(সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার)
অনুবাদ: গাজী সাফুল সলাম
সূচনা : এখানে এই চক্রপদীতে (Chakrapadi), আপনারা সম্ভবত দেখতে পাচ্ছেন,
নতুন জন্ম নেয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে
ফিরেছেন স্বাভাবিক কিংবা যতটুকু স্বাভাবিক থাকা সম্ভব ছিল। বিবেচনায় নিতে পারেন গত
কয়েক মাসের ঘটনাসমূহ। ঘটনাসমূহ ছিল এরকম : এই বাড়িগুলোতে কী ঘটেছিল। চারদিক থেকে ট্যাঙ্ক
ও সাজুয়া গাড়ি নিয়ে এসে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লোকেরা এলাকাটি ঘিরে ফেলেছিল।
সহজ কথায় বলা চলে, তারা ভয়ানক আতঙ্ককর একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল এবং এরপর একনাগারে
গুলি চালিয়েছিল শক্ত প্রতিরোধ শক্তিসম্পন্ন এলাকাটির ওপর। ফলাফল আমার চারপাশে দেখতে
পাচ্ছেন, এলাকাটির প্রতিরোধ ক্ষমতা স্থিমিত হয়ে এসেছিলÑহালকা মেশিনগানের এলোপাথারি গুলিবর্ষণে। এমন আতঙ্ককর পরিস্থিতিতে সৈনিকরা
প্রতিটি বাড়িতে প্রবেশ করেছিল বেঁচে থাকা লোকদের ধরে ছাদে উঠিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে
খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। অনেককেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল পেছনের রাস্তায়। ধারণা করা হয়, ওই
এক চক্রপদিতেই ওইদিন ১০,০০০ লোক নিহত হয়েছিল। এখন একটি নতুন জাতির জন্ম হয়েছে, এবং
শেখ মুজিবুর রহমান আপনি আজ এই জাতিটির প্রিয় নেতা, প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে কথা বলছেন।
এই হলো গত কয়েক মাসের রক্তক্ষরণের গল্পÑযার ফলোশ্র“তিতে
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। জয় বাংলা!
শেখ মুজিবুর রহমান |
ডেবিড ফ্রস্ট |
ওই রাতে আপনি বন্দি হলেন, ওই রাতে প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী
একদিকে আক্রমণ করতে প্রস্তুত অন্যদিকে আপনার সঙ্গে কথা বলছিল সম্ভবত আপনার জন্য বিরক্তিকর
কোনো বিষয়ে। এরপরই তারা হামলা করল, রাত ৮টা তখন বাজে, আপনি বাড়িতেই ছিলেন এবং গ্রেফতার
হলেন। এর আগে আপনাকে সতর্ক করা হয়েছিল, আমি বিশ্বাস করি আর্মিরা পথে নেমেই ফোনটা করেছিল।
আপনি কেন বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং গ্রেফতার হতে চাইলেন?
শেখ মুজিব : দেখুন, এ বিষয়ে খুবই দারুণ একটি গল্প আছে। ওই সন্ধ্যায়,
আমার বাড়ি ঘিরে রেখেছিল কমান্ডো বাহিনী। তারা আমাকে হত্যা করার জন্য ওৎপেতে ছিল। তারা
পরিকল্পনা করেছিল ঘরের বাইরে আসলেই গুলি চালাবে আর প্রচার করবে যে, মুজিবুর রহমান নিহত
হয়েছেন বাংলাদেশেরই চরমপন্থী কিছু লোকের হাতে। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নিল বিশ্বকে বলার
জন্য যে, আমরা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঐক্যমত্যে পৌঁছোনোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু চরমপন্থীরা
তাকে হত্যা করেছে। পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া ইয়াহিয়া
খানের বিকল্প উপায় ছিল না। ওটাই ছিল তাদের প্রাথমিক মনোবাঞ্ছা। আমি জানতাম তারা বর্বর,
অসভ্য। তারা আমার সব লোকদের হত্যা করবে। একটি নৃসংশ হত্যকাণ্ড তারা চালাবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মরে হলেও আমি আমার লোকদের বাঁচাব। তারা যে আমায়
প্রচণ্ড ভালোবাসে।
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনি সম্ভবত ইচ্ছে করলে কলকাতা চলে পারতেন।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি যে কোনো জায়গায় চলে যেতে পারতাম-যদি আমি ইচ্ছে
করতাম। কিন্তু কীভাবে আমি আমার মানুষদের ছেড়ে যেতে পারি? আমি জাতির নেতা। আমি যুদ্ধ
করতে পারি, মরতে পারি কিন্তু আমার লোকদের বলতে পারি নিজেদের সামলে রেখো।
ফ্রস্ট : অবশ্যই আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ গত নয় মাস লোকেরা
আপনার প্রতি তাদের বিশ্বাসের প্রমাণ দিয়েছে। তারা আপনাকে এখন প্রায় ঈশ্বর মনে করে।
শেখ মুজিব : আমি এ কথা বলি না, আমি বলি যে তারা আমাকে ভালোবাসে। আমিও
তাদের ভালোবাসি এবং তাদের জীবন আমি রক্ষা করতে চাই। কিন্তু ওই হারামিরা আমাকে গ্রেফতার
করেছে, তারা আমার বাড়ি ভেঙে দিয়েছে, আমার গ্রামের বাড়িতে আগুন দিয়েছে। ওখানে আমার বৃদ্ধ
পিতা-মাতা থাকতেন। আমার বাবার বয়স ৯০ বছর, মায়ের বয়স ৮০ বছর। তারা আমার গ্রামের বাড়িতে
বসবাস করছিলেন। শেখ মুজিবাধিকার সূত্রে পাওয়া গ্রামের অভ্যন্তরে আমার বাড়ি। তারা সেখানে
মিলিটারি পাঠিয়েছে। আমার পিতামাতাকে ঘর থেকে বের করে তাদের সামনেই তাতে আগুন দিয়েছে।
সুতরাং তারা এখন আশ্রয়হীন। এভাবেই তারা সবকিছু জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে
পেলে তারা অন্ততপক্ষে আমার সাধারণ দুর্ভাগা মানুষদের হত্যা করবে না। কিন্তু আমি এটা
জানি, আমার দল যথেষ্ট শক্তিশালী। আমি যে দলটি গড়ে তুলেছি এবং এর পেছনে যারা আছে তারা
শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতিটি বিন্দুর জন্য তোমরা লড়ো। আমি তাদের
বলেছিলাম, এটাই আমার শেষ নির্দেশ, যতদিন না শৃঙ্খল মুক্ত না হবে, যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
ফ্রস্ট : কী প্রক্রিয়ায় তারা
আপনাকে গ্রেফতার করল? তখন রাত ১.৩০, তাই না? কী ঘটেছিল?
শেখ মুুুজিব : তারা প্রথমে
আমার বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি ছঁড়ল।
ফ্রস্ট : তারা যখন সেখানে পৌঁছল আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
শেখ মুজিব : আমি আমার শোবার ঘরে বসেছিলাম। ওটা আমার শোবার ঘর। ওপাশ
থেকে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ছিল। এ পাশেও কিছু মেশিনগান থেকে গুলি আসছিল। আর ওপাশের আক্রমণে
জানালাগুলো ভেঙে পড়ছিল।
ফ্রস্ট : সবকিছু কি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?
শেখ মুজিব : সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি ছিলাম আমার পরিারের সঙ্গে।
গুলি এসে শোবার ঘরে পড়ছিল। আমার ছয় বছরের সন্তান তখন বিছানায় ঘুমোচ্ছিল। আমার স্ত্রীও
সেখানে ছিলেন দু’সন্তান নিয়ে।
ফ্রস্ট : সেনাবাহিনী কোন পথে ঘরে প্রবেশ করেছিল?
শেখ মুজিব : সবদিক দিয়ে এবং তারা জানালা দিয়ে গুলি ছুঁড়ছিল। আমি তখন
আমার স্ত্রীকে বললাম, দু’সন্তান নিয়ে ঘরে থাকার জন্য। আমি আমার স্ত্রীকে রেখে বেরিয়ে
এলাম।
ফ্রস্ট : তিনি তখন কী বললেন?
শেখ মুজিব : একটি কথাও না। আমি তাকে চুমু খেলাম, বিদায় চুমু। দরজা খুলে
বেরিয়ে এলাম এবং তাদের বললাম গুলি বন্ধ করার জন্য। আমি বললাম, ‘‘গুলি বন্ধ করো, আমি
এখানে। কেন তোমরা গুলি ছুঁড়ছ? কেন?’’ তারা তখন চারপাশ থেকে বেগে আমার দিকে ছুটে আসছে।
সবার সঙ্গে বেয়োনেট, তারা তা দিয়ে আমাকে চার্জ করতে উদ্যত। একজন অফিসার ওখানে ছিলেন।
তিনি আমায় ধরে তাদের থামালেন। বললেন, ‘‘একে হত্যা করো না।’’
ফ্রস্ট : মাত্র একজন অফিসার তাদের থামালেন?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, তারা আমাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চলল। কেউ কেউ পিঠে,
পায়ে আঘাত করছিল। কেউ কেউ শরীরের এখানে সেখানে তাদের অস্ত্র ঠেকিয়ে ঠেলে দিচ্ছিল। অফিসারটি
তখনো আমাকে ধরে আছেন। এরপরও তারা আমাকে ধাক্কা মারছিল এবং হেঁচড়াচ্ছিল। ‘‘ আমাকে টানা
হেঁচড়া করো না।’’ আমি বললাম। এরপর বললাম, ‘‘অপেক্ষা করো, আমার পাইপ আর তামাক আনতে দাও।
অথবা আমার স্ত্রীর কাছ থেকে তোমরা নিজেরাই নিয়ে এসো। পাইপটা আমার প্রয়োজন।’’
আমি আবার ঘরে ফিরে এলাম এবং দেখলাম, আমার স্ত্রী দু’সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে
আছেন। তারা পাইপটা আর ছোট্ট স্যুটকেসটা নিয়ে এসেছে। আমি চললাম তাদের সঙ্গে। চারপাশের
সবকিছুতে তখন আগুন জ্বলছে। এভাবেই তারা আমাকে ওখান থেকে নিয়ে এলো।
ফ্রস্ট : আপনি ছেড়ে এলেন আপনার বাড়ি, ধানমন্ডি ৩২, কখনো কি ভেবেছিলেন
আবার তা দেখতে পাবেন?
শেখ মুজিব : আমি ভাবিনি। মনে হয়েছিল এই শেষ। কিন্তু যদি মরি নেতা হিসেবে
মাথা উঁচু রেখে মরব। অন্ততপক্ষে আমার জন্য আমার দেশবাসী লজ্জিত হবে না; কিন্তু যদি
আমি তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করি তাহলে আমার জাতি, আমার দেশের মানুষ বিশ্বের কাছে মুখ
দেখাতে পারবে না। আমি বরং মরব আমার জনগণের সম্মান রক্ষা করার জন্য।
ফ্রস্ট : একবার আপনি বলেছিলেন, ‘‘তুমি সে লোকটিকে মারতে পারো না যে
মরার জন্য প্রস্তুত।’’ আপনি তাই বলেছিলেন?
শেখ মুজিব : আমি তাদের বলেছিলাম যে, সেই মানুষ যে মরার প্রস্তুত-কেউ তাকে মারতে পারে
না। শারীরিকভাবে একজন মানুষকে আপনি হত্যা করতে পারেন-কিন্তু মানুষের আত্মাকে কি হত্যা
করতে পারেন? পারেন না-এটাই আমার বিশ্বাস। আমি একজন মুসলমান এবং মুসলমান জীবনে একবার মরে,
দু’বার না। আমি একজন মানুষ। মানবতাকে আমি ভালোবাসি। আমি এই জাতির নেতা, আমার লোকেরা
আমাকে ভালোবাসে আমিও তাদের ভালোবাসি। তাদের কাছে এখন আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। তারা
আমার জন্য সবকিছু দিয়েছে কারণ আমি তাদের জন্য সবকিছু দিতে প্রস্তুত ছিলাম। আমি তাদের
মুক্ত করতে চেয়েছিলাম। মরতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। আমি তাদের সুখী দেখতে চেয়েছিলাম।
আমার দেশের মানুষ আমাকে যে ভালোবাসা আর স্নেহ দিয়েছে মনে হলে আমি ভীষণ আবেগাক্রান্ত
হয়ে পড়ি।
ফ্রস্ট : পাকিস্তানিরা কি আপনার ঘরের সবকিছু লুট করেছিল?
শেখ মুজিব : আমার ঘরের সবকিছু, এমনকি বিছনাপত্র, আলমারি, কাপড়চোপড় সবকিছু।
কিছুই তারা রেখে যায়নি। কিছুই আপনি দেখতে পাবেন না।
ফ্রস্ট : বিল্ডিং মেরামতকারীরা কিছুই নেয়নি, নিয়েছে পাকিস্তানিরা?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারা আমার আলামরি, আসবাবপত্র,
পোশাক, বাচ্চাদের পোশাক নিয়েছে বলে আমি মনে কিছু করিনি। মনে করেছি এ জন্য যে, তারা আমার জীবন ইতিহাস নিয়ে গেছে। গত ৩৫ বছর ধরে
আমি ডায়েরি লিখছি আমার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে। আমার একটি বিস্ময়কর লাইব্রেরি ছিল। তারা
আমার প্রতিটি বই ও গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র নিয়ে গেছে। প্রতিটি জিনিস পাকিস্তান সেনাবাহিনী
নিয়ে গেছে।
ফ্রস্ট : আবারও প্রশ্ন আসছে, প্রশ্ন জাগছে, কেন তারা সবকিছু নিয়ে গেছে?
শেখ মুজিব : আমি জানি না। তারা আসলে মানুষ না। তারা দুষ্কৃতিকারী। তারা
উগ্রপন্থী, অমানুষ, অসভ্য সৃষ্টি। আপনি আমার সম্পর্কিত সবকথা ভুলে যান। নিজের বিষয়ে
আমি কিছু মনে করি না। ভাবুন, তারা দু’বছরের শিশুকে হত্যা করেছে। পাঁচ বছরের শিশুকে
হত্যা করেছে। গ্রামের মহিলাকে। তারা তাদের গরীব হালতে তৈরি করা মাথাগুঁজার ঠাঁইগুলো
পুড়িয়ে দিয়েছে। ওইসব কুঁড়ে ঘরে বসত করা চরম ক্ষুধার্ত লোকদেরও তারা হত্যা করেছে। তারা
তাদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে এরপর পুড়িয়ে দিয়েছে। এখনো বসবাসের অনুপযুক্ত ওগুলো।
তারা চারপাশ থেকে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন তারা তাদের জোর করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।
এরপর তারা যখন মুক্ত জায়গায় সমবেত হয়েছে-তারা তখন গুলি করেছে?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, গুলি করেছে।
ফ্রস্ট : তারা জানত না কাদের তারা হত্যা করছে ?
শেখ মুজিব : না।
ফ্রস্ট : তারা যাকে ইচ্ছে তাকে হত্যা করেছে?
শেখ মুজিব : যাকে ইচ্ছে তাকে। তাদের ধারণা ছিল এরা প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের
অনুসারী। সুতরাং প্রত্যেককেই হত্যা করা উচিত।
ফ্রস্ট : আপনি যখন দেখলেন মানুষ মানুষের প্রতি এমন আচরণ
করছে, তখন আপনার কি এমন মনে হয়েছিল যে, মানুষ মূলত ভালো কিংবা এমন অনুভূতির সৃষ্টি
হয়েছিল যে, মানুষ মূলতই খারাপ?
শেখ মুজিব : ভালো-মন্দ সর্বত্রই রয়েছে। মানবিক গুণাবলির অধিকারী অনেক
মানুষ আমি দেখেছি। কিন্তু আমার মনে হয় পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা মানুষ নয়। পশুরও অধম তারা। মানুষের মধ্যে পশুর গুণাবলি থাকতে
পারে কিন্তু তারা পশুর চেয়ে খারাপ হতে পারে না। কিন্তু ওই লোকগুলো পশুর চেয়েও খারাপ।
একটি পশু একজন মানুষকে আক্রমণ করে হত্যা করার জন্য কিন্তু তারা ধরেছে নিপীড়ন করার জন্য।
তারা ৫ দিন, ৭দিন, ১৫দিন ধরে নিষ্ঠুর নিপীড়ন চালিয়েছে। এরপর হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : পাকিস্তানের জেলে আপনার বিচার সম্পর্কে বলুন।
শেখ মুজিব : তারা পাঁচজন সামরিক অফিসার ও কতক বেসামরিক অফিসারের সমন্বয়ে
একটি কোর্ট মার্শাল বসিয়েছিল।
ফ্রস্ট : তারা আপনার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ উত্থাপন করেছিল?
শেখ মুজিব : রাষ্ট্রদ্রোহীতা, পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে
যুদ্ধ। বাংলাকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র ইত্যাদি আরও কত কী! বারোটি অভিযোগের মধ্যে ছ’টিরই
শাস্তি ছিল ঝুঁলিয়ে ফাঁসি।
ফ্রস্ট : আপনার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিল না?
শেখ মুজিব : শুরুতে আমার একজন
আইনজীবী ছিল। সরকারই তাকে নিয়োগ করেছিল। কিন্তু চারপাশের পরিস্থিতি এবং আমার অবস্থান
যখন বিবেচনা করলাম মনে হলো, এটা তো লোক দেখানো বিচার, বিচারের নামে প্রহসন। এতে যুক্তিতর্কের
কী মূল্য আছে? দাঁড়িয়ে বললাম, জনাব বিচারপতি, আমার পক্ষ সমর্থনকারী আইনজীবীকে চলে যেতে
বলুন। কারণ আপনি জানেন এটা গোপন বিচার। আমি একজন বেসমারিক লোক। আমি সামরিক বাহিনীর
কেউ নই, এরপরও তারা আমার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল বসিয়েছে। মি. ইয়াহিয়া খান শুধু প্রেসিডেন্টই
নন-চিপ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরও।
এই আদালতের প্রধান তিনি রায়ও তার নির্দেশেই হবে।
ফ্রস্ট : সুতরাং শেষমেশ যে কোনো সিদ্ধান্ত তিনি চাপিয়ে দিতে পারতেন?
শেখ মুজিব : যে কোনো সিদ্ধান্ত তিনি দিতে পারতেন।
ফ্রস্ট : আপনি কি আদালতে যাচ্ছিলেন
নাকি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, যেতে হচ্ছিল, কারণ আমি একজন বন্দি।
ফ্রস্ট : আমার ধারণা কোনো ব্যাপারে কিছু বলার যথেষ্ট স্বাধীনতা আপনার
ছিল না। তারা কি সরকারিভাবে কোনো রায় প্রস্তুত করেছিল?
শেখ মুজিব : কোর্টের কাজ শেষ
হলো ৪ ডিসেম্বর (১৯৭১), তৎক্ষণাৎ ইয়াহিয়া খান সকল বিচারক অর্থাৎ কর্নেল, ব্রিগেডিয়ারদের
রাওয়ালপিণ্ডিতে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দিলেন-রায় প্রস্তুত করার জন্য। ওখানে সিদ্ধান্ত হলো-আমাকে ফাঁসিতে ঝুলাবে।
ফ্রস্ট : এবং এ হেন পরিস্থিতিতে, আমার বিশ্বাস যে আপনি আবিষ্কার করলেন
তারা আপনার বন্দিখানার পাশেই কবর খুঁড়ছে।
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, ঠিক আমার কয়েদখানার পাশেই তারা একটি কবর খুঁড়ল।
আমি তা দেখেছিলাম।
ফ্রস্ট : আপনি বুঝতে পেরেছিলেন তারা কবর খুঁড়ছে?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, নিজের চোখে তা দেখেছি এবং আমি নিজেকে বলেছিলাম,
‘‘ এ কবর সম্ভবত আমারই জন্য খোঁড়া হচ্ছে, ঠিক আছে. আমি প্রস্তুত।
ফ্রস্ট : তারা কি বলেছিল-এটা আপনার কবর?’’
শেখ মুজিব : না, তারা তা বলেনি।
ফ্রস্ট : তারা কী বলেছিল?
শেখ মুজিব : তারা বলেছিল, ‘‘না, না, না, না। আমরা একটা ব্যবস্থা করে
রাখছি যদি বোমা পড়ে আপনি তাতে আশ্রয় নিতে পারবেন।’’
ফ্রস্ট : ঠিক ওই মুহূর্তে আপনার কী মনে হয়েছিল? আপনার কি মনে হয়েছিল-গত নয় মাস ধরেই আমি
মৃত্যুর কাছাকাছি আছি?
শেখ মুজিব : আমি জানতাম, নয় মাসের যে কোনোদিন তারা আমাকে মেরে ফেলতে
পারত। কারণ তারা অসভ্য।
ফ্রস্ট : ওই সময়টার মোকাবেলা আপনি কীভাবে করেছেন? প্রার্থনা করে?
শেখ মুজিব : দৃঢ় বিশ্বাস আর অটল নীতির দ্বারা আমি ওই দুঃসময়ের মোকাবেলা
করতে পেরেছি। আমি জানতাম, ৭৫ মিলিয়ন মানুষ আমাকে ভালোবাসে, তাদের ভাইয়ের মতো, বাবার
মতো। তাদের ভালোবাসার নেতা আমি।
ফ্রস্ট : এবং আপনি যখন দেখলেন তারা আপনার কয়েদখানার পাশে করব খুঁড়ছে
নিশ্চয়ই আপনার মনে হয়েছিল-সবকিছু পেছনে ফেলে আপনি চলে যাচ্ছেন। আপনি কি আপনার দেশের কথা ভাবছিলেন?
নাকি, উদাহরণস্বরূপ, আপনার স্ত্রী এবং সন্তানদের কথা ভাবছিলেন?
শেখ মুজিব : প্রথমেই আমি আমার দেশের কথা ভেবেছি, জনগণের কথা ভেবেছি।
পরে ভেবেছিল পরিবারের কথা। আমি আমার মানুষদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আমার উদ্বেগ শুধু
তাদের জন্যই। আপনি জানেন তারা আমাকে কতটা ভালোবাসে।
শেখ মুজিব: একজন নেতা হিসেবে, যেমন আপনি বাংলাদেশের নেতা, দেশটির স্বাধীনতার
জন্য যুদ্ধ করেছেন, আপনার উচিত প্রথমে দেশের মানুষের কথা ভাবা, পরে পরিবার এটাই তো
স্বাভাবিক।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, প্রথমেই আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি। আমি জানি, মানুষ
একদিন থাকবে না, আজ, কাল না হোক পরশু। সুতরাং প্রতিটি মানুষেরই উচিত বীরত্বের সঙ্গে
মরা।
ফ্রস্ট : এবং কে আপনাকে ওই কবরে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছিল?
শেখ মুজিব: আমি মনে করি, আল্লাহ, সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছিলেন।
ফ্রস্ট : কোথাও পড়েছি, কোন এক পর্যায়ে জেলার সাহেব আপনাকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।
কখন? ইয়াহিয়া যখন এসেছিল আপনাকে নিয়ে হত্যা করার জন্য?
শেখ মুজিব: তারা জেলের মধ্যে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল এবং কিছু
কয়েদীকে জড়ো করেছিল সকালের দিকে আমার ওপর হামলা চালানোর জন্য, যাতে আমাকে মেরে ফেলতে
পারে। যে অফিসারের দায়িত্বে আমি ছিলাম তিনি সম্ভবত আমাকে কিছুটা পছন্দ করতেন। আমি মনে
করি, তিনি হয়তো জানতেন, ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে এসেছে। রাত ৩ টার দিকে তিনি আমাকে
জেল থেকে তার বাংলোতে নিয়ে গেলেন। দু’দিন ওখানে থাকলাম মিলিটারি পাহারা ছাড়া। দু’দিন
পর তিনি আমাকে কলোনির ভেতর আরেকটি নির্জন জায়গায় নিয়ে গেলেন। ওখানে তিনি আমাকে চার,
পাঁচ অথবা ছয়দিন রাখলেন। নিম্নপদস্থ কিছু কর্মচারি ছাড়া কেউ জানতো না আমার অবস্থান।
ফ্রস্ট : পরে তাদের কী হয়েছে সেটাই ভাবছি।
শেখ মুজিব: জানি না। ভাবতে চাই না-তারা তাদের সঙ্গে যা ইচ্ছে করেছে? কিন্তুতাদের জন্য আমার
শুভ কামনা আছে।
ফ্রস্ট : শুনেছি ইয়াহিয়া খান যখন মি. ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
করল-তখনো আপনাকে ফাঁসি
দিতে বলল, সত্য কি?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, খুবই সত্য কথা। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে মজার গল্পটি
হলো: মি. ভুট্টোই পরে আমাকে বলিছিলেন, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করার সময় তাকে
বলেছিলেন, ‘‘শেখ মুজিবুর রহমাকে ফাঁসিতে না ঝুঁলিয়ে আমি সবচেয়ে বড় ভুল করেছি।’’
ফ্রস্ট : তিনি তা বলেছিলেন?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে আমার
একটা অনুরোধ, দয়া করে রাখবেন। পেছনের একটি তারিখ দিয়ে মুজিবুর রহামানকে ফাঁসি দেবেন।’’
কিন্তু ভুট্টো তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
ফ্রস্ট : ভুট্টো কী বলেছিল-আপনাকে জানিয়েছিল?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ।
ফ্রস্ট : কী বলেছিল?
শেখ মুজিব: ভুট্টো বলেছিল যে,
আমি পারব না কারণ এখন এটা করলে ভীষণ প্রতিক্রিয়া হবে। সামরিক বাহিনীর এক লাখ
বিশ হাজার এবং বে-সামরিক লোক এখন বাংলাদেশে বন্দি, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর হাতে
এবং পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি সেখানে বাংলাদেশে রয়েছে। এ মুহূর্তে মুজিবকে হত্যা করলে
বাংলাদেশ থেকে একটা লোকও পশ্চিম পাকিস্তানে জীবীত ফিরবে না। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে
মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। আমার জন্য তা হবে ভয়াবহ।’’ মি. ভুট্টোর কাছে আমি এ
জন্য কৃতজ্ঞ-এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
ফ্রস্ট : আজ যদি ইয়াহিয়াকে আপনি সামনে পেতেন-কী বলতেন?
শেখ মুজিব: সে একটি জঘন্য লোক, আমি তার ছবিও দেখতে চাই না। সে তার সৈনিকদের
দিয়ে আমার ৩ মিলিয়ন (৩০ লাখ) বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : মি. ভুট্টো তাকে গৃহবন্দি করেছে, ভুট্টো তাকে কী করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
শেখ মুজিব: আপনি জানেন বাংলা দেশে কী ঘটেছে? আমি বলছি শুনুন, তিন মিলিয়ন
লোক শহীদ হয়েছে, তাদের মধ্যে শিশু, মহিলা, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র রয়েছে।
কমপক্ষে ২৫% থেকে ৩০% ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, লুট হয়েছে সবকিছু। সকল খাদ্যগুদাম ধ্বংস
হয়েছে।
ফ্রস্ট : আপনি কী করে জানেন যে সংখ্যাটা সর্বোচ্চ ৩ মিলিয়ন?
শেখ মুজিব: আমার দেশে ফেরার আগেই আমার লোকেরা তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু
করেছিল। সকল অঞ্চল থেকে যেখানে যেখানে আমাদের ঘাঁটি ছিল, আমি খবর পেয়েছি। আমরা এখনো
উপসংহারে পৌঁছিনি, এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, তো তিন মিলিয়নের কম তো হবেই না।
ফ্রস্ট : এবং নিরর্থক এ হত্যাকাণ্ড ? তারা লোকদের ঘর থেকে টেনে বের করেছে
আর....
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, ওরা আসলে নিজেদের গ্রামে বসবাস করা শান্তিপ্রিয়
নিরীহ মানুষ। তারা দুনিয়ার কোন খোঁজ রাখত না। সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা সেখানে গেল আর
গুলি ছুঁড়তে শুরু করল যেন পাখি মারছে।
ফ্রস্ট : কেন, কেন, কেন?
শেখ মুজিব : আমি জানি না। বুঝতে পারি না। পৃথিবীর কোথাও এমনটি আর কখনো
ঘটেনি। বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির পাওয়া যাবে না।
ফ্রস্ট : এবং ওটা ছিল মুসলমানদের মুসলমান হত্যা?
শেখ মুজিব : তারা মুসলিম দাবি করে। মুসলমান কীভাবে মুসলাম মেয়েদের হত্যা
করে? আমরা হাজার হাজার মেয়েকে উদ্ধার করেছি। তাদের অনেকেই এখনো আমাদের ছাউনিগুলোতে
রয়েছে। তাদের স্বামীকে, পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। পিতা-মাতার সামনে তারা মেয়েকে ধর্ষণ
করেছে। পুত্র সন্তানের সামনে তারা মাকে ধর্ষণ করেছে। আপনি এমনটি কল্পনাও করতে পারবেন
না। আমি আমার চোখের পারি ধরে রাখতে পারছি না। এমন লোকেরা কেমন করে নিজেদের মুসলমান
দাবি করে? তারা পশুরও অধম। আমার একজন বন্ধু ছিলেন, আমার দলের উচ্চ সারির নেতা, মি.
মশিউর রহমান (তিনি খোলাখুলি কাঁদছেন)। তিনি বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রি। তারা তার
ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন চালাল এরপর হত্যা করল। ২৪ দিন ধরে অকথ্য নিপীড়ন চালাল, প্রথমে একটা
হাত কেটে ফেলল। এরপর বাঁ পা, এরপর দু’টি কান এরপর পা...এভাবে ২৪ দিন। আহ্, মানুষ কত
অসহায়! আমি শুধু আপনাকে একটা ঘটনা বলেছি। অনেক
নেতা, কর্মী, বুদ্ধিজীবী, সরকারের কর্মকতাকে তারা ধরে নিয়ে নিপীড়ন করে হত্যা করেছে।
৭ দিন, ১০ দিন ধরে অত্যাচার চালিয়েছে এরপর হত্যা করেছে। ইতিহাসে এমন অমানবিক নিপীড়নের
কথা শোনা যায় না। এমনকি পশু, এমনকি বাঘও মানুষকে হত্যা করে কিন্তু এমন অত্যাচার করে
না।
ফ্রস্ট : এবং এভাবে তারা কী অর্জন করতে চেয়েছিল?
শেখ মুজিব: তারা এ দেশকে উপনিবেশ বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল। আপনি জানেন,
তারা আমার পুলিশ বাহিনীকে হত্যা করেছে, বাঙালি পুলিশ, বাঙালি সৈনিক, বাঙালি অধ্যাপক,
শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, যুকব ছাত্র-জনতা। সকল পেশার লোকদের তারা হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : এমনকি যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালেও তারা এখানে, এই ঢাকায়
১৩০ জন বুদ্ধিজীবীকে ঘর থেকে তুলে এনে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিব: আত্মসমর্পণের ঠিক একদিন আগে। এবং শুধু ঢাকায়। তারা বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০০জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা
করেছে, ১৩০ জন নয়। তাদের হত্যা করেছে নিজেদের ঘরে। আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা আমি আপনাকে
বলব, তারা কারফিউ জারি করেছিল যাতে লোকেরা ঘর থেকে বের হতে না পারে। এরপর ঘরে ঘরে হানা
দিয়ে তাদের হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : কারফিউ দিয়েছিল যাতে লোকেরা জানতে না পারে কী ঘটছে?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ।
ফ্রস্ট : আপনি কি মনে করেন ইয়াহিয়া খান একটা শয়তান ছিল যে অন্যের প্ররোচনাতে
এমনটি করেছিল? নাকি ব্যক্তি ইয়াহিয়াই ছিল একটা শয়তান।
শেখ মুজিব: সে নিজেই ছিল একটা শয়তান। তারই সহকর্মীরাই এসব কথা জানিয়েছে।
আপনি অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারেন না। কারণ সে নিজেই ছিল ভ , ভয়ানক চরিত্রের মানুষ।
তার প্রেসডেন্ট থাকাকালে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নেতা হিসেবে তার সঙ্গে যখন আমার আলাপ
হয়েছিল তখনই বুঝেছিলাম।
ফ্রস্ট : তিনি আপনাকে বিভ্রান্ত করেছিলেন? তাই না?
শেখ মুজিব: না, সে আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম
সে কি করতে যাচ্ছে। আমি তাকে আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এবং এখন সে আঘাতের মুখোমুখি।
ফ্রস্ট : কী প্রস্তুতি?
শেখ মুজিব: পেছন থেকে আঘাত করা। এবং সে আঘাত সে পেয়েছে।
ফ্রস্ট : পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকাকালে আপনি কখনো তাকে দেখেছিলেন?
শেখ মুজিব: না। সে তো মানুষ না।
ফ্রস্ট : এখন কী মনে করেন মি. ভুট্টোর জন্য সঠিক কাজ কোনটি?
শেখ মুজিব: তাকে বিচারের মুখোমুখি করা, একটি উন্মুক্ত বিচার তার হোক
আমি চাই।
ফ্রস্ট : তিনি এখন গৃহবন্দি। আপনি কি মনে করেন মি. ভুট্টো তাকে বিচারের
মুখোমুখি করবে?
শেখ মুজিব: মনে হয় করবে।
ফ্রস্ট : মি. ভুট্টোর ব্যাপারে আপনি ভাবেন? আপনি কি মনে করেন, পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসেিডন্ট হিসেবে তিনি একদিন মুক্ত ঢাকায় আসবেন? আসবেন কি কখনো
কথা বলার জন্য?
শেখ মুজিব: জানি না। আপনি বরং তাকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে দিন যে,
বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন দেশ। এটি এখন তাদের অঙ্গরাজ্য বা উপনিবেশ নয়। এ নিয়ে আর
কোনো উচ্চবাচ্য চলবে না। সকল বাস্তবতা নিরিখেই বলছি, তারা যদি এক পাকিস্তান দাবি করে
তাহলে আপনি জেনে রাখুন পশ্চিম পাকিস্তানসহ নিজেকে আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দাবী
করতে পারি, যেহেতু সেটি পাকিস্তানেরই অংশ এবং আমি নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছি।
অবশ্য যদি তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে আমি একটি সম্মেলন আহ্বান করতে পারি সমগ্র অঞ্চলকে বাংলাদেশ ঘোষণা দেয়ার জন্য। এবং এ কথা বলার
জন্য যে পশ্চিম পাকিস্তান আমার অঙ্গরাজ্য।
আপনি মি. ভুট্টো, দূর হয়ে যান। আমি গভর্নর নিয়োগ করছি। এটা আমার অঙ্গরাজ্য। আপনি দূর
হন, নাহলে আমি মিত্রবাহিনীর সঙ্গে আমার সেনাবাহিনী পাঠাব পশ্চিম পাকিস্তান দখল করার
জন্য। কিন্তু এমন গো গোল আমি চাই না। কোনো অঙ্গরাজ্যের উচ্চাকাক্সক্ষা আমার নেই। পশ্চিম
পাকিস্তান নিয়ে ভট্টো সুখী হোক। আমি সুখী হতে আমার বাংলাদেশি জনগণ নিয়ে। বাংলাদেশ এখন
একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
ফ্রস্ট : বাংলাদেশের ৭,৫০০,০০০ লোকের মধ্যে কত এখন ক্ষুধার্ত, এটাকে
কি দুর্ভিক্ষাবস্থা বলা যায়?
শেখ মুজিব: আমার ধারণা ৭৫% মানুষ।
ফ্রস্ট : ৭৫%?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, কারণ তাদের ধ্বংসযজ্ঞ। এমনকি যাদের সামর্থ ছিল নিজের
ঘরের খাবারের তাদেরগুলো সব লুট হয়ে গেছে। এমনকি খুবই সামান্য অর্থের মালিক তাদেরও সে
অর্থ লুট হয়ে গেছে। আমার মনে হয় এই সংখ্যা ৭৫% নয়, ৮৫% মানুষ এখন খুব খারাপ অবস্থায়
রয়েছে। আমার লোকেরা খুব ভালো এবং শান্তিপ্রিয়। তাদের পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে আমার ওপর।
তারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে তাদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্য। আমি খুব খুশি
যে, ভারত বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ আমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে-যাতে আমার মেশিনসমূহ
চালু হতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃ স্থাপন করতে হবে। কারণ আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তানিরা
রেলওয়ে, বড় বড় সড়ক সেতু, তেল সংরক্ষণাগার এবং শিল্পকারাখানা ইত্যাদি সব ধ্বংস করে গেছে।
মানুষের পক্ষে সম্ভব সব ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ তারা সাধন করেছে।
ফ্রস্ট : স্বাধীন দেশটির পুনর্গঠনে প্রথম সপ্তাহেই আপনার অনেক কাজ।
আপনি অবশ্য ইতোমধ্যেই, উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করে ফেলেছেন।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, পতাকাটি বহু পূর্ব থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে এর ছোট্ট একটি পরিবর্তন করা হয়েছে মাত্র।
আর এই সঙ্গীতটি বহু আগে থেকেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, আমি শুধু এর একটি অফিসিয়াল পরিচিতি
বা স্বীকৃতি দিয়েছি। আমাদের পতাকার ছোট্ট একটি পরিবর্তন আমি করেছি কারণ আমাদের পতাকাতেই
ধরা ছিল আমাদের দেশের মানচিত্র। কোনো দেশের জাতীয় পতাকাতেই তার দেশের সীমানা ধরা নেই।
ফ্রস্ট : কী কারণে এটা করা হয়েছে?
শেখ মুজিব : বিশ্বের কোথাও এমনটি নেই। আমরাও চাইনি জাতীয় পতাকায় দেশের
সীমানা নির্ধারক মানচিত্র থাকুক। এরপর আমি তা করেছি, আমার জনগণও পছন্দ করেছে। দেশের
পতাকা থেকে মানচিত্র অপসারণ করে সূর্যোদয় রাখা হয়েছে।
ফ্রস্ট : আপনাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কে?
শেখ মুজিব : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এটি তাঁর এটি পুরনো গান।
ফ্রস্ট : ইংরেজিতে এটিকে কী বলা যায়?
শেখ মুজিব : ইংরেজিতে বলা যায়, ‘‘ আই লাভ মাই গোল্ডেন বেঙ্গল’’। ‘‘
গোল্ডেন বেঙ্গল, আই লাভ ইউ।’’ এই বাক্য দিয়ে শুরু।
ফ্রস্ট : এবং এই সঙ্গীতটি বহু বছর ধরে বাংলাদেশে গীত হচ্ছে?
শেখ মুজিব : বহু বছর ধরে। ৭ মার্চ (১৯৭১), যখন রেস কোর্স ময়দানে আমি
শেষ জনসভা করি-সেখানে এক মিলিয়ন মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। এবং তারা স্বাধীন বাংলাদেশের
পক্ষে শ্লোগান দিয়েছিল। বাচ্চা ছেলেরা তখন গানটি গাইছিল। আমরা ১০ লাখ মানুষ সেদিন দাঁড়িয়ে
সম্মান প্রদর্শন (স্যালুট) করেছি এই সঙ্গীতকে।
ওই সময়ই গৃহিত হয়ে গেছে আমাদের এই জাতীয় সঙ্গীত।
ফ্রস্ট : আপনি কি মনে করেন যে, ৭ মার্চ রেস কোর্সের ভাষণে বাংলাদেশের
স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন?
শেখ মুজিব : আমি জানতাম যা ঘটতে যাচ্ছিল। তাই ওই সম্মেলনেই আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম, এবাবের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,
শিখল ভাঙার সংগ্রাম ও মুক্তির সংগ্রাম।
ফ্রস্ট : আপনি যদি সেদিন বলতেন,
‘‘আমি, আজ বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষাণা করছি’’, তাহলে কী হতো?
শেখ মুজিব : সেদিনই আমি তা করতে চাইনি। বিশেষত এই কারণে যে, আমি বিশ্বকে
তাদের বলার সুযোগ দিইনি যে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। আমাদের অন্য
কোনো বিকল্প ছিল না শুধু পাল্টা আঘাত করা ছাড়া। আমি চেয়েছিলাম আগে তারা আমাদের আঘাত
করুক এবং আমার জনগণ জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল।
ফ্রস্ট : অর্থাৎ আপনি তা শুরু করতে চাননি?
শেখ মুজিব : না, আমি চেয়েছিলাম তারা শুরু করুক।
ফ্রস্ট : বাংলাদেশকে ব্রিটেন কখন স্বীকৃতি দেবে বলে আপনি মনে করেন?
শেখ মুজিব : যে কোনো সময় আমি তা প্রত্যাশা করি। ব্রিটিশদের আমি জানি।
ফ্রস্ট : মি. হেথের সঙ্গে লন্ডনে আপনি কথা বলেছিলেন?
শেখ মুজিব : আমি মি. হেথের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। কথা বলেছিলাম মি. উইলসনের
সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি খুশি।
ফ্রস্ট : এবং আপনি ইংলিশ তামাকে ধূমপান করেন?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, বহুদিন ধরে?
ফ্রস্ট : এটা কোন তামাক?
শেখ মুজিব : এডিন মুর’স।
ফ্রস্ট : আপনি এটা পছন্দ করেন?
শেখ মুজিব : আমি এটি পছন্দ করি। প্রায় ১৪ বছর ধরে আমি ধূমপান করছি এমনকি
জেলে থাকার সময়ও। আমি তাদের বলেছিলাম, অবশ্যই এ তামাক দিতে হবে, তারা দয়া করে তা সরবরাহ
করেছিল।
ফ্রস্ট : এমনকি নির্জন সেলেও?
শেখ মুজিব : অন্তত এর জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ দিই। (হাসি)
ফ্রস্ট : এটা একটা ক্ষুধার্ত শহর। কিন্তু সুখী শহরও। এখন পর্যন্ত কি
জানতে পেরেছেন-কত টাকা আপনার দরকার?
শেখ মুজিব : এখন আমি বলতে পারব না। কিছুই বলতে পারব না। তারা এখান থেকে
যাবার সময় ব্যাঙ্ক নোটগুলোতে আগুন দিয়ে গেছে। আত্মসমর্পণের আগের ব্যাঙ্কের সবটাকা একত্র
করে আগুন দিয়েছে।
ফ্রস্ট : এবং এরপর পূর্ব পাকিস্তানের বাকি অর্থ (টাকা), আগেরই মতো রয়ে
যাবে, যেমন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে?
শেখ মুজিব : ওখানে কিছু নেই। আমি আমার লোকদের বলেছি স্বর্ণ দিতে, যা
কিছু তাদের আছে। তারা তা দেবে।
শেখ মুজিব ও ফিদেল ক্যাস্ট্রো |
ফ্রস্ট : তারা স্বর্ণ দেবে আর তা দিয়ে স্বর্ণের রিজার্ভস গড়ে উঠবে?
শেখ মুজিব : এটা একমাত্র বিকল্প এখন আমার সামনে। সম্ভবত আগামীকাল কিংবা
পরশু আমি জাতির কাছে আবেদন জানাব। তোমাদের যা কিছু আছে, তা থেকে কিছু অলঙ্কার আমায়
দাও। সরকারি ব্যাঙ্কে বন্ধক রাখো যাতে আমি কিছুটা রিজার্ভ গড়ে তুলতে পারি। কিন্তু তাদের
কিছু নেই। দোকানসমূহে লুট হয়েছে, স্বর্ণের দোকানসমূহেও। এর বেশি কিছু বলতে পারব না
আমি।
ফ্রস্ট : কিন্তু, আমি বুঝি
না, লোকেরা কোথা থেকে স্বর্ণ দেবে?
শেখ মুজিব : যা সামান্য তাদের আছে।
ফ্রস্ট : আপনি কি আরেকবার দেখবেন কোনো রিজার্ভ পশ্চিম পাকিস্তানে আছে
কিনা?
শেখ মুজিব : আপনি জানেন, পৃথিবীর কাছে তারা একটি প্রতিশ্র“তি দিয়েছে।
তারা ২,০০০ কোটি টাকা লোন নিয়েছিল, এর খুবই সামান্য অংশ তারা বাংলাদেশের জন্য খরচ করেছে।
এখন পাকিস্তান শুধু পশ্চিমে। আমরা পাকিস্তানি বাংলাদেশ নই। আমার কোনো দায়ীত্ব নেই। এই ঋণ কাটিয়ে ওঠা তাদের
পক্ষে কঠিন। ২,০০০ কোটি টাকা ঋণ শোধ করতে হবে কিন্তু শিল্পপণ্যের কোনো বাজার নেই। তারা
কী করবে? ভয়ানক বেকারত্ব দেখা দেবে সেখানে।
ফ্রস্ট : তারা বলে, বাংলাদেশ পরিচালনার জন্য আপনি অনেক বেশি ক্ষমতা
পেয়েছেন। একটি পুরনো প্রবাদ আছে-ক্ষমতা দুর্নীতি ডেকে আনে, চরম ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্থও
করে চরমভাবে। এখন ক্ষমতার কারণে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়া থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন কীভাবে?
শেখ মুজিব : আপনি জানেন, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসেছে হঠাৎ করে, দুর্ঘটনাবশত।
সে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু যে লোক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, সংগ্রাম করে,
কষ্ট পেয়ে, যুদ্ধ করে, সে ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে না। আমার দল আর আমি
পরস্পর সম্পর্কাবদ্ধ। আমার দলের সকল নেতা জেল খেটেছে, কেউ ঘরবাড়ি হারিয়েছে, কেউ পরিবারের
সদস্য হারিয়েছে। চব্বিশ বছর পরে তারা ক্ষমতা পেয়েছে। তারা চমর ক্ষমতা পেলেও দুর্নীতিগ্রস্থ
হবার সম্ভাবনা নেই। কারণ তারা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, ইয়াহিয়া খান
কিংবা অন্য কারও মতো নয়-যারা পাশবিক শক্তি আর বন্দুক ব্যবহার করেছে ক্ষমতায় আসার জন্য। আমার
লোকেরা ক্ষমতায় এসেছে বন্দুকের মাধ্যমে একথা ঠিক কিন্তু স্বাধীনতা অজর্নের জন্য অনেক
ত্যাগ তারা স্বীকার করেছে। কারণ তারা তাদের দেশ ও দেশের ভালোবাসে। আমার দলের নেতা ও
কর্মীদের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।
ফ্রস্ট : আপনি নেতার কথা বলেছেন? নেতা কী? উদাহরণস্বরূপ, আপনাকে যদি
বিশ্ব নেতৃত্বের সংজ্ঞা দিতে বলা হয়, কী বলবেন? সত্যিকারের নেতৃত্ব কী?
শেখ মুজিব : নেতৃত্ব আসে একটি
প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। একজন মানুষ দুর্ঘটনাক্রমে একদিনে নেতা হতে পারে না। একটি প্রক্রিয়ার
মধ্য দিয়ে তাকে আসতে হয়, বহু সংগ্রামের পর। নিজেকে তার প্রমাণ করতে হয় এবং উঠতে হয়
ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে। মানবতার স্বার্থে নিজেকে কুরবানী দেয়ার মানসিকতা তার
থাকতে হবে। অবশ্যই তার নীতি থাকতে হবে, একটি ভাবাদর্শ থাকতে হবে। একজন নেতার যদি এসব
গুণাবলি থাকে তবে তিনি নেতা।
ফ্রস্ট : বিশ্ব ইতিহাসের কোন কোন নেতাদের আপনি প্রশংসা করেন?
শেখ মুজিব : বহু নেতাকে আমি চিনি। বর্তমানে যারা নেতৃত্বে আছেন তাদের
নাম আমি উল্লেখ করতে চাই না।
ফ্রস্ট : আসুন আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই। কারা আপনাকে অনুপাণিত করেছেন?
শেখ মুজিব : আব্রাহিম লিঙ্কন, মাও সেতুং, লেনিন, চার্চিলের আমি প্রশংসা
করি। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট মি. কেনেডিকে বরাবরই আমি পছন্দ করি।
ফ্রস্ট : আপনি কি ওই সাবেক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছিলেন?
শেখ মুজিব : তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কিন্তু তার বই আমি পড়েছি। আমি
তাঁকে পছন্দ করি।
ফ্রস্ট : মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
শেখ মুজিব : মহাত্মা গান্ধীর প্রতি আমার রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা। পি ত জহরলাল
নেহেরু, নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসু, ফাজ-উল-হক, এবং কামাল আতাতুর্ক। ড. সুকর্নের আমি প্রশংসা করি উপনিবেশের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করে দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য। তাঁর প্রতিও রয়েছে আমার অগাধ প্রশংসা। এই
সকল নেতাই তৈরি হয়েছিলেন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
ফ্রস্ট : এই মুহূর্তে আপনি যদি পেছনের দিকে ফিরে তাকান তাহলে গত বছরের
কোন মুহূর্তটাকে সবচেয়ে আনন্দের বলে মনে হয়? কোন মুহূর্তটা আপনার জীবনের সবচেয়ে বেশি
সুখ এনে দিয়েছে?
শেখ মুজিব : সেইদিন যেদিন আমি শুনেছিলাম আমার দেশের মানুষের মুক্তি
ঘটেছে। আমার মানুষেরা স্বাধীন হয়েছে। এবং আমি বাংলাদেশ পেয়েছি। স্বাধীন সার্বভৌম একটি
দেশ। ওটাই আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন।
ফ্রস্ট : আপনার সারা জীবনের?
শেখ মুজিব : সারা জীবনের।
ফ্রস্ট : এমন একটি দিনের স্বপ্ন আপনি কত আগে থেকে দেখছেন?
শেখ মুজিব : বহু আগে থেকে।
ফ্রস্ট : স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনে প্রথম কখন জেলে গেছেন?
শেখ মুজিব : আমি মনে করি, আমি জেলে যেতে শুরু করেছি তথাকথিত পাকিস্তানের
১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৫৪ সালে আমি গ্রেফতার হয়েছি।
১৯৫৪ সালেই দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হয়ে অবরুদ্ধ থেকেছি ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত। আবার ১৯৫৮ সালে
আউব খানের সময় গ্রেফতার হই। পাঁচ বছর কয়েদ খেটেছি আর দু’বছর অন্তরীণ থেকেছি। মুখোমুখি
হয়েছি বহু মামলার। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ওসবেরই একটি। ১৯৬৬ সালে আবার গ্রেফতার হই
এবং তিন বছর অবরুদ্ধ থাকি। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে আবার গ্রেফতার করে। এরকম বহু কষ্ট
ও দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা এ পর্যায়ে এসেছি। শুধু আমি নই আমার সহকর্মীরাও।
ফ্রস্ট : এরপর যখন শুনেছেন, নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনার কোনো কোনো
সহকর্মী নিখোঁজ হয়েছে আপনার তখন কেমন লেগেছে?
শেখ মুজিব : আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল ওটা যখন আমি শুনেছিলাম
যে,.ওরা আমার ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : (এ পর্যায়ে ফ্রস্ট কিছু ছবি তোলেন। ছবি তুলতে তুলতে বলেন)
এই ছবিগুলো আমাদের স্মৃতি থেকে কখনোই মুছে যাবে না। আপনি জানেন এসব ছবি দুনিয়া জুড়ে
ছড়িয়ে যাবে। ভবিষ্যতে যখন আপনি এসব ছবি দেখবেন...
গাজী সাইফুল ইসলাম |
গাজী সাইফুল ইসলাম : ফ্রিল্যান্স প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
প্রকাশিত: মাসিক অগ্রপথিক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন
বিশ্বের 100 ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন