রবিবার, ১ নভেম্বর, ২০২০

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প

 

গাজী সাফুল সলাম



  সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পগ্রন্থ ‘‘অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প’’। গল্পগ্রন্থটিতে রয়েছে ছোট-বড় মোট পনেরোটি গল্প। গল্পগুলো হলো অপরাহ্নের গল্প, বাক্স হাতে একজন, যে মানুষ আলো দেখেছিল, গণি মিয়ার পাথর, ফেরিঘাটের রান্নাবান্না, একটি প্রত্যাখ্যানের গল্প, পরিতোষের পায়ের তলার মাটি, অপেক্ষা, বাউল, বালথজারের গল্প, আবিষ্কার, বাহারুলের বাড়ি, রহস্য গল্প / গল্পরহস্য, শোক সভায় দেয়া ভাষণ, একটি হস্তরেখা পাঠকের জীবন ও সময়, শিরোনামহীন একটি ছোট্ট উপন্যাস। নানাকারণে কিংবা সত্য বলতে কিছু জটিলতা এড়াতে শেষ গল্প শিরোনামহীন একটি ছোট্ট উপন্যাসকে প্রথমেই বেছে নিচ্ছি আলোচনার জন্য। শুনুন দিয়ে শুরু পাঁচটি পর্বের এ গল্পটিতে কাহিনীর বিস্তার এবং শেষ দেখে মনে হ্যাঁ, সত্যি ছোট খাটো একটি উপন্যাস গল্পটিতে ঢুকেছে। কলারোয়া কলেজের একটি সংবাদ, মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে এসে স্কুল ছাত্রী লাঞ্ছিত। পদপিষ্ট হয়ে নিহত। কলরোয়ার এই বীভৎস ঘটনার নায়ক কারা তা সবাই জানে। গতকালের কাগজে একটি ফলোআপ বেরিয়ছে। ফলোআপটিতে বলা হয়েছে, একটি ছাত্র সংগঠনের এবং একটি কলেজ সংসদের প্রভাবশালী কিছু নেতা জড়িত এর সঙ্গে। এদের হাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব দিয়েছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ, কারণ তিন হাজারের বেশি প্রার্থী ছিল কেন্দ্রটিতে। হতভাগী মেয়েটার ওপর ঘটনার নায়কদের অথবা কোনো এক নায়কের আগে থেকেই নজর ছিল।  মেয়েটি সুন্দরী ছিল, পরীক্ষার পর তার এক স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আর বিয়ের পিঁড়িতে বসা হল না। ইহাই জীবন। মেয়েটি আক্রান্ত হলে একজন অচেনা মানুষের হাত চেপে ধরে শুধু বলেছিল, ভাই আমাকে ছেড়ে দেবেন না। তাহলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।

আসলে ওদেরই একজন মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের আশ্বাস দিয়ে। লেখক এ কথাটি বলেল নি। শুধু ইঙ্গিত দিয়েছেন। আর এ ইঙ্গিতের প্রকাশ ঘটেছে আঠারো বছর আগের আরেকটি কাহিনীতে।

তারা তিনজন, মুকতাবিস শামস, এম এ মান্নান এবং মালেক সাহেব কথা বলছিলেন, পত্রিকা পড়ছিলেন - মুকতাবিস শামস সাহেবের মুক্তা ডায়াগনেস্টিক সেন্টারের মুক্তা ল্যাবে বসে। তারা সবাই একই বয়সের। একই এলাকা অষ্টগ্রামের মানুষ। মান্নান ও মালেক সাহেব প্রায়ই ল্যাবে আসেন বার্ধক্যজনিত রোগের পরীক্ষা করাতে। এভাবেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা। পত্রিকায় কলারোয়ায় ছাত্রী মৃত্যর সংবাদটি পড়ে মালেক সাহেব বড় বেশি চঞ্চল হয়ে ওঠেন। যদিও কম বয়সী মুকতাবিস শামস সাহেব তাকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। মালেক সাহেবের অস্থিরতার কারণ মুকতাবিস সাহেবের জানা। আঠারো বছর আগে অষ্টগ্রামের একটি মেয়ে হারানোর গল্প তিনি আগেই মুকতাবিস শামস সাহেবকে বলেছিলেন। মুকতাবিস শামস সাহেব মনে করতেন হারিয়ে ওই মেয়েটি ছিল মালেক সাহেবের। লেখকের ভাষায় গল্পটির অংশ বিশেষ শোনা যাক। ‘‘অষ্টগ্রামে একসময় কৃষি ও শিল্পের মেলা হতো। আঠারো বছর তিন মাস দশদিন আগে একবার কে ভদ্রলোক তার কলেজে পড়া মেয়েকে নিয়ে মেলায় গিয়েছিলেন।... সার্কাস শেষ হলে বাবার হাত ধরে মেয়েটি বেরিয়ে এলো।  চোখে একটা বিস্ময়ের ঘোর।... তখনই ঘটল ঘটনাটা। কৃষি প্রদর্শনীর স্টল থেকে দুটি বিশাল ক্ষিপ্ত গরু বেরিয়ে দৌড় লাগিয়েছে সারা মেলায়।.. পেছনের জনজোয়ার আছড়ে পড়ল ভদ্রলোকের ওপর। মেয়েকে বুকের সঙ্গে আগলে রেখেও রক্ষা করতে পারলেন না তিনি। বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে মেয়েটি একটি প্রাণঘাতি চিৎকার দিয়েছিল। সেই চিৎকারটিই শুধু মনে আছে তার। ওই মেয়েটিই ছিল ভদ্রলোকের একমাত্র সন্তান। লেখক গল্পটি বলিয়েছিলেন মালেক সাহেবের কণ্ঠে। গল্প শেষ করে তিনি হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। মান্নান সাহেব বুঝতে পারছিলেন না মালেক সাহেব অষ্টগ্রামের একটা দুর্ঘটনাকে কলারোয়ার ঘটনার চেয়ে বেশি হৃদয় বিদারক কেন বলছেন?

আসলে ওই ঘটনার পেছনে ছিল অষ্টগ্রাম কলেজের ছাত্র সংসদের একজন নেতা। মান্নান সাহেব সব জানতেন না। লেখকের ভাষায়, ভিপির প্রথম চোখ পড়েছিল মেয়েটির ওপর। পেছনে পেছনে হাঁটছিল ভিপি। গরু দুটি তার উদ্দেশ্যকে কিছুটা সহজ করে দিয়েছিল। মেয়েটি বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে যে প্রাণঘাতী চিৎকার করেছিল সেটি  সে করেছিল ভিপির হাত তার তলপেট খামছে ধরেছিল বলে।

 লেখক গল্পের শেষদিকে ভিপির পরিচয় দিয়েছেন। তিনি গল্পের মুক্তা ল্যাবের মালিক এই মুকতাবিস শামস। কলেজে পড়া মেয়েটি সেদিনের ঘোর বিপদে পিতার হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারই হাত আঁকড়ে ধরেছিল। বলেছিল, ভাই আমাকে বাঁচান।

বইয়ের আরেকটি গল্প গণি মিয়ার পাথর। রমণী বিষয়ক জটিলতা কিংবা খুন খারাবির বাইরে এটি একটি ভিন্ন ধাঁচের গল্প। দুনম্বরি বুদ্ধির জোরে সমাজের কিছু অশিক্ষিত লোক ও অনেক সময় জ্ঞানী বুদ্ধিমান লোকদের টেক্কা দিয়ে তাদের চোখের সামনে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যায়। গনি মিয়ায় পাথর গল্পে এমনই একটা বিষয় খুবই চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। সৈযদ ওয়ালীউল্লার লাল সালু উপন্যাসেও এমনই ধর্ম ব্যবসার কথা বলা হয়েছে Ñ যা আজ উপমহাদেশের কথা সাহিত্যে সেরা উপন্যাসে মর্ষাদার আসনে আসীন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের এ গল্পে ঠিক পীরালি ব্যবসার কথা বলা হয় নি। এটা পীর এবং ফকিরি দুটোর মাঝখানের একটি প্রক্রিয়া। ধর্ম আশ্রিত কিছু একটা বিষয়ে অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শনের কথা প্রচার করে ব্যবসা করা। সিলেট তামাবিল সড়কের পাশে বসবাসকারী গনি মিয়া প্রচার করেছে প্রাচীন পাথরে খোদাই করা আরবি আয়াতের ওপর হাত বুলালে ভাগ্য বদলে যায়। আসলে ওই পাথরটি প্রাচীন হলেও এর ওপরের লেখাগুলো গণি মিয়ার নিজের উদ্ভাবিত। আর খোদাই করেছে ঢাকার বায়তুল মোকারামে জনৈক কারিগর। শুধু খোদাইয়ের কাজটি নিখুঁত শিল্পে পরিণত হওয়ায় লেখাটাকে প্রাচীন বলে মনে হয়। এটুকুুই গণি মিয়ার পুঁজি। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচুর মিথ্যাচার। এই ব্যবসার মাহাত্ম হলো যত প্রচার তত প্রসার এবং মুনাফা। গল্পের নায়ক মনজু অর্থাৎ লেখক স্বয়ং, গণি মিয়ার বন্ধু। বাল্যের সহপাঠী। বন্ধুত্ব আজও অটুট। কিন্তু দুজনের পথ সম্পুর্ণ ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত। একজন গ্রামে বসেই লোক ঠকানোর ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। লেখালেখিও করেন। স্ত্রী-সন্তানদের অনুরোধে গণি মিয়াকে ওই ধোঁকাবাজির পথ থেকে ফেরাতে চেষ্টা করেন কিন্তু পারেন না। বরং হার মানেন এবং এক সময় নিজের বিশ্বাসেও তিনি অটল থাকতে পারেন না।



বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় ধর্মাশ্রয়ী ব্যবসা অত্যন্ত জমজমাট। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আমলা থেকে মন্ত্রি পযর্ন্ত ওসব জায়গায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন অঢেল অর্থ আর উপহার সামগ্রি নিয়ে। কেউ আসে ভাগ্য বদলাতে, কেউ আসে রোগ মুক্ত হতে, কেউ আসে রাজনৈতিক ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হতে।

গল্পটির নামকরণ বেশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তবে লেখকের বর্ণনায় মুন্সীয়ানার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যেখানে অনেক বেশি সফল। প্রথম পুরুষে লেখা গল্পটিতে লেখকের একটি বড় দুর্বলতা হলো Ñ তিনি গল্পটিকে অধিক মাত্রায় সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে চেয়েছেন। ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুনকে গল্পে টানতে গিয়ে তিনি গল্পটাকে কতটা বিশ্বাসযোগ্য করেছেন জনকন্ঠের মামুন সাহেবের গণি মিয়ার পাথর নিয়ে লেখার তারিফটি উল্লেখ করতে গিয়ে। গল্পের শিল্পোর্ত্তীণ হওয়া আর রসোর্তীণ হওয়ার সঙ্গে তথ্যের নিরেট সত্যতার কোনো সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ গল্প সত্যভাষণ কিংবা ইতিহাস নয়।  

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জীবনমুখী লেখক। জীবনের জটিল বাস্তবতা চিত্রায়ণের প্রয়োজনে তিনি একে খুব কাছে থেকে দেখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বেদনা ও সুখের চুড়া তিনি স্পর্শ করতে পারেন না। তার গল্প পাঠককে আলোড়িত করে সত্য কিন্তু এ আলোড়নকালের স্থায়িত্ব কম।

 সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অন্ধকার ও আলো দেখার গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো পড়লে কতকগুলো সাধারন বৈশিষ্ট্য দাঁড় করানো যায়। যেমন:

বৈশিষ্ট্য-১॥ তাঁর গল্পের ভাষা কাটা কাটা অর্থাৎ খুব স্পষ্ট ধারালো। বর্ণনার ধরন জল প্রপাতের মতো মনে হয় ওপর থেকে সোজাসুজি হুড়মুড়িয়ে পড়ছে। পার্থক্য জলপ্রপাতের পড়া শেষ হয় না কিন্তু তাঁর গল্প শেষ হয়ে যায়। গল্পে উপ- গল্প , বাঁক কম। অতি কথন কদাচিৎ চোখে পড়ে। তবে নতুত্বের প্রতি লেখকের ঝোঁক থাকায় গল্পের বর্ণনায় কিছু কিছু শব্দ বাক্যাংশে ব্যবহার কখনো কখনো পাঠককে বিভ্রান্ত করে। যেমন শেষ গল্প , শিরোনামহীন একটি হেন উপন্যাস-এ শুনুন এবং ইহাই জীবন। পাঁচ পর্বের গল্পে ছবার শুনুন। পাঁচ বর ইহাই জীবন। কোনো গল্পের মাঝখানে যখন হঠাৎ ইহাই জীবন বাক্যাংটি আসে পাঠক অন্যমনস্ক হতে বাধ্য।

বৈশিষ্ট্য-২্ ॥ তাঁর কোনো গল্পেই তথাকথিত আধুনিক প্যাটান গল্প না থাকায় প্যাচাল এমনটি দেখা যায় না। বরং বলা যায় তাঁর গল্প গল্পে ঠাসা। পাঠককে বিমুখ হতে হয়না। তবে তথ্যের নামে পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যে তিনি প্রায়ই পাঠকের ওপর চাপিয়ে দেন। একই কারনে তাঁর ভাষায় গুরুগম্ভীর শব্দের বাহল্য দেখা যায়। যেমন প্রথম গল্প, অপরাহ্নের গল্প এ যাওয়া যাক। কিন্তু জগতে অবিমিশ্র ভালো বলে কিছু নেই। এই যে অবিমিশ্র শব্দটা ....। আবার আমাদের বাসের চালক একটু বেশি সতর্ক, নাকি বাসের স্বাস্থ্যটা উপদ্রুত..। এখানে এই উপদ্রুত শব্দটা।

বৈশিষ্ট্য- ৩ ॥ আধুনিক ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যের দারুণ প্রভাব তাঁর লেখায়, যাতে আবেগ কখনো ঘনিভুত হয় না। বা লেখক তা করতে পারেনি। রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলাতেও তিনি অপারগ। বা এর জন্য তার মধ্যে কোনো তাগিদ নেই। যা ছিল সেকালের বুক্কাসিও, মারিয়া ডি ফ্রান্স, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, বিভূতি ও নজরুলে কিংবা যা আছে একালের বিশ্ব সাহিত্যের আর কে নারায়ণ, মূলকরাজ আনন্দ ও মার্কেজে। হয়তো বা তিনি তাদের পদাঙ্ক একেবারই অনুস্মরণ করতে চান না।

বৈশিষ্ট্য-৪॥ সবচেয়ে পজেটিভ বৈশিষ্ট্যটি হলো লেখক তাঁর গল্পের প্রয়োজনে নানা স্থানে ঘুরে বেড়ান। অর্থাৎ গণ মানুষের কাছে যান। তাঁর গল্পগুলো পড়ে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে। এতে বানিয়ে গল্প বলতে হয় না। শুনেছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা স্বদেশ থেকে বিদেশ প্রচুর ঘোরেন গল্পের প্রয়োজনে। আমার ধারণা ঠিক হলে আমাদের সাহিত্যে নিশ্চয়ই এটি একটি ভালো নজির সৃষ্টি করবে।

 বইটির প্রকাশক

সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা।

মাসিক সাঁকো ছেপেছিল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন