়ান্ডার পল্লী আঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে এক গণমৃত্যু উপত্যকার সন্ধান পান। আর তখনই বিশ্বজুড়ে তা প্রথম ব্যাপকভাবে প্রচার পায়। রাজধানী কাম্পালার দক্ষিণে রাকাই জেলাটি ছিল এইডসের নিরাপদ বিচারণ ভূমি। পথে-ঘাটে শুধু কঙ্কালসার মানুষ ত্বকে যাদের পূঁজভর্তি পচনশীল ফোঁড়া। যারা বস্তির ঘরের চেয়ে সামান্য বড় যেনতেনভাবে তৈরি করা ঘরে পড়ে রোগ-যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। একজন বৃদ্ধার কথাই ধরা যাক, যিনি তার চার পুত্র ও পুত্রবধূকে হারিয়েছেন। সকলেরই মৃত্যু হয়েছে এই কৃশকায় রোগেয় (ঝষরস ফরংবধংব)। এখন তিনি বিদ্যুৎবিহীন, পানিবিহীন একটি ঘরে তার বিশটি নাতি-নাতনি নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আরেকজন কিশোরী মা, কোলে তার এইচআইভি আক্রান্ত শিশু। মাটি তার রুগ্ন শিশুটিকে ডায়েরিয়া প্রতিরোধক সেলাইন খাওয়াচ্ছে, যার সংঙ্গে মিশে যাচ্ছে তার চোখের জল। আর শিশুটির প্রতিক্রিয়াহীন ছোট্ট মুখটাতে কোনো ভাষা নেই। আফ্রিকার অনেক দেশে এইডসের ভয়াবহতা অত্যন্ত সুস্পস্ট। এটা বোঝার জন্য কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তয় উপ-সাহারা অঞ্চলের ব্যাপক আক্রমণের শিকার দশটি দেশের উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখা গেছে, ১৯৯০ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের বয়সের ৫৫ লাখ শিশু তাদের মা হারিয়েছে। এক সময় এক বিদেশী বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছিলেন, পুনর্বার আফ্রিকায় প্লেগের আক্রামণ হলে মিলিয়ন মিলিয়ন লোক মারা পড়বে। কিন্তু তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়নি, আফ্রিকায় প্লেগের আর আক্রমণ হয়নি। এখন সে শতাব্দীও অতিক্রান্ত। কিন্তু পূর্র্ণ বিকশিত সমস্যারূপে একটা রোগ তাদের সামনে ঠিকই দাঁড়িয়ে গেছে যার ক্ষতিও কল্পনাতীত। শুধু ২০০০ সালে সারা বিশ্বের এইডসে মৃতের সংখ্যা ২৬ মিলিয়ন। খসড়া হিসেবে আফ্রিকাতে তাদের সংখ্যা ৮৫%। অপরদিকে, ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত  ৫.৬ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে এইডসের কারণে কবর দেয়া হয়েছে, যাদের অধিকাংশই আফ্রিকান। একটি মহাদেশ ইতোমধ্যেই যুদ্ধ আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে হতশ্রী হয়ে গেছে। এইডস সেখান থেকে মুছে দিচ্ছে বেশিরভাগ প্রজন্মকে। পরিবারগুলো ভেঙে গেছে। দক্ষ শ্রমিকরা হারিয়ে গেছে। বেশিরভাগ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠমো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। প্রাণহীন হয়ে গেছে সামগ্রিক উন্নয়নের প্রত্যাশা। ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই, আছে শুধু মৃত্যুর আতঙ্ক। কিন্তু পালিয়েও বাঁচার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কোথায় যাবে নিজের জন্মভূমি ফেলে?

তবে হ্যাঁ, সমগ্র আফ্রিকায় একসঙ্গে এইডসের আক্রমণ শুরু হয়নি। হয়েছিল বিশেষ অঞ্চলে। কিন্তু দারিদ্র্য ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে শ্রমিকদের স্থানান্তরের মাধ্যমে এইডস ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে। পরে আরও যেসব কারণ এইডস ছড়াতে ভুমিকা পালন করেছে, সেগুলা হলো, উদ্বাস্তু সমস্যা। পতিতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এবং অর্থনৈতিক কারণে তাদের দেশান্তরে গমন ও পাচার। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, সাস্কৃতিক বিনিময়ে উদ্দেশ্যে কর্মীদের দেশান্তরে গমন। আগে মনে করা হতো, অস্বাভাবিক যৌন আচরণের  মাধ্যেমেই কেবল এইডস ছড়ায়। আর এখন মনে করা হচ্ছে, উপর্যুক্ত কারণ ছাড়াও এইচআইভি-যুক্ত রক্তের আদান-প্রদান, একই ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বহু দেহে ব্যবহার ইত্যাদি কারণেও এইডস ছঢ়ায়। জাতিসংঘের দূত রিচার্ড হলব্্রুক আফ্রিকার অধিক মাত্রায় এইডস আক্রান্ত কটি অঞ্চল ভ্রমণশেষে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আফ্রিকার জন্য এখন জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন ওষুধ সরবরাহ করা এবং শিক্ষার ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পাশপাশি মানবিক উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই রোগের ব্যপকতা শুধু আফ্রিকার পক্ষেধারণ করা সম্ভব নয় এবং এ থেকে আফ্রিকার যে ক্ষতি তাও পরিমাপহীন। আমরা যদি এখন আফ্রিকার মানুষদের পাশে না দাঁড়াইও যদি রোগটা আরো ছড়িয়ে পরে তাহলে অনেক জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।জাতিসংঘের এ আহ্বানে আফ্রিকায় এইডসের চিকিৎসায় সহযোগিতা দিতে অনেক দেশ যেমন সাড়া দিয়েছে তেমনি অনেক ব্যক্তিও এগিয়ে এসেছেন তাদের সামর্থ্য নিয়ে। বিল গেটস তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি ইতিমধ্যেই ২৮ মিলিয়ন ডলার দান করেছেন। বিপুল চাহিদার তুলনায় এ অর্থ হতে পরে খুবই নগণ্য, তবু তাএকটা তহবিল গঠনে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে।



শিশুরা যেভাবে আক্রান্ত হয়

শিশুরা প্রধানত মাতৃগর্ভেই এইচআইভি-তে আক্রান্ত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আফ্রিকান শিশুদের এই ভয়বহ পরিণতির জন্য দায়ী তাদের পিতামাতাদের অবাধ ও অসংযত যৌনাচার। যারা মাতৃগর্ভে এই ভাইরাসের সংস্পর্শে যায় নি তারা পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে কিংবা ক্লিনিকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে। কখনো অজ্ঞতার কারণে বহু ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ব্যবহার করে, কখনো বা এইচআইভি-যুক্ত রক্ত নিজ শরীরে গ্রহণ করে। রিচর্ড হলব্রক এমনই কটি এতিমখানা পরিদর্শনকালে বলেছেন, এই পরিদর্শনে যে বাস্তবতা আমার সামনে উম্মোচিত হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। মানবতার এই যে করুণ পতন এর থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজতে হবে আমাদের সবার। না হলে তা সমগ্র বিশ্বের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এই যে এতিমখানার শিশুরা, রাস্তা ছাড়া যাদের দাঁড়াবার জায়গা নেই তাদের এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করবে কারা? মৃত্যুর আগে অন্তত একটু স্নেহ, একটু ভলোবাসা, দুফোঁটা ওষুধ পাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে।

সারণি-১

১৯৯৯সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এইডসে মৃত্যুর পরিমাণ

*উপ-সাহারা (আফ্রিকা)                                   ১৩,৭০০,০০০  জন

*উত্তর আমেরিকা                                            ৪৫০,০০০     জন                 

 *পশ্চিম ইউরোপ                                           ২১০,০০০      জন

* দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া                         ,১০০,০০০  জন

*পশ্চিম এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল     ৪০,০০০       জন

*উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্য                           ৭০,০০০        জন

*পশ্চিম ইউরোপ এবং কেন্দ্রীয় এশিয়া                  ১৭,০০০         জন

*ল্যাতিন আমেরিকা                                           ৫২০,০০০      জন

*ক্যারিবিয়ান অঞ্চল                                           ১৬০,০০০       জন

                                                       ........................

মোট ১৬৩মিলিয়ন জন

 

উগান্ডার শিশু পরিস্থিতি

বিশ্বে এইডস এতিমের সংখ্যা সর্বোচ্চ উগ ায়। কিছুদিন আগের একটি পরিসংখ্যানে এর সংখ্যা ছিল ১.১ মিলিয়ন। বর্তমানে এটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে যারা যৌবনে পা দিচ্ছে একটু বেয়াড়া টাইপের। আবার পরিত্যক্ত কিশোরী, যাদের পিতামাতা গৃহযুদ্ধ, এইডস কিংবা অন্য কোনো কারণে মারা গেছে, তারা অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আশ্রয় নিচ্ছে পতিতালয়ে। আর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছেলেরাও জড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে। রাকাই (জধশধর) জেলায় ১৫ বছর পর্যন্ত শিশুর মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত ৩২%। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় না এই অভিশপ্ত অবস্থা থেকে কেউ রক্ষা পাবে। বার্নাডেট নাকায়িমা (৭০) একজন মহিলা, বাস করেন উগা ার মাসাকা জেলায়। এই জেলার মোট ৩৪,২০০০ জন শিশুর মধ্যে ১১০,০০০ জন এতিম। নাকায়িমা তার এগার সন্তানের সবাইকে একে একে হারিয়েছেন। বর্তমানে তার নাতি-নাতনির সংখ্যা ৩৫। তিনি বলেন, চোখের জল ছাড়া কি আছে আমার? যুসেফাইন সোনোংগা (৫৯) এমনই আরেকজন মহিলা। রাকাই জেলায় একটি ফার্ম পরিচালনা করে তিনি তার জীবিকা নির্বাহ করেন। সেখানকার জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ গত ১৪ বছরে প্রতিহিংসার ছুরিতে বলি হয়ে গেছে। রাকাইয়ে মোট জনসংখ্যার ৩২% ১৫ বছরের নিচের শিশু, যারা সংখ্যায় ৭৫০০০ এখন এতিমখানার বাসিন্দা। সোনোংগার চার কন্যা ও নয় পুত্রের মধ্যে এগারোজন মারা গেছে। তার সন্তানদের মধ্যে যুসেফ আট সন্তান, ফ্রান্সিস চার সন্তান ও পিটার তিন সন্তান রেখে গেছে। একটি শিশুর পিতামাতা মরে যাওয়ার অর্থ হলো তার শৈশবে মৃত্যু। এইডসে ৯২ সালে যখন সানিয়্যু কাটালির মায়ের মৃত্যু হয় তখন তার বয়স ছিল ১০ বছর। আর একই রোগে ৮৬ সালে সে হারায় বাবাকে। ফলে তাকে আর তার ভাইকে চিরদিনের মতো বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হলো। এমনি আরও কত শিশুকে যে বিদ্যালয় ছেড়ে খাদ্যান্বেষণে পথে নামতে হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। জয়েস লুনিডিয়া, একটি এতিমখানার এডমিনিস্ট্রেটর, বলেন, এইডস রোগীদের দেখাশোনা করা খুবই কষ্টকর কাজ। আর তারা যদি শিশু হয় তাহলে কষ্ট আরও বেশি। কারণ, আমাদের জানাই থাকে তারা বাঁচবে না।



দক্ষিণ সাহারার দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ সাহারার জাতিসমূহে এইডসের কারণে মৃত্যু হয়েছে ২.২ মিলিয়ন মানুষের। সংখ্যায় এর চেয়েও অনেক বেশি মরেছে ১৯৯৯ সালে। এইডস মহামারীর রূপ নেয়ার পূর্বে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা জাতিগত যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষে সেখানকার ২% শিশু এতিম হয়েছিল। আর এইডস এটাকে এখন এক ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আগেই বলা হয়েছে ২০০০ সালের শেষের দিকে, ১৫ বছরের নিচের ১০.৪ মিলিয়ন শিশুকে পিতামাতা হারিয়ে এতিম খানায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। খনি শ্রমের সঙ্গে জড়িত, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে  যারা আছে পিতামাতা না থাকায় তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে না। তাছাড়া অনেক এইডস রোগী তাদের নিজেদের শেষ করে দিতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তারা তখন টার্গেট হয় প্রধানত বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত গ্যাংলিডার ও মিলিশিয়াদের। কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে তারা হাতে তুলে দেয় আগ্নেয়াস্ত্র। এরাই পরে পশ্চিম আফ্রিকায় ম্যাসাকারে অংশ নিয়ে থাকে। বলেছেন ইউএনএইড-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডঃ পিটার পিয়েট। তাঁর মতে, আরও দুঃসংবাদ বিশ্ববাসীর জন্য অপেক্ষা করেছে, তাহলো, ২০১০ সাল নাগাদ আফ্রিকায় এইডসে মৃতের সংখ্যা বর্তমানের দ্বিগুণ বা তিনগুণ হতে পারে।

            

সারণি-২

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এইডস আক্রান্ত বয়স্ক (১৫-৪৯) লোকের সংখ্যা

 আফ্রিকা অঞ্চল                             অন্যান্য দেশ

বতসোয়ানা             ২৫%             ব্রাজিল                  ০.৪৩%

কেনিয়া                  ১২%             কম্বোডিয়া               ২.৪০%

মালয়ি                    ১৫%             চীন                       ০.০৩%

মোজাম্বিক              ১৫%             ফ্রান্স                     ০.৩৭%

নামিবিয়া                ২০%             হাইতি                    ৫.১৭%

রুয়ান্ডা                   ১৩%             ভারত                    ০.৮২%

দঃ আফ্রিকা            ১৩%             মেক্সিকো                ০.৩৫%

জাম্বিয়া                  ১৯%             থাইল্যান্ড                 ২.২৩%

জিম্বাবুয়ে               ২৬%             যুক্তরাষ্ট্র                  ০.১৮%

যে রোগ জীবনের রঙ বদলে দেয়

আফ্রিকায় এইডস এত বিস্তৃত আকারে ছড়িয়ে পড়লো কেনো? এর জন্য কি কেউ দায়ী নয়? অবশ্যই এর জন্য দায়ী আফ্রিকার কৃঞ্চাঙ্গ শাষকগোষ্ঠী। কৃঞ্চাঙ্গরা যখন নেতৃত্ব দিয়েছে তারা এই রোগ প্রতিরোধের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। পশ্চিমা অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আফ্রিকার কৃঞ্চাঙ্গ শাষকগোষ্ঠীর মতোই দায়ী আফ্রিকান আমেরিকানরা। আমিরিকান কালো এলিটরা স্বদেশীদের রক্ষার জন্য কোনো সাহায্য বা পরামর্শ দেয়নি। কেউ কেউ আবার ভিন্নমত পোষণ করেনে। যেমন আফ্রিকায় আমেরিকান একটি সংস্থার প্রধান নির্বাহী রেন্ডাল রবিনসন বলেছেন, আমি মনে করি আফ্রিকান কৃঞ্চাঙ্গ নেতৃত্ব এ সমস্যার ব্যাপকতা অনুধাবনই করতে পারেনি। তারা জানতো না এর জন্য কী তাদের করণীয়।

এইডস এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

মানবজাতির জন্য সবচেয়ে হতাশার সংবাদ হলো চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের অতি আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এইডসের কোনো চিকিৎসা (পদ্ধতি ও ওষুধ) আবিস্কার হয়নি। তবে হ্যাঁ, আফ্রিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে রোগীর পরিচর্যার পাশাপাশি প্রকাশিত লক্ষনসমূহের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এতে রোগীর মৃত্যু কিছুটা হলেও বিলম্বিত হয়। তবে বেশিরভাগ চিকিৎসকের মতে, লক্ষ্যণভিত্তিক ওষুধ আর প্রচলিত চিকিৎসা দিয়ে এ ধরনের মহামারীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।                                          

প্রয়োজন প্রতিরোধ:

এইডস ছাড়াও আর কিছু যৌনবাহিত ঘাতক রোগ মানবতার বিরুদ্ধে নীরবে ষড়যন্ত্র করে চলছে। সচেতনতা বৃদ্ধিই এসব রোগ প্রতিরোধে একমাত্র উপায়। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই কেবল মানুষের যৌন আচরণ শোধরানো সম্ভব। এর জন্য সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের, বুদ্ধিজীবীদের। জোরদিতে হবে ধর্মীয় কর্মকাে র ওপর। ধর্মের বিধিনিষেধই পারে প্রথমিকভাবে এইডসের অভিশাপ থেকে মানুষকে দূরে রাখতে। কোনো কোনো দেশ ইতোমধ্যেই এইডস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আশাতীত সফলতা অর্জন করেছে। সেলেগাল তেমনি একটি দেশ। গত কবছরের প্রচেষ্টায় দেশটি মহামারীর পর্যায় থেকে এইচআইভি আক্রান্তের হার ২%-এ নামিয়ে এনেছে। এমনকি উগা াতেও ১৯৯০-এর তুলনায় এই হার এখন অনেক কম। তবে এটাও ঠিক যে, এই সাফল্য সহজেই অর্জিত হয়নি। সামান্য অসতর্কতার দরুন ফিরেও যেতে পারে পূর্বাবস্থায়। কাজেই গবেষকগণের পরামর্শ, গত দুই দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে এইডস প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ প্রতিটি দেশের গ্রহণ করা উচিত।                       

দরকার সকল প্রকার গোপনীয়তা বা লুকোচুরি পরিহার করা:

কোনো কোনো দেশে এইডস এখনো লুকোচুরির ব্যাপার। এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে। গণ-সচেনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকহারে প্রচারণা চালাতে হবে। দূর করতে হবে অশিক্ষা। জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া প্রভৃতি দেশের প্রেসিডেন্টগণ আগের মতো বসে নেই। তারা এইডসের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। বাতসোয়ানা, নামিবিয়া, সোয়াজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশ ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিসরে এইডস বিরোধী কার্যক্রম শুরু করেছে। এমন অবস্থায় যে সব দেশে এইডস মাত্র শুরু হয়েছে (যেমন, ভরাত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ), সেসব দেশের সরকারের গুরুত্ব সহকারে এইডস বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে এটা ব্যাপকভাবে সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশাঙ্কা রয়েছে।                             

** নিরাপদ যৌনকর্মের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

 

সারণি-৩

আফ্রিকার দেশসমূহে এইডস আক্রান্ত নয় এবং আক্রান্ত মানুষদের গড় আয়ুষ্কাল

আফ্রিকা অঞ্চল                   আক্রান্ত নয়                    আক্রান্ত

 বতসোয়ানা                         ৭০ বছর                       ৪১ বছর

কেনিয়া                              ৬৬ বছর                         ৪৮ বছর

 মালয়ি                              ৫৩ বছর                        ৪০ বছর

মোজাম্বিক                          ৫৩ বছর                        ৩৮ বছর

নামিবিয়া                            ৬৪ বছর                         ৪১ বছর

রুয়ান্ডা                               ৫১ বছর                         ৪১ বছর

দঃ আফ্রিকা                        ৬৪ বছর                         ৪৭ বছর

জাম্বিয়া                              ৬০ বছর                          ৪৭ বছর

জিম্বাবুয়ে                           ৬৬ বছর                          ৪১ বছর

                       

 

এইডস প্রতিরোধের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে গবেষকগণ গণ-সচেনতার পরেই জোর দিয়েছেন যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণের ওপর। অস্বাভাবিক যৌন আচরণ ছাড়াও আরও যে সব কর্মকাণ্ডে এইডস ছড়ায় সেগুলো পরিহার করতে হবে। যেমন পতিতালয়ে গমন, হোমোসেক্স। যারা পতিতালয়ে যাবে তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে সঠিক পদ্ধতিতে কনডম ব্যবহার করতে হবে।

** মহিলাদের টার্গেট করতে হবে।

বহুগামী পুরুষেরা মহিলাদের মাধ্যমেই এইডস ছড়ায়। কাজেই মহিলাদের কনডম ব্যবহারের বেশি উৎসাহী করে তুলতে হবে। উপযুক্ত কর্মীর মাধ্যমে তাদের কনডম ব্যবহারের প্রযোজনীয়তা বোঝাতে হবে। কনডম শুধু মহিলাদেরই এইডসের হাত থেকেই বাঁচায় না, অবৈধ গর্ভধারণ থেকেও বাঁচায়। যৌনবাহিত অন্যান্য রোগ যেমন গণোরিয়া, সিফিলিস, দূরারোগ্য চর্মরোগ থেকে বাঁচায়। এসব তাদের বোঝাতে হবে। পিতামাতারও উচিত সন্তানদের এইডস সম্পর্কে ধারণা দেয়া।     

 ** সাবধান হওয়ার এখনই সময়।

এইডস শুধু আফ্রিকার জন্য নয়, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্যই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় হুমকি। আবার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এইডস শুরু হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে এবং মহমারীর রূপ নেবে, যেমন নিয়েছে আফ্রিকায়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সাত মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। দিনদিন এই সংখ্যা বেড়েই চলছে। রাশিয়ায় গত পাঁচ বছরে এই সংখ্যা দ্বিগণের বেশি হয়েছে। ক্যারিবিয়ান ও ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলোতে আতঙ্কজনকভাবে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে এইচআইভি ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা ১৫০০০ হাজারের ওপরে নয়। কিন্তু বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার হিসাব ভিন্নরকম। সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এইচআইভি ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজার। প্রচারের অভাবে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই।

 (টাম ম্যাগাজিন থেকে বহু আগে অনুবাদ করেছিলাম, বাংলাবাজার পত্রিকা, পালাবদল, প্রকৃতি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। কখনও কারও কাজে লাগতে পারে ভেবে নেটে দিয়ে রাখলাম )



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন