[This full Novel I wrote 5 year ago, when my posting was in Mymensingh. Later I rewrite it many times. In spite of it I post it as my older version. Thanks]
গাজী সাইফুল ইসলাম
সকাল। পিয়াস-তোহফা তখনও ঘুমোচ্ছে। এক রুমে পাশাপাশি খাটে ঘুমোয় তারা। তাদের খাটের সঙ্গে লাগুয়া পড়ার টেবিল। পড়তে পড়তে ঘুম পেলে যে যার মতো ঘুমিয়ে যায়। ঘুম আর পড়ার ব্যাপারে তাদের প্রতি তাদের আব্বু-আম্মুর কোনো কড়াকড়ি নির্দেশনা নেই। আব্বুর কথা হলো, পড়তে পড়তে যখনই ঘুম পাবে ঘুমিয়ে যাবে। ঘুম ঘুম চোখে পড়ে কোনো লাভ হয় না। তাদের আব্বু শেখ দরদ একজন মফঃস্বল সাংবাদিক। ছড়া ও কবিতা লিখে। আর আম্মু বেগম জাহানারা একজন গৃহিনী। তারা ঘুমান পাশের ঘরে। ফজরের নামাজ পড়ে তারা একসঙ্গে বাচ্চাদের ঘরে যায়। শেখ দরদ বলল, ছেলেমেয়েদের অন্য ঘরে রেখে আমার খালি খালি লাগে। আর বেগম জাহানারা বলল, ওরা বড় হচ্ছে। একা একা থাকার অভ্যেস করাই ভালো। স্বাধীনচেতব হওয়ার শিক্ষাটা এখন থেকেই পাবে। বাবা-মায়ের স্নেহের ছায়া সন্তানদের জন্য জরুরি কিন্তু তা যেন তাদের সামনে দেয়াল না হয়ে যায়।
শেখ দরদ উদার প্রকৃতির খোলামনের মানুষ। আর বেগম জাহানারা কঠোর প্রকৃতির, চাপা স্বভাবের মানুষ। এজন্য তাদের মধ্যে প্রায়শই মতের অমিল দেখা দেয়। তবে মতের অমিল সত্ত্বেও তাদের সংসারে ভালোবাসার অভাব নেই। তারা দুজনেই ছেলেমেয়েকে ভালোবাসেন প্রাণ ভরে। মতের অমিলের কারণে তাদের মধ্যে একটু আধটু ঝগড়া লাগলে ছেলেমেয়েরই মধ্যস্থতাতেই মিটে যায়।
শেখ দরদ এগিয়ে গেল ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমো দিতে।
বেগম জাহানারা বাধা দিয়ে বলল, না-না, ঘুমের মধ্যে চুমো দিও না। এতে ছেলেমেয়েরা বেশি দুষ্টু হয়ে যায়।
কে বলেছে এসব কথা ?
লোকেরা বলে।
লোকেরা তো কত কথাই বলে। তাদের সব কথার পেছনে যুক্তি থাকে না।
তা হয়তো ঠিক।
হয়তো বললে চলবে না। আমার ছেলেমেয়েকে আমি চুমো দেবোই। তুমি সবসময় একটু বেশি শাসন করো-এই তোমার সমস্যা।
শোনো আমি ওদের মা, আদরও করব শাসনও করব। তুমি কি জানো না,
ছেলেমেয়ে কষ্ট পেলে-বেশি আম্মুর বুকে বাজে
-শাসন করা সেই তারই সাজে সোহাগ করে যে ?
হ্যাঁ জানি। তবে আদরের চেয়ে শাসন বেশি হলেও সমস্যা। বাচ্চাদের মন বিষিয়ে উঠে। গ্রাম-বাংলার এ কবিতাটি শুনোনি ?
অতি শাসন করো না ঘর ছেড়ে পালাবে
না খাইয়ে রেখো না অন্যকে জ্বালাবে।
উঠতে বসতে মেরো না ভয় ভেঙে যাবে
হাত পাত্তে দিও না ভিক্ষে করে খাবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আদরও করব না, শাসনও করব না। যা করার তুমিই করো।
তাদের কথার কাটাকাটিতে সামিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। সে বলে, আব্বু-আম্মু তোমরা! সে ওঠে এসে তার আম্মুর গলা জড়িয়ে ধরল। আমার আম্মু লক্ষ্মি !
যাও, তোমার আব্বুর কাছে যাও। আমার কাছে এসো না। তোমার আব্বু বলেছে, আমি নাকি খালি তোমাদের শাসন করি, আদর করি না।
সামিয়া তার আম্মুর কোলে মুখ রেখেই বলল, ঠিকই তো বলেছে আব্বু।
কী ঠিক বলেছে?
না না, আম্মু আমাদের কত্তো আদর করে। সে আরও শক্ত করে তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে।
তাদের সবার কথা শুনে পিয়াসেরও ঘুম ভেঙে যায়। সে তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বয়স্ক মানুষের মতো বলল, আহ্ ! দিলে তো আমার স্বপ্নটা মাটি করে।
আব্বু, ভাইয়া না প্রতিদিন স্বপ্ন দেখে। আর বলে, আজ যা মজার একটা স্বপ্ন দেখেছি শুনলে তোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আচ্ছা আব্বু তুমিই বলো, কারও স্বপ্নের কথা শুনে কি কারও মাথা খারাপ হয় ?
না মা। তোমার ভাইয়া তো দুষ্টুমি করে।
কিন্তু স্বপ্নতো সে প্রতিদিন দেখে না। তাহলে মিথ্যে কথা বলে কেন ? দুষ্টুমি করেও যে মিথ্যে কথা বলতে নেই ভাইয়া জানে না ?
হ্যাঁ, তাইতো। দুষ্টুমি করেও যে মিথ্যে কথা বলা যাবে না এটা তুমি জানো না পিয়াস? শেখ দরদ বলল।
জানি আব্বু। কিন্তু মাঝেমধ্যে ভুলে যাই।
পিয়াসের কথা শেষ হতে না হতেই বেগম জাহানারা বলল, শুধু দুষ্টুমি করে নয় কাজের কথায়ও তোমার ভাইয়া মিথ্যে বলে। আমি খেয়াল করেছি। তার কথায় স্পষ্ট রাগের আভাস।
তুমি তো আবার রেগে যাচ্ছ। কথায় কথায় রেগে যাওয়াটা খুব খারাপ।
পিয়াস লাফ দিয়ে ওঠে এসে আব্বু-আম্মুর মাঝখানে দুই কান ধরে বসে পড়ল। বলল, শান্ত হও ! শান্ত হও ! এই কান ধরছি আর মিছা কথা কইতাম না। দয়া কইরা ঝগড়া কইরো না।
তুমি হচ্ছ তোমার আব্বুর মতো। গ্রামের মানুষের মতো কথা বলো।
আমার ছেলে তো আমার মতোই হবে, লোকেরা দেখলেই বুঝতে পারবে গ্রামের মানুষ।
আর মেয়ে ? সামিয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল।
মেয়েও আমার মতোই হবে। শেখ দরদ বলল।
এবার দুভাইবোন আব্বুকে জড়িয়ে ধরল। সামিয়া হাসতে হাসতে বলল, আম্মু আমারও না গেরামের মাইনসের কথা কইতে ইচ্ছা করে। তারা কুকুরকে বলে কুত্তা, শিয়াল বলে হেয়াল, আর পানিকে বলে হানি। হিঃ হিঃ হিঃ।
দাদা ডিম ভাজিকে বলে আণ্ডা বিরান হাঃ হাঃ হাঃ। বলল পিয়াস।
তাদের আম্মু তখন কপট রাগের ভঙ্গিতে ওঠে যেতে চাচ্ছে। শেখ দরদ তার হাত ধরল। আরে থামো থামো ?
বাপ পাগল পোলাপানও পাগল। এবার একসঙ্গে সবাই হেসে উঠল।
আম্মু নাস্তা চাই। ক্ষিধায় পেট পুড়ে যাচ্ছে। পিয়াস বলল।
আমারও। তোহফা বলল।
আমারও। বলল তাদের আব্বু।
ঠিক আছে তোমরা গিয়ে পড়তে বসো। আমি এখনই নাস্তা তৈরি করে ফেলব।
না, না কবি সাহেব, বলুন আগে গিয়ে হাত মুখ-ধুইতে। পরে পড়তে বসতে।
আব্বুর প্রতি আম্মুর ব্যঙ্গাত্মক কথা শুনে পিয়াস হেসে ফেলল।
পিয়াস তুমি হাসলে যে ? শেখ দরদ জানতে চাইল।
আম্মু যে তোমাকে কবি বলে ঠাট্টা করল-শুনোনি ?
হ্যাঁ, কবিই তো। তোমার আম্মু ঠাট্টা করলে কী এসে-যায়।
কবিরা তো না খেয়ে মরে ! আমি চাই না আমার ছেলেমেয়ে কবি হোক।
বিবিজান শুনেন, এই যুগে কবিরা না খেয়ে মরে না। যেমন আমরা মরিনি।
কিন্তু আব্বু শান্তি খলামনিও একদিন বলল। এ্যাই কবির ছেলে। কবিরা তো না খেয়ে মরে। এটা বলার কারণ কী ?
আগেকার দিনে আমাদের দেশের চারণ ও স্বভাআ কবিরা অর্থ কষ্টে ভোগতেন। প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে তারা চাকরি-বাকরি পেতেন না, বাউণ্ডুলে জীবন যাপন করতেন। ফলে সারাজীবন তাদের অভাব থাকত। এ জন্যই অনেকে এসব কথা বলে থাকে। আর এখনকার কবি-লেখকরা কবিতা লিখে, গল্প-উপন্যাস লিখে ধনী জীবন যাপন করে। কারণ তারা অনেক লেখাপড়া করার পর এই লাইনে আসে। মনে রেখো, এখনকার কবি লেখকদের অনেক বেশি যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।
তাহলে তুমিও চাও তোমার ছেলেমেয়েরা কবি হোক।
না, আমি ঠিক এভাবে চাই না। আমি বরং তাদের মানুষ করার চেষ্টা করব। যে বিষয়টা তারা ভালো বুঝবে সেই বিষয়ে পড়াতে চেষ্টা করব। এরপর তারাই বাছাই করবে কী তারা হবে। কোন পথে তারা যাবে। সবচেয়ে জোর দেবো যাতে তারা ভুল পথে না যায়। অসৎসঙ্গ লাভ করে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। তাহলেই আল্লাহ চাহেতু কেউই না খেয়ে মরবে না।
কিন্তু তোমার ছেলেমেয়ে তো খাওয়ার আগে হাতমুখই ধুতে চায় না। পেটের অসুখ আর ক্ষীণ স্বাস্থ্য নিয়ে তারা বড় মানুষ হবে কী করে শুনি ?
এটা তো ভিন্ন কথা। কী সামিয়া তোমার আম্মু যা বলছে সত্য ?
সামিয়া চুপ করে থাকে।
পিয়াস তুমি বলো !
আব্বু মানে ইয়ে আব্বু।
ইয়ে মানে তোমার আম্মুর অভিযোগ সত্য।
মেয়েটা তো কথাই মানে না। মুখ ধুইলে হাত ধুতে চায় না।
দাঁড়াও ! দাঁড়াও ! হাত না ধোয়ে মুখ ধোয় ক্যামনে ?
তাইতো! পিয়াস হেসে ফেলল।
ও পারে। আমি পেছনে থাকলে মুখটি বাড়িয়ে বসে থাকে। তখন আমিই ধুয়ে দিই। বুঝতে পেরেছ ? ও হ্যাঁ, আজ ১৫ অক্টোবর, বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। ছেলেমেয়েদের দিবসটি সম্পর্কে কিছু বলো।
আচ্ছা বলছি। তুমি রান্নাঘরে যাও।
পিয়াস-সামিয়া হাত-মুখ ধুয়ে এসে পড়তে বসেছে। তাদের আব্বু বলল, দুজনেই তোমরা শোনো। বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। আজকের পত্রিকায় হয়তো ছাপা হয়েছে। তোমরা নিজেরা দেখে নিও। আর যদি ছাপা না হয়, আমি ইন্টারনেট থেকে জেনে এসে তোমাদের সন্ধ্যায় বলব। দুপুরে ফোন করে আমাকে মনে করিয়ে দিও।
আচ্ছা আব্বু, ইন্টারনেটে কি সব পাওয়া যায় ? সামিয়া জানতে চাইল।
না মা, সব পাওয়া যায় না। চাল, ডাল, হারুয়া, রুটি, ডিম, দুধ, শাড়ি, গয়না, মাছ মাংস শাক-সবজি এসব কিছু ইন্টারনেটে পাওয়া যায় না। কিন্তু এসব সম্পর্কে যত তথ্য প্রয়োজন সব পাওয়া যায়।
তথ্য কী আব্বু ? পিয়াসের প্রশ্ন।
তথ্য হলো জ্ঞানের একক ? যেমন ধরো, ভাত একটা শব্দ। ভাত সম্পর্কে তোমরা যা কিছু জানো সবই ভাত সম্পর্কিত তথ্য। আর এরকম অসংখ্য তথ্য নিয়েই তৈরি হয় তোমাদের জ্ঞান।
তাহলে জ্ঞান কী আব্বু ? পিয়াসের প্রশ্ন।
জ্ঞান সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। আমি শুধু এইটুকু বলব যে, জীবন ও বস্তু সম্পর্কে তোমার আমার যে ধারণা তাই জ্ঞান। এই ধারণাটা হয় অভিজ্ঞতা থেকে। অভিজ্ঞতা হলো দেখা-জানা-শোনার মিশ্রণ।
আব্বু খুব কঠিন।
হ্যাঁ, একটু কঠিন। তবু এগুলো তোমাদের জানা দরকার। দেখো তোমরা বড় হবে, অনেক পড়াশোনা করবে, দেশ ভ্রমণ করবে, কতকিছু দেখবে, জানবে, শুনবে সবই জ্ঞানে পরিণত হবে।
তাই ? এবার কিছুটা বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা আব্বু, ভাত সম্পর্কিত তথ্য ইন্টারনেট থেকে কীভাবে পাওয়া যায়?
বলছি। আগে তুমি বলো, ভাত সম্পর্কে তোমরা কী জানো।
ভাত আমরা খাই। ভাত হয় চাল থেকে। সামিয়া বলল।
চাল কোথা থেকে হয় সেটাও জানো।
হ্যাঁ জানি। ধান থেকে।
ধান কোথায় হয় তাও তোমরা জানো।
হ্যাঁ জানি। জমি থেকে।
কিন্তু ভাতের মধ্যে কী কী উপাদান আছে অর্থাৎ একটা ভাত ভাঙলে কী কী উপাদান পাওয়া যায়, মানুষের শরীরে সে সব উপাদানে কীভাবে কাজ করে এসব তোমরা জানো না।
জানি আব্বু, ভাত খেয়ে আমরা বেঁচে থাকি। সামিয়া আবার বলল।
হ্যাঁ, বেঁচে থাকার জন্য আমরা ভাত খাই। এ কথা সত্য। তাই বলে শুধু ভাত খেয়েই আমরা বেঁচে থাকি না।
হ্যাঁ আব্বু, ভাতের সঙ্গে মাছ-মাংস, তরিতরকারি খেতে হয়। লবণ চিনি, দুধ-ডিম খেতে হয়। পিয়াস বলল।
হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। তবে ভাত খেলে কীভাবে তা আমাদের শরীরে কাজ করে তা তোমরা জানো না। আবার এটাও জানো না, ধান কীভাবে পৃথিবীতে এলো, পৃথিবীর আদি অবস্থায় ধান ছিল কি-না।
হ্যাঁ, আব্বু এসব জানি না।
শোনো, বস্তু সম্পর্কে তুমি কিছু জানো আর কিছু জানো না। এই জানা-অজানা বিষয় নিয়েই জ্ঞান। এমন অনেক বিষয় আছে, তোমার আম্মু জানে আমি জানি না। আবার আমি যা জানি অন্যে হয়তো জানে না। কিন্তু ইন্টারনেটে সবার জন্য সব বিষয়ে জানার মতো অসংখ্য তথ্য রয়েছে। কিছু কিছু প্রশ্নের একেবারে সঠিক উত্তর হয়তো পাওয়া যায় না কিন্তু কাছাকাছি ধরণা ইন্টারনেট থেকে পাওয়া যায়-ই।
তাহলে তো আমাদের ক্লাশের পড়াও আমরা ইন্টারনেট থেকে পেতে পারি।
হ্যাঁ, অবশ্যই পেতে পারো। এর জন্য অবশ্য ইংরেজিটা ভালো জানতে হবে। কারণ ইন্টারনেটের বেশিরভাগ তথ্য ইংরেজিতে।
আর বাংলায় ?
আছে। তবে খুব কম।
তাহলে তুমি আমাদের সাহায্য করবে।
অবশ্যই করব। কিন্তু তথ্য সংগ্রহ করে দিয়ে নয় কীভাবে সংগ্রহ করতে হয় সেটা শিখিয়ে দিয়ে। আমি না হয় তোমাদের পাশেই বসে থাকব। তোমরা নিজেরাই ব্রাউজ করবে।
কী করব ?
ব্রাউজ করবে। শব্দটার আভিধানিক অর্থ হলো ভাসাভাসা পাঠ। কিন্তু কম্পিউটার ব্যবহারে এর কাছাকাছি অর্থ হয় ইন্টারনেটে তথ্য পাঠ করা। বা এরকম কিছু।
আচ্ছা তথ্য পাঠ করা সম্পর্কে আরেকটু পরিস্কার করে বলা যায় না আব্বু ?
হ্যাঁ যায়। চলো আবার ভাতের প্রসঙ্গই টেনে আনি। ইন্টারনেট থেকে ভাত সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে ভাতসহ আরও কিছু বাংলা শব্দের ইংরেজি তোমাকে জানতে হবে। যেমন ধরো, রাইস, পেডি, ল্যান্ড, ক্রপস ইত্যাদি। এরপর এন্টারনেট সংযোগ রয়েছে এমন একটা কম্পিউটার তোমাকে বেছে নিতে হবে। সেই কম্পিউটারটি সম্পূর্ণ ওপেন অবস্থায় থাকলে তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন ব্রাউজার তুমি ব্যবহার করবে তোমার তথ্য খোঁজার জন্য। এখনতো অনেক ব্রাউজার। ইয়াহো, গুগল, মজিলা ফায়ারফক্স, এমএসএন, অপেরা ইত্যাদি। আমি বেশিরভাগ সময় গুগল ব্যবহার করি। তোমরাও মনে করো তাই করবে। এবার গুগল ওপেন হলে সার্চ ওপসনে গিয়ে রাইস লিখে সার্চে ক্লিক করো এবং একটু অপেক্ষা করো। দেখবে তোমার কল্পনার চেয়েও বেশি ওয়েবসাইট রাইস সম্পর্কে তথ্য নিয়ে তোমার সামনে হাজির হয়ে গেছে। একটা একটা করে কিংবা একসঙ্গে কয়েকটা ওয়েসাইট খুলে দেখো, কী মজার ঘটনা। কত সব জানা-অজানা তথ্য তোমার সামনে। তুমি ইচ্ছে করলে সাইটগুলো সরাসরি সেভ এজ করে, পেন ড্রাইভের সাহায্যে নিজের কম্পিউটারে নিয়ে আসতে পারো। অথবা নিয়ে আসতে পারো ওয়ার্ড ফাইলে কপি করে। ইচ্ছে করলে, এভাবে তুমি একশো-দুশো পৃষ্ঠা পর্যন্ত সংগ্রহ করে প্রিন্ট দিতে পারো। প্রয়োজন মতো ছবিও পেয়ে যাবে একইসঙ্গে। এরপর আরও ওয়েবসাইট, আরও ওয়েসবসাইট পাবে। এরপর যদি ধানের জমি সম্পর্কে জানতে চাও, তাহলে, ওখান থেকেই পারবে। নতুন একটা উইনডোজ খুলে শুধু রাইস ফিল্ড বাক্যাংশটি লিখে একটি কমা দিয়ে ক্ল্যাসিফাইড লিখে দাও। বিশ্বের সবধরনের জমি সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাবে। ইচ্ছে করলে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম তথ্যও তুমি এখান থেকে খুঁজে পেতে পার। তবে কিছু টেকনিক শিখে নিতে হবে। একইসঙ্গে সময়ও দিতে হবে ব্রাউজ করার জন্য। মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেট জ্ঞানের আরেকটা পৃথিবী। কাজেই তথ্যের জন্য তোমাকে সে পৃথিবীর কোণে কোণে যেতে হতে পারে। হ্যাঁ মনে রেখো, সে পৃথিবীর নাম ভার্চুয়াল পৃথিবী।
॥ এক ॥
পিয়াস-সামিয়া পড়তে বসেছে। পিয়াস পড়ছে ইংরেজি। সামিয়া পড়ছে বাংলা। পড়ায় সামিয়ার মনযোগ নেই। সে মুখে কথা বাজিয়ে বাজিয়ে সুর টেনে পড়ছে।
উপদেশ নয় সত্য কথা
বলছি কিছু শোনো
মানুষ হওয়ার বিকল্প নেই
সংসারেতে কোনো।
আকাশ জমিন ঠিক আছে সব
গাছ-গাছালি ফুল
তবু দেখো তোমরা কত
করেই যাচ্ছে ভুল।...
তার পড়া শুনে পিয়াসের রাগ হচ্ছে। বলল, ভালো করে পড়।
কিন্তু সামিয়ার উচ্চারণ আরও অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পড়া যেন নয় ঝিঁঝি পোকা ডেকে যাচ্ছে। তার এ ধরনের পড়া শুনে পিয়াসের রাগ আরও বেড়ে গেল। সে বলল, ভালো করে পড় নাহলে ভাগ এখান থেকে।
ঠিক আছে আমি গিয়ে আম্মুকে বলব, ভাইয়া আমাকে পড়তে দেয় না।
তুই না সত্যবাদী। মিথ্যা বলবি ক্যান।
মিথ্যা কই তুমিই তো ওঠে যেতে বললে।
ঝিঁঝি পোকার মতো সুর টেনে পড়লে আমার মাথা ঠিক থাকে না।
কী আমি ঝিঁঝি পোকা ? হিয়ি ! হিয়ি ! হিয়ি ! কাঁদতে শুরু করে সামিয়া।
সামিয়ার কান্না শুনে শেখ দরদ পড়ার ঘরে ছুটে এলো। কী খবর কান্নাকাটি কেন ? সামিয়া কী হয়েছে ?
আব্বু ভাইয়া আমাকে ঝিঁঝি পোকা বলেছে।
কী বললে, আমি তোকে ঝিঁঝি পোকা বলেছি ?
পিয়াস চুপ। তোমার পড়া তুমি পড়।
সামিয়া তখনও হিয়ি ! হিয়ি ! করে কেঁদে চলছে। পিয়াস বলল, আব্বু দেখো হিয়ি ! হিয়ি ! করলে আমি এ রুমে পড়তে পারব না।
দেখি কী পড়া তোমার ?
এই যে ইংরেজি কবিতাটা।
A Poem For Mom
Champagne S. Baker
You are the sunlight in my day,
You are the moon I see far away.
You are the one who taught me life,
How to fight and what is right.
You are the words inside my song,
You are my love, my life, my mom....
ওহ্, মাকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা কবিতা। কী করতে হবে ?
বাংলা অর্থসহ মুখস্ত করতে হবে।
কতটুকু মুখস্ত হয়েছে ?
চার লাইন। বাকি দুই লাইনও এতক্ষণে হয়ে যেত কিন্তু এই ঝিঁঝি পোকাটার জন্য মনযোগ দিতে পারছি না।
পিয়াস ছোট বোনকে ঝিঁঝি পোকা বলা ঠিক না। ও যদি ঝিঁঝি পোকা হয় তুমি একটা তেলাপোকা।
সামিয়া সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল আর হাততালি দিতে লাগল। ভাইয়া একটা তেলাপোকা ! আব্বু বলেছে, ভাইয়া তেলাপোকা!
আব্বু আমি তো ওকে আগে ঝিঁঝি পোকা বলিনি। ও তো মিথ্যে বলেছিল।
তাই নাকি ? তুমি তোমার ভাইয়ার নামে মিথ্যে বলেছ ?
কিন্তু ভাইয়া যে আমাকে রাগাল।
রাগ হলে কী করতে হয় আমি তোমাদের বলিনি ?
হ্যাঁ বলেছ। মাটির দিকে তাকাতে হয়। অথবা গাছের দিকে তাকাতে হয়।
পিয়াস তুমি বলো রাগ হলে মাটির দিকে তাকাতে হয় কেন ?
মাটির কোনো রাগ নেই বলে। মাটিকে আমরা কাটি-বাটি-পোড়াই। কিন্তু মাটি কখনো রাগ করে না। প্রতিবাদ করে না। মাটি আমাদের শস্য দেয়, মৃত্যুর পর মাটিই আমাদের বুক পেতে গ্রহণ করে।
বা ! সুন্দর বলেছ।
সামিয়া তুমি বলো রাগ হলে গাছের দিকে তাকাতে হয় কেন ?
গাছেরও রাগ নেই তাই। বড় গাছের নিচে কত ছোট গাছ থাকে। কিন্তু তারা কখনো ঝগড়া করে না। মারামরি করে না।
ঠিক বলেছ। আমি খুশি হয়েছি গাছ ও মাটি সম্পর্কে আমি তোমাদের যা বলেছিলাম মনে রেখেছ বলে।
শুনো, ঝগড়া করে হোক আর কথায় কথায় হোক ঝিঁঝি পোকা আর তেলাপোকার নাম তোমরা বলেছ। আমি একদিন তোমাদের ঝিঁঝিপোকা দেখাতে নিয়ে নিয়ে যাব ? আর তেলাপোকা তো ঘরেই থাকে। তোমরা দেখেছ।
জ্বি আব্বু দেখেছি। সামিয়া বলল।
কিন্তু তুই তো তেলাপোকা দেখলে ভয়ে ভে করে উঠিস।
তুমি ভয় পাও না ?
নাহ্। অতটুকুন একটা পোকা। আমি তো তেলাপোকা হাতে ধরতে পারি।
খালি হাতে তেলাপোকা ধরা ঠিক না পিয়াস।
কেন আব্বু ?
বেশিরভাগ সময় তেলাপোকারা গোপন জায়গায় বসবাস করে। পৃথিবীর বেশিরভাগ গোপন জায়গা নোংরা, ময়লাযুক্ত। সে সব ময়লা তেলাপোকার পায়ে লেগে থাকে। কঠিন রোগ জীবানুও লেগে থাকতে পারে। তাছাড়া তেলাপোকারা খায়ও ময়লা আবর্জনা। এমনকি রোগ জীবানু পর্যন্ত। তোমরা দেখবে, রাতে যখন আমরা খাবার খেয়ে ওঠে যাই, তখন যদি বিদ্যুৎ চলে যায়, খাটের নিচ থেকে তেলাপোকারা বেরিয়ে আসে। ফ্লোরে পড়ে থাকা ছুতি-ময়লা খায়।
হ্যাঁ, গতকালও এসেছিল। আমি তখন বিছানায় ওঠে গেছি।
শোনো, ভয় পাওয়ার মতো একটা ঘটনাও তেলাপোকা ঘটায়।
কী ঘটনা আব্বু ?
কারও শরীরে যদি ক্ষত রোগ থাকে, সেটা কাটা হোক, পচা দুর্গন্ধ হোক রাতে যখন সে ঘুমিয়ে থাকে, ঘরের বাতি নেভালেই তেলাপোকা আসবে। তার শরীরের ক্ষত স্থান তেলাপাকো চাটবে। শুনোনি সেদিন মিশুর মা বলল, রাতে মশারির মধ্যে তেলাপোকা ঢুকে পড়েছিল। তখন সবার ঘুম ভেঙে গেল। আর মিশুর কী কান্না।
হ্যাঁ, কিন্তু তাদের ঘরে তো কারও ক্ষত রোগ নেই।
সবসময় রোগের জন্য তেলাপোকা আসে তা নয়। এমনিতেই খাদ্য খুঁজতে খুঁজতে চলে আসতে পারে। তেল চিটচিটে দুর্গন্ধযুক্ত বিছানায়ও আসতে পারে।
কিন্তু আম্মু যে বলল, ময়লার মধ্যে থাকলেও তেলাপোকার শরীরে ময়লা লাগে না।
এটা ঠিক না। অবৈজ্ঞানিক কখা। আমি দেখেছি, ময়লা গর্ত থেকে বের হয়ে যে পথে প্রতিদিন তেলাপোকা চলাচল করে সে পথে ময়লার দাগ পড়ে যায়।
কিন্তু তেলাপোকা থেকে না নাকি ওষুধ হয় ? আম্মু একদিন বলল।
হ্যাঁ। খুব গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ। হোমিওপ্যাথি মতে হাঁপানি রোগের একটা ওষুধের নাম ব্ল্যাটাওরিয়েন্ট্যালিস তেলাপোকা থেকে হয়।
ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, তেলাপোকা কিন্তু নিশাচর প্রাণী।
নিশাচর মানে কী আব্বু ? সামিয়া জানতে চাইল।
নিশা হলো রাত। রাতে মানে অন্ধকারে চরে বেড়ায় যে সেই নিশাচর।
আব্বু আরও এক দুটি নিশাচর প্রাণীর নাম বলো না। আবার সামিয়া বলল।
যেমন ধরো বাদুর। পিয়াস তোমার বাংলা গ্রামার বইয়ে আছে না, আকাশে চরে যে-খেচর। ভূমিতে চরে যে-ভূচর। জলে চরে যে-জলচর। আর জল-স্থল-অন্তরিক সর্বত্র চরে বেড়ায় যে তাকে বলে-উভচর।
আছে আব্বু।
সামিয়া তুমিও ওপরের ক্লাশে গিয়ে পাবে।
এসব প্রাণীর উদাহরণ দিতে পারো না আব্বু ?
হ্যাঁ পারি। প্রায় সবধরনের মাছ জলচর প্রাণী।
আব্বু বেঙ ?
হ্যাঁ, বেঙও জলচর প্রাণী। তবে বেঙ স্থলেও অনায়েসে বিচরণ করতে পারে। এ জন্যকে বেঙকে উভচর প্রাণী বলা যায়। আবার কুনোবেঙ শুধু ভূমিতে বিচরণ করে বলে এটিকে ভূচর প্রাণী বলা যেতে পারে। উভচর প্রাণীর আর কোনো নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে। আমি খুঁজে দেখব।
আব্বু, তুমি অবশ্যই নিশাচর, খেচর, ভূচর, উভচর সব প্রাণীর আরও নাম ইন্টারনেট থেকে আনবে। ছবিও আনবে।
আচ্ছা আনব। ও হ্যাঁ, তেলাপোকাদের সম্পর্কে একটা কথা তোমাদের মনে রাখা দরকার। এই পোকাটির ওপর বিজ্ঞানিদের গবেষণার শেষ নেই। বাংলাভাষায় একটা প্রবাদ আছে, অতিকায় হাতি লোপ পেয়েছে কিন্তু তেলাপোকা আজও টিকে আছে।
এটা কীরকম প্রবাদ আব্বু ?
তোমরা তো জানো, পৃথিবী থেকে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যেসব প্রাণী আকারে বড় ছিল, যেমন ধরো ডাইনেসর, অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এশিয়ার বড় প্রাণীদের মধ্যে হাতিও বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এই ধরো গত ১০০ বছরে এশিয়ায় যত হাতি ছিল বর্তমানে তার অর্ধেকও নেই। প্রমাণ দেয়ার জন্য ইন্টারনেটের http://www.elephantcenter.com থেকে নিচের লাইনগুলো হুবহু বলছি শোনো, 35,000 Number of Asian elephants that exist in the world today. 200,000 Number of Asian elephants that existed in the wild in 1900. অর্থাৎ ১৯০০ সালের শুরুতে এশিয়ায় হাতির সংখ্যা ছিল ২০০, ০০০ আর বর্তমানে এই সংখ্যা ৩৫,০০০-এ নেমে এসেছে।
কী কী কারণে হাতিরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে?
নানা কারণে, যেমন ধরো, নিরাপদ খাদ্য, পানি ও বাসস্থানের অভাবে বেশিরভাগ বড় প্রাণী মারা গেছে। কিছু আবার মেরে ফেলেছে শিকারি মানুষ। সাধারণ মানুষও কারণে-অকারণে প্রচুর হাতি হত্যা করেছে।
সাধারণ মানুষ কীভাবে হাতি হত্যা করেছে ? হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য খাদ্যে বিষ মিশিয়ে। কিছু হত্যা করেছে ফাঁদ পেতে। একে বলে হাতি খেদা। অনেক আদিবাসী আছে হাতি খায়। শিকারিরা হাতি ধরে মেরে হাড়গুলো বিক্রি করে দেয়। হাতির হাড়ের নাকি অনেক দাম। বিশেষ করে লম্বা দুটি দাঁতের। একবার বিদেশি একটি পত্রিকায় দেখেছিলাম হাতির দাঁত দিয়ে জুয়া খেলার গুটি তৈরি করে। আরেকটি পত্রিকায় দেখেছিলাম, হাতির দাঁত পুড়ে ওষুধ তৈরি করে।
আচ্ছা আব্বু হাতি তো অনেক বড়ো, ওজন কত হতে পারে? সামিয়া জানতে চাইল।
এটা তো ভিন্ন প্রসঙ্গ।
তবু বলো না। যখন হাতি দেখি আমার খুুব জানতে ইচ্ছে করে।
তাহলে হাতি সম্পর্কে সবগুলো বিষয় একসঙ্গে জেনে নাও। হাতি উঁচু হয় ৮ থেকে ১০ ফুট। ওজন হয় ৩ থেকে ৫ টন। বাঁচে ৬০ থেকে ৭০ বছর। দিনে ৪০০ পাউন্ডের মতো খাদ্য ও ৪০ গ্যালনের মতো পানি খেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারতের কিছু অংশে, চীন, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাউস, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বেশি হাতি দেখা যায়।
ধন্যবাদ আব্বু। সামিয়া বলল।
আচ্ছা আব্বু, বুঝলাম হাতি মরে যাচ্ছে। কিন্তু তেলাপোকা টিকে আছে মানে কী ?
এসময়ই বেগম জাহানারা পড়ার ঘরে এলো।
কী খবর পড়ার সময় এত গল্প কীসের ? সময় নষ্ট হচ্ছে না ?
হোক, আজ ছুটির দিন। আব্বুর গল্প শুনব। বড় হলে এগুলো আমাদের কাজে লাগবে। আর পরীক্ষায় যদি হাতি বা তেলাপোকা সম্পর্কে রচনা এসে যায় ?
আসা তো উচিত। তেলাপোকা একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী। দিনদিন এদের সংখ্যা বাড়ছে।
প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী কী আব্বু ?
আসলে এখানে প্রাগৈতিহাসিক শব্দটা আমি ব্যবহার করেছি প্রাচীন অর্থে। প্রাগৈতিহাসিক শব্দের আরও কাছাকাছি দুটি অর্থ হলো অসভ্য, বর্বর।
তেলাপোকার কিন্তু আরেকটা নাম আছে। তোমার আব্বু বলেছে কিনা জানি না।
কী নাম আম্মু ?
আরসোলা। আরেকটা নাম আছে-তেলচাটা।
এ নামটা তো আব্বু বলেনি ।
এ নামটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। মনে করিয়ে দেয়ার জন্য তোমাদের আম্মুকে ধন্যবাদ।
আচ্ছা আব্বু, তেলাপোকা নিয়ে কী কী গবেষণা হচ্ছে ?
গবেষণা হচ্ছে তেলাপোকার বেঁচে থাকার অসীম ক্ষমতার নিয়ে। বিরূপ পরিস্থিতিতেও তেলাপোকারা মরে না। যেমন ধরো উচ্চ তাপমাত্রায় আটকা থেকেও তেলাপোকার হৃদপি তেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। আবার পানির নিচে ডুবে থেকেও তেলাপোকার মৃত্যু হয় না। এ অর্থে তেলাপোকাকে প্রকৃত উভচর প্রাণীর বড় উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যায়। তেলাপোকা যে উভচর প্রাণী এটা তোমরা ঘরে বসেও পরীক্ষা করে দেখতে পারো।
ইয়েস আব্বু, আমরা পরীক্ষা করব।
আচ্ছা করো। শোনো, মানুষ পানির নিচে ডুবে খুব কম সময় বেঁচে থাকতে পারে। আবার কয়েক ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রায় আবদ্ধ থাকলেও তাদের মত্যু ঘটে। অ্যাডাপট্যাশনের দিক থেকে হাতিরাও মানুষের মতো দুর্বল প্রাণী।
অ্যাডাপট্যাশন মানে কী আব্বু ?
অ্যাডাপট্যাশন হলো খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা। আরও অর্থ আছে-মানাইয়া লওয়া, অভিযোজন ইত্যাদি।
এসব তোমরা বুঝবে ? ঘরে আসতে আসতে বেগম জাহানারা বলল।
বুঝব আম্মু। আব্বু যা কিনা সুন্দর করে বলে।
আর না। গল্প আজকের মতো এখানেই শেষ। আমি লিখতে বসব। মাথায় ভূত ভর করেছে। ভূতের গল্প লিখব।
কিন্তু ভূতে তো তুমি বিশ্বাস করো না।
হয়তো ভূতে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু ভূতের গল্পগুলো খুব মজার। ভয়ে গা ছম্ছম্ করে। অনেক বাচ্চারা ভূতের গল্প পড়তে ভালোবাসে। ছেলে ভুলানো বলে একটা কথা আছে না। ছেলে ভুলানো ছড়া-গল্প আসলে বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্যই লিখতে হয়।
আচ্ছা লেখো যা ইচ্ছে। মন খারাপ করার মতো করে বলল বেগম জাহানারা।
আম্মু মন খারাপ করো না। তুমি বরং আব্বুকে বলো গল্পটা তাড়াতাড়ি লিখে ফেলতে। আমরা সবাই মিলে পড়তে পারব। তখন তুমি যত ইচ্ছে সমালোচনা করো।
পিয়াসের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল।
॥ দুই ॥
পিয়াস পড়ে শহরের নামকরা বিজ্ঞান স্কুলে। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে তার বার্ষিক পরীক্ষা। শেষ হবে আজ। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মঙ্গলবারে। সামিয়ারটা আগেই শেষ হয়েছিল। পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে সামিয়াকে নিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের আম্মু। কেন্দ্র থেকে বেরিয়েই পিয়াস বলল, আম্মু, আব্বু আসেনি ?
তোমার আব্বু এখানে আসবে না-বাসায় যাবে।
তাদের সামনে দিয়ে তখন একটা আইসক্রিমওয়ালা যাচ্ছে তার ঘণ্টায় টুংটাং শব্দ তুলে। পিয়াস ডাকল, এ্যাই আইসক্রিম !
নারে বাপ শীত পড়ে গেছে। এখন আইসক্রিম খেলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। বেগম জাহানারা বলল।
কিচ্ছু হবে না আম্মু।
পিয়াস আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে দুটি আইসক্রিম নিয়ে একটা সামিয়াকে দিতে দিতে বলল, আম্মু তুমিও খাও না একটা।
না না। তোমরাই খাও। ঠাণ্ডা লাগলে বুঝবে। বলতে বলতে পার্স খুলে আইসক্রিমওয়ালাকে টাকা দেন তিনি।
কম বয়সী একটা রিকশাওয়ালা ছেলে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। যাইবাইন খালাম্মা ?
তুমি তিনজন নিতে পারবে ? পিয়াস জিজ্ঞেস করল।
পারবাম ভাইজান।
তারা রিকশায় ওঠে বসল। ছেলেটা কষ্ট করে কোনো রকমে টেনে নিচ্ছে রিকশাটা।
তুমি এত কম বয়সে রিকশা চালাও কেন ? তাদের আম্মু জানতে চাইল।
কী করবাম খালাম্মা ? বাপটা হঠাৎ একসিডেন করল। অহন ঘরে পড়া। ছোড দুইডা ভাইবইন আছে।
তোমার বাবা কী করত ? পিয়াস জিজ্ঞস করল।
রিকশা চালাইত।
রিকশডা কি তোমাদের নিজের ? বেগম জাহানারা জানতে চাইল।
হ, রিকশাডা আমরার নিজেরই। এইডা চালাইয়া বাবায় সংসারডা চালাইত। আর আমার বিদ্যালয়ের খরচ দিত।
অহন তুমি স্কলে যাও না ?
ক্যামনে যাইয়াম ? রিকশা না চালাইলে যে না খাইয়া থাকতে অইব।
রিকশা চালাতে তোমার খুব কষ্ট হয়, না ? সামিয়া জিজ্ঞস করল।
হ বইন অয়, খুব কষ্ট অয়। বড় বড় দুইজন লোক নিয়া রিকশাডা চালাইয়া যাইতে আমার আমার বুক ফাইটা যায়। বেশি ভাড়া পাই না। আমি ছোডু দেইখা অনেক লোকে আমারে নিতে চায় না। আমি জোর কইরা যাই। এর লাগি কেউ কেউ কম ভাড়া দেয়। খারাপ লাগে তখন। কিন্তু খারাপ লাগলেও রিকশা আমার চালাইতেই অইব। লেখাপড়া শিইখা মানুষ অওয়া আমার ভাগ্যের নাই। আমার ভাগ্যে আছে রিকশা চালান, তাই চালাইতাছি।
তারা বাড়ির কাছে এসে গেছে। পিয়াস বলল, থামো, থামো।
তোমার ভাড়া কত ? বেগম জাহানারা জানতে চাইল।
খালাম্মা আপনের যা খুশি দেন।
এভাবে বললে তো লোকেরা তোমাকে ঠকাবেই।
সবাই ঠকায় না খালাম্মা।
আচ্ছা, ধরো। বেগম জাহানারা একটা দশ টাকার নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। নাও।
কিন্তু আমার কাছে যে ভাঙা টাকা নাই।
লাগবে না। নিয়ে যাও।
খালাম্মা, বিদ্যালয় ছুটির সময় আমি প্রতিদিন ওইখানে অপেক্ষা করবাম। আপনেরা আমার রিকশায় ওইঠেন।
আমরা প্রতিদিন রিকশায় উঠি না। তুমি আমাদের জন্য অপেক্ষা করো না।
আচ্ছা খালাম্মা।
পিয়াস-সামিয়া দুজনেই গম্ভীর। তাদের আম্মু বুঝতে পারে রিকশাওয়ালা ছেলেটার জন্য ওদের ভাইবোনের চিন্তা হচ্ছে। পিয়াস-সামিয়া গেল তাদের পড়ার ঘরে আর তাদের আম্মু গেল তাদের শুবার ঘরের দিকে। টেবিলে বই রাখতে রাখতে সামিয়া বলল, আচ্ছা ভাইয়া, আব্বু মরে গেলে কি তোমাকেও রিকশা চালাতে হবে ?
আল্লায় জানে।
ছেলেটার জন্য না আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার খালি মনে হচ্ছে, আমাদের আব্বু মরে গেলে তো তোমাকেও রিকশা চালাতে হবে। না হলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। বিদ্যালয়ের যাওয়া হবে না।
আমাদের আব্বু মরবে না। আর তাই এসব চিন্তা করার দরকার নেই।
কীভাবে বুঝলে আমাদের আব্বু মরবে না। মানুষ তো কত কারণেই মরতে পারে।
নিজের আব্বু সম্পর্কে এমন চিন্তা করতে নেইরে বোকা।
ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া। আম্মুকে বলো না।
আচ্ছা বলব না।
এ সময় গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে তাদের আম্মু তাদের পড়ার ঘরে এলেন। কী দাঁড়িয়ে আছ কেন যাও হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে এসো, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
পিয়াস বাথরুমের দিকে যেতে যেতে আবার জানতে চাইল, আম্মু, আব্বু কখন ফিরবে ?
কেন, আব্বুকে কী প্রয়োজন ?
প্রয়োজন আছে। কাল ভোরে কোথাও বেড়াতে যাব। আম্মু চলো না, মামার বাড়ি যাই। একমাস ছুটি।
সামিয়াও বলল, আম্মু চলো না।
মামা বাড়ি যেতে হলে তোমার আব্বুর কমপক্ষে তিনদিন ছুটি লাগবে। দেখো তোমার আব্বু ছুটি নিতে পারে কিনা। আমি তো বলেছি বন্ধের দিনগুলোয় প্রাইভেট পড়ার জন্য। এতে পরের ক্লাসের অঙ্কগুলো শেখা হয়ে যাবে। আর ইংরেজিটাও এগিয়ে থাকবে।
দুভাইবোন হাতমুখ ধুয়ে এসে টেবিলে বসল। টেবিলে একটা বাটিতে ডিম দিয়ে টোস্ট করা রুটি, আরেকটি বাটিতে স্লাইস করে কাটা আপেল। অপর একটি বাটিতে কয়েকটা কলা। তারা যখন খেতে শুরু করল তাদের আম্মু ট্রেতে করে নিয়ে এলো দুগ্লাস গরম দুধ। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। দুধ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
আম্মু আজও তাড়া দিচ্ছ ? কতদিন পর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ভাবছি একটু ধীরে-সুস্থে খাব, তোমার সঙ্গে গল্প করব। তুমি বসো না আম্মু।
কিন্তু আমাকে তো বাপ আবার রাতের রান্নায় লেগে যেতে হবে।
তা ঠিক। তোমার অনেক কাজ। মাছ-তরকারি কাটা, রান্না করা, আমাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া আবার স্কুল থেকে নিয়ে আসা।
তোমরা মানুষ হলে আমার সব কষ্ট আনন্দে পরিণত হবে। দেখো তোমাদের নিয়ে তোমার আব্বুর কত স্বপ্ন| সারাদিন খাটাখাটি করে বাড়ি ফিরে। আবার তোমাদের পড়াতে লেগে যায়।
জ্বি আম্মু। আমাদের আব্বু কত ভালো। সামিয়া বলল।
শোনো আম্মু, আজ আমি তোমাদের নিয়ে একটা ছড়া লিখেছি। নাস্তা করেই ফ্রেশ করে ফেলব। আব্বু এলে শোনাব।
আচ্ছা শুনিও। ছড়া শুনিয়ে কী লাভ কথাই তো মানো না।
আর কখনো এমন হবে না আম্মু। রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে দেখে আজ বুঝলাম বাবা না থাকলে যে কী হয়। পিয়াস বলল।
মনে থাকে যেন। আর শোনো, বন্ধের দিনগুলো প্রাইভেট পড়ে পরের ক্লাশের অঙ্ক-ইংরেজি বই শেষ করে রাখতে পারলে আগামী বছর কষ্ট কম হতো। নতুন ক্লাশের ভয়টাও থাকত না।
না আম্মু, দয়া করে বন্ধের দিনগুলোতে ক্লাশের পড়া পড়তে বলো না। আব্বু বলেছে, এই এক মাস সৃজনশীল আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই পড়ার জন্য।
তাহলে তোমার আব্বুকে বলো, নতুন কিছু বই কিনে আনতে। মামা বাড়ি কিংবা অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে বই সঙ্গে নিয়ে যাবে। বেড়াতে বেড়াতে বইও পড়া হয়ে যাবে।
ইয়াহু লক্ষ্মি আম্মু ! এটাই তো চেয়েছিলাম।
বাইরের বই পড়া ভালো। কিন্তু বেশি পড়লে ক্লাশের পড়ার ক্ষতি হয়।
আব্বু বলেছে, বাইরের বই পড়তে হয় ক্লাশের পড়া হজম করার জন্য।
হ্যাঁ, এটা ঠিক। দি মুর ইউ উইল রিড দি মুর ইউ উইল লার্ন।
আব্বু বলে, যতই পড়বে ততই মনের বন্ধ দুয়ার খুলে যাবে। ও হ্যাঁ, আব্বু বলেছে, দেশের সবগুলো শিশুকিশোর পত্রিকা যেমন সাহিত্য বিষয়ক সবুজ পাতা, টইটম্বুর, শিশু, নবারুণ ও সাতরং আর বিজ্ঞান বিষয়ক মৌলিক ও সায়েন্স ওয়ার্ল্ড এর গ্রাহক করে দেবে আমাদের। এতে ঘরে বসেই আমরা সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকাগুলো পড়তে পারব।
বাপ-পুত মিলে যা করো আমি না করব না। তবে আমার কথা একটাই প্রতিদিন ক্লাশের পড়া শিখে তবে স্কুলে যেতে হবে।
এটা কোনো ব্যাপার হলো ? এ কথা বলে পানি না খেয়েই সে পড়ার ঘরে চলে গেলো।
পিয়াস তুমি পানি খাওনি।
আম্মু তোমার ছেলে কি বড় বিজ্ঞানি হয়ে গেছে নাকি যে-পানি খাওয়ার কথা ভুলে গেছে।
তুমিও কম ভুলে যাও ?
পিয়াস দুহাত শরীরের পেছনে লুকিয়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল।
আম্মু পানিটা খাইয়ে দাও।
বা ! তুমি দেখছি দিন দিন খোকা হয়ে যাচ্ছ। হাতে কী ?
বলা যাবে না।
এই ঝিঁঝিপোকা খাওয়া শেষ কর তাড়াতাড়ি।
আম্মু ভাইয়া আমাকে আবার ঝিঁঝিপোকা বলেছে। হিয়ি ! হিয়ি ! হিয়ি ! সামিয়া নাকি কান্না শুরু করল।
পিয়াস এখন তুই একে ঝিঁঝিপোকা বললি কেন ?
ওকে তো বলিনি। আমি আসল ঝিঁঝিপোকাকেই বলেছি।
আম্মু আমি কিন্তু সত্যি কেঁদে ফেলব।
কাঁদ না একটু। আম্মু দেখুক তোর দাঁতে কত ময়লা। আম্মু ও না তিনদিন দাঁত মাজে না।
ঝিঁঝিপোকা কি দাঁত মাজে নাকি ? তুমি তো একটা বাওদা তেলাপোকা তাই বোঝ না।
তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। আম্মু বলে বাওদা, আব্বু বলে হাদা আর তুই বলিস দাদা। কী মজা !। কী মজা ! পিয়াস বাহির বাড়ির দিকে চলে গেল।
আহাঃ ! দাদা না ছাই। সে তার দুহাত মুখের দুদিকে ধরে মুখ ভেঙচালো।
সামিয়া, এটা কেমন আচরণ হলো ?
ভাইয়া যে কেমন করল।
ও তো দুষ্টুমি করেছে। আর তুমি কিনা...। বেগম জাহানারা কথা শেষ করার আগেই শেখ দরদ এসে হাজির। সে তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
রেগে গেছে তাই না ? ঠিক তোমার মতো টিকা-টিপ্পনিও বোঝে না।
হয়েছে, হয়েছে। বাসায় না এসেই তুমি আবার আমার পেছনে লেগো না। বাপ-পুত একরকম।
শেখ দরদ হাসতে হাসতে সামিয়াকে আদর করতে গেলে সামিয়া ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো।
আরে আমার পাগলি মা দেখছি আমার ওপরও রাগ করেছে।
রাগ করব না ? তুমিও তো ভাইয়ার পক্ষে কথা বললে। জানো ভাইয়া আজও আমাকে ঝিঁঝিপোকা বলেছে।
তাই নাকি ? দুষ্টু তেলাপোকাটাকে হাতের কাছে পেয়ে নিই-আজ আমি ওর চুল ছিঁড়ে দেবো। শেখ দরদের কথা শেষ না হতেই পিয়াস এসে হাজির। আব্বু তুমি এসেছে? আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তার হাতে কৌটার মধ্যে কিছু একটা জিনিস ধরা। সে কৌটা ধরা হাতটা শরীরের পেছনে লুকিয়ে রেখেছে।
পিয়াস ! এদিকে এসো। ছোট বোনকে ঝিঁঝিপোকা বলার অপরাধে আজ তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। সে পিয়াসের দিকে চোখ টিপ দিয়ে মাথার মাঝখানে একগুচ্ছ চুল চেপে ধরল। পিয়াস এমন ভান করছে যেন খুব লাগছে। কিন্তু চুল তো ছোট করে ছাটা। ফলে আঙুলে আটকে থাকে না। শেখ দরদ বার বার ধরে আর চুল খুলে যায়। আরে বাবা চুলগুলোও একটু লম্বা রাখতে পারো না ?
রাখব ক্যামনে আম্মু তো আগেভাগেই নাপিতের কাছে নিয়ে চলে যায়। পিয়াস মুখ বিষ করে বলল।
থাক আব্বু, থাক। আজকের মতো ভাইয়াকে মাপ করে দাও। সামিয়া বলল।
মাপ করে দেবো ? ঠিক আছে তুমি যখন বলছ। তবে এক শর্তে, তোমাকে আর কোনোদিন ঝিঁঝিপোকা বলবে না।
কিন্তু আব্বু আমি তো সত্যি সত্যি ওকে ঝিঁঝিপোকা বলিনি। এই দেখো, একটা ঝিঁঝিপোকা। আমার হাতে কৌটার মধ্যে। সে হাতটা নিচু করে তার আব্বুকে দেখালো।
তাই নাকি, দেখি দেখি ভাইয়া।
না, তোকে দেখাব না। তুই আমাকে মার খাইয়েছিস।
ভাইয়া, আমি কিন্তু কেঁদে ফেলব।
আব্বু দেখো তোমার মেয়ে আমাকে বারবার কেঁদে ফেলার ভয় দেখায়। হাঃ ! হাঃ ! হাঃ !
পিয়াস, আবার নিজের বোনকে তোমার মেয়ে বলছ ?
সরি আম্মু ভুল হয়ে গেছে।
পিয়াস, ঝিঁঝিপোকাটা আপুকে দেখাও।
আচ্ছা দেখাচ্ছি, যা ঘর থেকে একটা বড় দেখে শাদা কাগজ নিয়ে আয়।
সামিয়া কাগজ নিয়ে এলে পিয়াস ঝিঁঝিপোকাটা কাগজের ওপর রাখল। গাঢ় বাদামি রঙের কনি আঙুল সমান লম্বা চিকনা পোকাটা। কপালের দুপাশে লম্বা দুটি সুর। শরীরটা কিছু মসৃণ হলেও পাগুলো খস্খসে। এই খস্খসে পায়ের সাহায্যে গাছের সঙ্গে শক্ত করে লেগে থাকে ঝিঁঝিপোকারা। ঝিঁঝিপোকারা উড়তে পারে বটে কিন্তু পাখির মতো স্বচ্ছন্দ নয়। এই তেলাপোকারা যেমন উড়ে। এক উড়ায় যতুটুক যেতে পারে। প্রকৃতিতে ঝিঁঝিপোকার মতো অনেক পোকা হয়তো আছে কিন্তু ঝিঁঝিপোকার মতো এত মধুর সুর আর কোনোটি টানতে পারে কিনা আমার জানা নেই। ফাল্গুন-চৈত্রমাসে বাংলাভারতের জঙ্গলে যে অপূর্ব সুর লহরির সৃষ্টি হয় তা প্রধানত ঝিঁঝিপোকার সুর। তোমরা বড় হয়ে ভারতীয় লেখক রাসকিন বন্ডের লেখা গল্প-উপন্যাস পড়লে দেখবে প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক প্রায়শই ঝিঁঝিপোকাদের কথা বলেছেন। তবে একটা কথা, ঝিঁঝিপোকারা দিবাচর প্রাণী। রাতের অন্ধকারে হয়তো এরা ভয় পায়। তাই আলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শোনো, এরকম আরেকটা পোকা আছে। তুমি-আমি, মনে হয় আমরা সবাই ওই পোকাটা দেখেছি। লম্বায় অনেকটা ঝিঁঝিপোকার মতোই, কিন্তু ঝিঁঝিপোকার মতো এত সুন্দর না। ঝিঁঝিপোকার শরীর শক্ত আর এ পোকাটার শরীর নরম, মাংসল। কিন্তু সুর তুলে ঝিঁঝিপোকার মতোই। সম্ভবত গ্রীষ্ম-বর্ষাকালে গ্রামবাংলায় পোকাটাকে বেশি দেখা যায়। নাম উর্তুরাঙা, কোনো কোনো এলাকায় বলে উরচুঙ্গা। মুখ ও মাথার সম্মুখভাগে দুটি হাত বা পা থাকে। ভিজা নরম মাটির নিচ দিয়ে দুপায়ে ঠেলে মাটি দুপাশে সরিয়ে এঁকেবেঁকে অবলীলায় অনেক দূর চলে যেতে পারে। পড়াবাড়ির ভিটি, হলুদ মরিচের ক্ষেত যতদিন হালকা ভিজা থাকে উরচুঙ্গারা চাষ করে চলে। কিন্তু এদের মাটি চাষের সঙ্গে কেঁচোর চাষের পার্থক্য আছে। কেঁচোরা মাটির গভীরে চলে যায়। কিন্তু উরচুঙ্গারা আধাইঞ্চির নিচে কখনোই যায় না। মাটির নিচ দিয়ে উরচুঙ্গার চলার পথ দূর থেকে বোঝা যায়।
বন-জঙ্গলের কাছের বাড়িঘরে রাতে বাতি জ্বালালে ঝিঁঝিপোকাদের মতো উরচুঙ্গারাও ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রামে বাড়িঘরে সারারাত ধরে উরচুঙ্গারা গান করে। কখনো কখনো কানে তালা লেগে যায়। মনে করো, তুমি পড়তে বসেছে, একটা উরচুঙ্গা হয়তো তোমার পায়ের কাছেই কোথাও বসে সুর সেধে যাচ্ছে। তুমি অতি হয়ে বারবার খুঁজছ কিন্তু পাচ্ছ না। বর্ষাকালে উপদ্রবটা বাড়ে।
সুর আবার উপদ্রব হয় নাকি আব্বু ?
সুর তখনই উপদ্রব হয় যখন তুমি শুনতে না চাও। যখন সুর শুনে শুনে তোমার কান কাহিল হয়ে যায়।
আব্বু মনে হয় উরচুঙ্গা আমিও দেখেছি। হাতের মুঠোয় নিলে খালি ফাঁক করে বেরিয়ে যেতে চায়। তাতে হাতের তালুতে খুব সুরসুরি লাগে।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ-এটাই উরচুঙ্গা।
পিয়াস ঝিঁঝিপোকাটা হাতের তালুর ওপর নিতে চাইলে তার আব্বু বাধা দিলো। না না, খালি হাতে ধরো না, ঝিঁঝিপোকারা বিষাক্ত হতে পারে।
॥ তিন ॥
বুধবার। সন্ধ্যের দিকে সামিয়া ঘরের বারান্দায় বসে চায়ে ভিজিয়ে টোস্ট বিস্কুট খাচ্ছে। পিয়াস ক্রিকেট বেট হাতে বাহির থেকে এসে তার সামনে দাঁড়াল। মাথা থেকে ক্যাপটা খুলে সামিয়ার মাথায় লাগিয়ে দিলো। এরপর সামিয়ার হাত থেকে টোস্টটা কেড়ে নিয়ে মুখে পুরতে পুরতে জিজ্ঞেস করল, কীরে আম্মু কোথায়। আব্বু বাসায় ফিরেছে?
ভাইয়া তুমি ক্রিকেট খেলে এসেছে আর হাত না ধুয়েই টোস্ট খেয়ে ফেললে?
আম্মুকে বলিস না।
সে তখনো ঘন ঘন শ্বাস-নিঃশ্বাস টানছে। স্পষ্টই বোঝা যায় তার শরীর ঘামে ভেজা।
ভাইয়া এই শীতেও তুমি ঘেমে গেছ?
হ্যাঁ, খেললে তো ঘাম হয়।
যাও আব্বু বাসায়। দেরি করেছে ফিরেছে-বকা খেতে হবে।
আম্মু রাগারাগি করেছে?
না। তবে আব্বু তোমাকে খুজঁছিল।
পিয়াস বেটটা দুহাতে শরীরের পেছন ধরে জেরির মতো উঁকি মেরে মেরে বাসায় ভেতরে ঢুকল।
শেখ দরদ চিৎ হয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ছিল। টের পেয়ে উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, কে ?
আমি আব্বু !
খুব ভালো, এ বয়সেই রাত করে বাসায় ফিরতে শুরু করেছে।
বেটটা পড়ার ঘরে রেখে সে তার আব্বুর পাশে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। তার পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকল সামিয়া।
দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও, আগে হাতমুখ ধুয়ে এসো।
পিয়াস বাথরুমে চলে গেলে সামিয়া খালি কাপটা শোকেসের ওপর রেখে শেখ দরদের মাথার কাছে দাঁড়াল।
মা, আমার মাথাটায় একটু হাত বুলিয়ে দাও তো।
সামিয়া আব্বুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চুপিচুপি বলল, আব্বু, ভাইয়া না হাত না ধুয়েই আমার হাত থেকে টোস্ট নিয়ে খেয়ে ফেলেছে।
তাই নাকি? খুব খারাপ কথা। ঘাম-ধূলি-বালির সঙ্গে প্রচুর রোগ জীবানু থাকে। পেটে গেলে আর রক্ষে নেই। কিন্তু মা কারও গোপন কথা গোপন না রাখাও খারাপ। তোমার ভাইয়া নিশ্চয়ই এ কথা বলতে নিষেধ করেছিল। করেছিল?
জ্বি আব্বু।
আর কোনো দিন খুব জরুরি না হলে কারও গোপন কথা প্রকাশ করবে না।
ঠিক আছে আব্বু।
পিয়াস হাতমুখ ধুয়ে গামছায় হাত মছুতে মুছতে আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়াল। আব্বু, আমাদের বিদ্যালয়ে না বিজ্ঞান মেলা হবে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে। তারিখ এখনও ফাইনাল হয়নি।
শুনেছি। তোমাদের বিজ্ঞান স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
মেলার প্রধান ইভেন্ট ছাত্র-শিক্ষকদের অংশ গ্রহণে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রজেক্ট উপস্থাপন। আর দ্বিতীয় ইভেন্ট বিজ্ঞান বিষয়ক উপস্থিত বক্তৃতা।
এ সময় রান্নাঘরের দিক থেকে বেগম জাহানারা তাদের কাছে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোনটাতে অংশ গ্রহণ করতে চাও পিয়াস ?
আমি দুটোতেই অংশ গ্রহণ করতে চাই।
কীভাবে? তুমি তো জীবনে কখনো প্রজেক্ট করোনি।
করেনি তো কী হয়েছে ? এখন করবে। তোমার বন্ধু শুভকে সঙ্গে নিতে পারো।
হ্যাঁ ভাবছি।
কিন্তু ওতো পড়ে অন্যস্কুলে। বেগম জাহানারা বলল।
অন্যস্কুলে পড়লেও হবে। কারণ বিজ্ঞান মেলাটা শুধু ওদের বিদ্যালয়ের ব্যাপার নয়। এটা আন্তঃজেলা মেলা। জেলার যে কোনো বিদ্যালয়, বিদ্যালয়ের ছাত্র এতে অংশ নিতে পারবে।
তাহলে আজই একবার ফোনে শুভর সঙ্গে কথা বলো। ও যদি রাজি থাকে তাহলে একটা প্রজেক্ট নিয়ে চিন্তা শুরু করে দাও।
উপস্থিত বক্তৃতার জন্য কী করব ?
তোমার আব্বুর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাও। বেগম জাহানারা রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল।
আব্বু তুমি কি আনন্দমোহনে পড়ার সময় বিজ্ঞান মেলায় উপস্থিত বক্তৃতা দিয়ে পুরস্কার পেয়েছিল ?
হ্যাঁ। ইসলামি ফাউন্ডেশনেও বক্তৃতা দিয়ে জিতেছি।
আম্মু একদিন সার্টিফিকেট দেখিয়েছিল।
আচ্ছা আব্বু, তোমার বক্তৃতার বিষয় কী ছিল ?
হাইড্রোজেন বোমা।
তুমি তো পড়েছ অর্থনীতি নিয়ে। হাইড্রোজেন বোমা সম্পর্কে বললে কীভাবে ?
পড়াশোনা করলে পারা যায়। সব বিষয় পড়তে হয়। তুমিও পারবে।
বিচারক ম লি বিষয়টা কীভাবে নির্ধারণ করে দেয়?
বিচারক মণ্ডলির সামনে টেবিলের ওপর কতকগুলো টুকরো কাগজে বিষয়ের নাম লেখা থাকে। প্রতিযোগির নাম ডাকলে সে গিয়ে কাগজ উঠিয়ে দেখে কোন বিষয়ে তাকে বক্তৃতা দিতে হবে। লটারির মতো।
তাই নাকি? খুব ইন্টারেস্টিং তো।
আচ্ছা আব্বু হাইড্রোজেন বোমা সম্পর্কে বললে কীভাবে?
পড়াশোনা করলে পারা যায়। সব বিষয় পড়তে হয়। তুমিও পারবে।
বিচারক মণ্ডলি বিষয়টা কীভাবে নির্ধারণ করে দেয়?
বিচারক মণ্ডলির সামনে টেবিলের ওপর কতকগুলো টুকরো কাগজে বিষয়ের নাম লেখা থাকে। প্রতিযোগির নাম ডাকলে সে গিয়ে কাগজ উঠিয়ে দেখে কোন বিষয়ে তাকে বক্তৃতা দিতে হবে। লটারির মতো।
তাই নাকি? খুব ইন্টারেস্টিং তো।
আচ্ছা আব্বু হাইড্রোজেন বোমা সম্পর্কে আগে তোমার পড়া ছিল ?
না, ওই অর্থে হাইড্রোজেন বোমা সম্পর্কে আমার পড়া ছিল না। তো একটা বিষয় জানতাম। হাইড্রোজেন বোমার আবিস্কারক যে, জন অটোহান। আর সব বোমাই তো মরণাস্ত্র। কাজেই বলতে অসুবিধা হয়নি।
আমি কীভাবে প্রস্তুতি নেব ?
তোমার আম্মু আর আমি মিলে কিছু বিষয় নির্বাচন করে দেবো। তুমি আর সামিয়া বক্তৃতা দেবে।
সামিয়া? মানে এই পুচকাটা?
দেখো, প্র্যাক্টিস করলে সে তোমার চেয়েও ভালো পারবে।
আমার চেয়ে ভালো পারবে বললে কেন?
কারণ আজকাল মেয়েরা সবকিছুতেই ছেলেদের চেয়ে ভালো করছে। দেখলে না প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় সাদিয়া শিকদার ও দীপান্বিতা তিথি প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে। আর তৃতীয় হয়েছে একটা ছেলে।
আচ্ছা দেখা যাবে ও আমার চেয়ে কত ভালো বলে। এখন তুমি কিছু বিষয় নির্বাচন করে দাও।
আজই?
আজই নয়, এখনই।
ঠিক আছে। তোমার আম্মুকে ডাকো। দুটো বিষয়ের একটি নির্বাচন করব আমি আরেকটি তোমার আম্মু।
ওই তো আম্মু আসছে।
কী ব্যাপার আমাকে কেন?
শোনো, উপস্থিত বক্তৃতার একটি বিষয় নির্বাচন করবে তুমি। আরেকটি আমি।
আব্বু আমাকেও বিষয় নির্বাচন করে দাও। আমিও বক্তৃতা দেবো। সামিয়া বলল।
পিয়াস, তোমার জন্য আমার বিষয়-কম্পিউটার।
আর আমার বিষয়-মোবাইল ফোন।
দুটি বিষয়ই খুব সুন্দর হয়েছে-আমি খুশি। পিয়াস বলল।
আর সামিয়ার জন্য আমার বিষয়-ক্যালকুলেটর।
আর আমার বিষয়-খেলনা পুতুল। বেগম জাহানারা বলল।
পরশুদিন আমাদের সবার ছুটি। সেদিন বিকেলে হবে তোমাদের বক্তৃতা অনুষ্ঠান। লটারি করে প্রত্যেককে একটি বিষয়ে বলতে হবে। আমরা বক্তৃতা রেকর্ড করব। এরপর দুজনেই শুনবে কে কেমন বলেছ। খুব ভালো যে বলবে তাকে কিছু একটা পুরস্কারও আমি দেবো। বলল বেগম জাহানারা।
আমি রাজি।
আমিও। হিঃ হিঃ হিঃ।
॥ চার ॥
এরপর দুভাইবোন পড়ার ঘরে গিয়ে চিন্তামগ্ন হলো। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটে। সামিয়া আবার বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে না। একবার সে দেখল, টেবিলে বসে তার ভাইয়া কী লিখছে আর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বিড় বিড় করছে। সামিয়ার দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হলো,ভাইয়া, এ্যাই ভাইয়া!
চুপ! দেখছিস না লিখছি।
লিখছ? হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে?
লিখছি আর আবৃত্তি করছি।
ও! আমি ভাবছিলাম বিজ্ঞান মেলায় উপস্থিত বক্তৃতা দিচ্ছ।
ঠাট্টা করসি না। দেখিস বক্তৃতায় আমি ফার্স্ট হবো।
তুমি!
কেন তোর বিশ্বাস হয় না ?
হবে ক্যামনে, ক্লাশেই তো কোনোদিন ফার্স্ট হতে পারোনি।
যাহ, ক্লাশে ফার্স্ট হওয়া আর বক্তৃতায় ফার্স্ট এক জিনিস নাকি ?
তাই নাকি? মনে হয় তুমি ইচ্ছে করলেই ক্লাশে ফার্স্ট হতে পারো।
তাতো পারিই।
হয়ে দেখাও না একবার।
দেখতে চাস। আচ্ছা ভেবে দেখি। এখন চুপ কর কবিতাটা শেষ করি।
অনেকক্ষণ সামিয়া চুপ করে আছে। মনে মনে খেলনা পুতুল নিয়ে বক্তৃতা সাজাচ্ছে।
কীরে ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি ?
সামিয়া কোনো শব্দ করে না।
আরে পাগলি শুনিসনি, জ্ঞানী মানুষেরা কোনোদিন ক্লাশে ফার্স্ট হয় না।
ও তুমি জ্ঞানী মানুষ বলে ফার্স্ট হতে পারো না ?
জ্ঞানী মানুষ না কী এবার দেখিয়ে ছাড়ব।
আচ্ছা দেখিও। কাল তো ১৬ ডিসেম্বর, স্ট্যাডিয়ামে যাবে না বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ দেখতে ? জামালপুরের সলিমুল্লা এতিমখানার ছেলেমেয়েরা যা সুন্দর ডিসপ্লে করে।
দেখি আব্বু-আম্মু গেলে যাব। আমার ইচ্ছে অবশ্য মুসলিম ইনস্টিটিউটে স্বরচিত কবিতা পড়া।
ও!
ও করলি কেন ?
না, তুমি তো আবার কবি।
কবি বলে ঠাট্টা করিস না। বড় বড় কবিরাও একদিন আমার মতো ছোট ছিল।
ও!
আবার ও বেয়াদব। বড়দের সঙ্গে মশকরা করে।
না মানে, জানতে চাচ্ছিলাম তোমার কবিতা লেখা শেষ হয়েছে কিনা ?
হয়েছে।
পড়ে শোনাও।
এখন না। আরও কাটাকাটি করতে হবে। ফ্রেস করে লিখে নিই সকালে শুনাব।
আচ্ছা শুনিও।
দুভাইবোনের কথা শুনে পাশের ঘর থেকে তাদের আব্বু এলো। চলো খেতে চলো। তোমাদের আম্মু ডাকছে-শুনতে পাচ্ছ না?
আসছি আব্বু ?
এতক্ষণ কী করেছে?
ভাইয়া কবিতা লিখছে-কাল মুসলিম ইনস্টিটিউটে পড়বে।
তাই নাকি, দেখি ?
পিয়াস ছড়াটা তার আব্বুর হাতে দিলো।
বিজয় দিনের গল্প
বিজয় দিনের গল্প তোমায়
বলছি আমি শোনো
এখন থেকে পেছন দিকে
সাইত্রিশটি সাল গুনো।
তখন এদেশ করত শাসন
পাকিস্তানি লোক
কথায় কথায় মারত গুলি
ঝাঁঝরা করে বুক।
সুযোগ পেলেই ভীতু বলে
করত অপমান
কাঁদত তখন বাঙালিরা
না পেয়ে সম্মান।
তারাই একদিন পাল্টে দিলো
ইতিহাসের সুর
বুলেট বিদ্ধ হয়েও করল
পাকিস্তানি দূর।
বিজয় মিছিল পাগলা ঘণ্টি
নামল পথের পর
রেখো মনে দিবসটি সে
১৬ই ডিসেম্বর|
বা! দারুণ হয়েছে। এবার মুখস্ত করে ফেলো। নিজের লেখা মুখস্ত করা অনেক সহজ। দেখো, পড়ার স্টাইলটা আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। তুমি পড়,
পিয়াস পড়ছে,
বিজয় দিনের গল্প...
না, না শিরোনাম বলার পর কবির নাম বলতে হবে। এখন যেহেতু তুমি নিজের লেখা পড়ছ, তাই তোমাকে বলতে হবে, স্বরচিত ছড়া পড়ছি আমি পিয়াস রুবাইয়াত।
পিয়াস আবার পড়ছে। কিন্তু পড়ার মধ্যে একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে। শেখ দরদ তাকে থামিয়ে দিলো। বলল,
আরেকটু ধীরলয়ে পড়তে হবে। প্রতিটা দাড়িতে সময় দিতে হবে। শেখ দরদ নিজে পড়ে দেখাল।
কী এখন পারবে?
হ্যাঁ, পারব।
॥ পাঁচ ॥
দুপুরে মুসলিম ইনস্টিটিউটে বিজয় দিবসের স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। একটু আগেভাগেই চলে এলো সামিয়া, পিয়াস ও তাদের আম্মু। পিয়াস রিকশা থেকে নেমেই দেখল ওপাশের পাঠকক্ষের সিঁড়িতে বসে আছে তার বন্ধু শুভ। সে মনযোগ দিয়ে কিছু একটা পড়ছে। তার পাশে সিঁড়িতে হেলান দিয়ে রাখা তার ক্রাচটা। সে এ ক্রাচটির সাহায্যে হাঁটে। হাঁটুর নিচ থেকে তার ডান পাটা নেই।
আম্মু ওই শুভ।
শুভ তো প্রতিবছরই কবিতা পড়ে।
হ্যাঁ, ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড কিছু একটা পুরস্কার সে পায়য়ি।
তুমি যাও। তার সঙ্গে কথা বলো।
যাচ্ছি। কিন্তু আব্বুকে তো দেখছি না।
এক্ষনি চলে আসবে।
ফোন করে দেখি?
দেখো।
পিয়াস মোবাইলে ফোন দিলো।হ্যালো, হ্যালো আব্বু তুমি কোথায়?
এই যে ইনস্টিটিউটের কাছেই এসে গেছি।
আব্বু কাছেই এসে গেছে। চলো সিঁড়িতে গিয়ে শুভর পাশে বসি।
না তুমি যাও। আমি হলরুমে গিয়ে সামনের দিকে সিট রাখি।
আচ্ছা যাও। শুভ! শুভর পাশে গিয়ে ডাকল।
আরে পিয়াস। আমি তো মনে মনে তোমাকেই খুঁজছিলাম।
আমিও। সেদিন ফোন দিয়েছিলাম।
হ্যাঁ, আমরা তখন হাসপাতালে।
ঠিক সে সময় শেখ দরদ এসে তাদের পাশে দাঁড়াল। তাকে দেখেই শুভ বলে উঠল, আচ্ছালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
ওয়ালাইকুম আচ্ছলাম। শুভ তোমার আম্মু আসেননি।
এসেছেন, ভেতরে আছেন।
তোমার পায়ের অবস্থা এখন কেমন ?
ভালো না আঙ্কেল। আঙ্কেল, আমার নামটাই যা শুভ। আম্মুর জন্য একটা অশুভ ছায়া ছাড়া আমি কিছু না।
ছিঃ শুভ! তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলের এমন কথা বললে-চলে না। তোমার আম্মু শুনলে খুব কষ্ট পাবেন।
মাইকে বারবার ঘোষণা হচ্ছে। বাহিরে যারা অযথা ঘোরাফেরা করছেন অনুষ্ঠানস্থলে চলে আসুন। এক্ষনি শুরু হবে আমদের স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর।
আঙ্কেল চলুন ভেতরে গিয়ে বসি।
আব্বু ওই আলাপটা একটু করে নিলে হতো না ?
ও হ্যাঁ, শুভ পিয়াস তোমাকে নিয়ে বিজ্ঞান মেলায় একটা প্রজেক্ট দিতে চায়।
ভালো কথা। কিন্তু আমার শরীরটা যে ভালো যাচ্ছে না আঙ্কেল।
আমার মনে হয় সাহস করলে তুমি পারবে। একটা কিছু কঠিন চিন্তা ও কাজ নিয়ে থাকলে, আমার মনে হয়, তুমি ভালো থাকবে।
প্রজেক্ট কি কিছু ঠিক করেছ পিয়াস ?
না। তোমাকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করে ঠিক করব।
আজকের অনুষ্ঠান শেষে হলে চলো সবাই এক সঙ্গে বসি। আলাপ করি। আম্মুও তো তখন থাকবেন।
আচ্ছা অনুষ্ঠান শেষ হোক। পরে আমরা সবাই মিলে সার্কিট হাউজ মাঠে যাব। ওখানে কৃষিমেলা হচ্ছে।
ওখানে গেলে কী হবে ?
প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছু একটা ধারণা নিতে পারবে।
মানে কৃষিভিত্তিক কিছু ? শুভ জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। মনে রেখো, আমাদের দেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষির উন্নতি ছাড়া এ দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিল্পের উন্নয়ন কিংবা প্রযুক্তির উন্নয়ন যতই হোক পনেরো-বোয়াল কোটি মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা কিন্তু করতেই হবে। মানুষ তো রোবট নয় যে না খেয়ে কাজ করবে।
ঠিক বলেছেন আঙ্কেল। আমাদের কৃষি ভিত্তিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন দরকার।
এ জন্যই বলেছি কৃষি মেলায় গেলে কোনো ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
যাবো আঙ্কেল। অনুষ্ঠান শেষ হোক। আম্মুকে বলে দেখি।
॥ ছয় ॥
পিয়াস, তার আব্বু ও শুভ পেছনের একটি বেঞ্চে গিয়ে বসল। ঘোষক মাইকে ঘোষণা করল, এক্ষনি শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। আমাদের প্রথম প্রতিযোগী ফাহমিদা নাসরিন শাম্মী।
শাম্মী কবিতা পড়ছে। পিয়াস বলল, আব্বু আমার বুক টিপ টিপ করছে।
শুভ বলল, ভয় পেয়ো না। মনে করো কিছু না।
শাম্মী ভয়ে ভয়ে একরকম পড়ল তার কবিতা। শ্রোতারা সবাই হাততালি দিলো। ঘোষক দ্বিতীয় নাম ঘোষণা করলেন। এবার স্বরচিত কবিতা নিয়ে আসছে শুভ রহমান। প্রিয় দর্শক-শ্রোতা, এই একটি নামের সঙ্গে আপনারা সবাই কমবেশি পরিচিত। আমরা যখন থেকে স্বরচিত কিংবা পূর্ব নির্ধারিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান করছি সেই তখন থেকে শুভ রহমান আছে আমাদের সঙ্গে। শুভ শুধু একটি নাম নয় একটি প্রতিভা। আমরা বরাবরই এমন শুভের শুভ সূচনা করে দেয়ার জন্য অনুষ্ঠান করি। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, কত কষ্ট করে তাকে মঞ্চের দিকে আসতে হচ্ছে। হাততালি দিয়ে আপনারা তাকে উৎসাহিত করুন।
হাতাতলিতে ফেটে পড়ল হলরুম।
শুভ রহমান তার কবিতা পড়ছে।
স্বাধীনতার সীমা
স্বরচিত কবিতা পড়ছি শুভ রহমান
পাখির মতন স্বাধীন তুমি
ভাবছ কেনো মিছে
তার আকাশেও আছে দেয়াল
তাকায় খালি নিচে।
একটুখানি গাছের শাখা
কিংবা তালের পাতা
তার দেখো না ছো্ট্ট বাসা
গুঁজছে সেথায় মাথা।
গেলেও দূরে বিলের ধারে
কিংবা নদীর তীরে
সাঁঝের আগেই ফিরে যে সে
পাতার ছোট্ট নীড়ে।
এমনি দেখো যায় না সেতো
অন্য কোনো দেশে
স্বাধীনতার এই সীমানা
মানতেই হবে শেষে।
ভালোবাসার বাঁধোন বড়ো
সর্বদাই তা জেনো
পিতা-মাতা মাতৃভূমি
স্বর্গ সমান মেনো।
আবার হাতাতলিতে ফেটে পড়ল হলরুম। সবাই বলতে লাগল সুন্দর সুন্দর।
এবার ঘোষকের কণ্ঠে নতুন নাম। পর পর কয়েকজনের পর এলো পিয়াস রুবাইয়াতের নাম।
পিয়াস দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল মঞ্চের দিকে। সে শুরু করল বিজয় দিনের গল্প স্বরচিত ছাড়া পড়ছি আমি পিয়াস রুবাইয়াত।... পড়া হয়ে গেলে সে বলল, এ ছড়াটি আমি আমার প্রিয় বন্ধু শুভ রহমানকে উৎসর্গ করলাম। সবাই আবার হাততালি দিয়ে মুখরিত করে তুললো হলরুম। ঘোষক ঘোষণা করল, পিয়াস রুবাইয়াতের এ কবিতা পাঠের মধ্য দিয়েই শেষ হলো-আমাদের আজকের কবিতা পাঠ পর্ব। এখন শুরু হবে কবিতা বাছাই পর্ব। বাছাই পর্বে অংশ গ্রহণ করবেন ময়মনসিংহের সেরা কবিগণ। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছাড়াও দশম স্থান পর্যন্ত নির্বাচন করে পুরস্কার দেয়া হবে।
নিয়মানুযায়ী ফলাফল হাতে না পাওয়া পর্যন্ত বক্তব্য রাখছেন সভাপতি। তিনি বলছেন, মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে শিশু কবিদের কবিতা শুনে আমি মুগ্ধ। এই আটদশ জন কবির কবিতা শুনে আমরা নিশ্চন্ত হতে পারি যে, আগামী দিনে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভাধর কবি আমরা পাব। তরুণ কবি, ছড়াকার, গল্পকার সবার উদ্দেশ্যে আমি বলছি, তোমরা জেনে রাখো, ময়মনসিংহ গীতিকা এ অঞ্চলে রচিত হয়েছিল বলে ময়মনসিংহকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের রাজধানী। তোমরা ময়মনসিংহের এ সুনাম আরও বৃদ্ধি করবে। প্রিয় দর্শক-শ্রোতা, আজকের অনুানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় প্রতিযোগিতার ফলাফল ইতোমধ্যেই আমার হাতে পৌঁছে গেছে। ফলাফল ঘোষণা করছেন আজকের অনুানের প্রধান অতিতি ময়মনসিংহেরই কৃতি সন্তান প্রবীণ কথাসাহিত্যিক ও দ্বিতীয় চিন্তা সম্পাদক ইফফাত আরা।
ইফফাত আরার হাতে ফলাফল শিট তুলে দেয়া হলো। শিট হাতে নিতে নিতে তিনি বললেন, আজকের শিশু কবিরাই আগামীদিনের বড় কবি, দেশের প্রধান কবি। কাজেই আজকে পুরস্কার যারা পাচ্ছ তারা তো খুশি হবেই। আর যারা পাওনি তারা নিজেদের অযোগ্য মনে করো না। তোমাদের মধ্যেও বড় প্রতিভা থাকতে পারে। পরাজয় বা ব্যর্থতার জন্য থেমে গেলে চলবে না। লেগে থাকতে হবে। লেগে থাকাটাই আসল।
এখন প্রতিযোগিতায় যারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে তাদের নাম ঘোষণা করছি। তোমাদের মধ্যে তৃতীয় হয়েছ, ফাহমিদা নাসরীন শাম্মী। শাম্মী তার বসা থেকে উঠে এসে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়াল। দ্বিতীয় হয়েছ-পিয়াস রুবাইয়াত। পিয়াস রুবাইয়াত বসার স্থান ছেড়ে শাম্মীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আর প্রথম হয়েছ-শুভ রহমান।
শুভ রহমানও বসার জায়গা ছেড়ে গিয়ে শাম্মী ও পিয়াসের পাশে দাঁড়াল। প্রধান অতিথি বলে যাচ্ছেন, শুভ রহমান তুমি পাচ্ছ ২০০০ টাকার বই, একটি ক্রেস্ট ও একটি সার্টিকেট। পিয়াস রুবাইয়াত তুমি পাচ্ছ ১০০০ টাকার বই, একটি ক্রেস্ট ও একটি সার্টিকেট। শাম্মী তুমি পাচ্ছ ৫০০ টাকার বই, একটি ক্রেস্ট ও একটি সার্টিকেট। আর বাকি সাতজনের প্রত্যেকেই পাচ্ছ সান্ত্বনা পুরস্কার, একটি করে কবিতার বই।
এখন প্রথমেই পুরস্কার নিতে আসছে শুভ রহমান।
হলরুমে মহুর্মুহু করতালির মধ্য দিয়ে শুভ রহমান মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কান্নার জন্য সে কিছু বলতে পারছে না। সে বলল, তার পুরস্কার গ্রহণ করবে তার মা।
সবার অনুরোধে মঞ্চে এলেন শুভ রহমানের মা। ছেলের সঙ্গে তিনিও কাঁদছেন। সভাপতি তাকে অনুরোধ করলেন দর্শক-শ্রোতার উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য। সবার অনুরোধে তিনি বললেন,আমাকে আপনারা ক্ষমা করুন। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আমার ছেলেটা অসুস্থ। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে সে জন্মগ্রহণ করেনি। তার এ অবস্থা হয়েছে যুদ্ধের জন্য। তার পায়ে এখনো সমস্যা রয়েছে, তার যে চিকিৎসা দরকার, সত্য বলতে, তা এদেশে নেই। যুদ্ধ আমার পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে এমন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে যে, তার চিকিৎসা করার সামর্থও আমার নেই। যুদ্ধ শুধু শুভকে পঙ্গুই করেনি-পিতৃহারাও করেছে। আমি আপনাদের কাছে আমার পিতৃহারা সন্তানের জন্য দোয়া চাইছি। আপনার দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দেন।
পুরস্কার বিতরণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো অনুষ্ঠান। শুভ বলল, আঙ্কেল-আন্টি আজ কৃষি মেলায় যাওয়া সম্ভব নয়। বুঝতেই পারছেন আম্মুর মন খারাপ।
॥ সাত ॥
পিয়াস আর তার আব্বু এক রিকশায়। যাচ্ছে আগে আগে। আম্মুর সঙ্গে সামিয়া পেছনে। সামিয়া তার আম্মুকে বলল, আম্মু ভাইয়া কি তার বই আমাকে পড়তে দেবে না ?
এটা কেমন প্রশ্ন হলো সামিয়া ? তোমার ভাইয়া কোন জিনিসটা তোমাকে দেয় না ?
সরি আম্মু।
আচ্ছা আম্মু, ভাইয়া তো শুভ ভাইয়ার চেয়েও কবিতা ভালো করে পড়েছে-সে ফার্স্ট হলো না কেন ?
শুভও ভালোভাবে পড়েছে। বিচারকদের হয়তো তার পড়াটা বেশি ভালো লেগেছে।
সামিয়া আর কোনো কথা বলে না। হয়তো বেগম জাহানারার কথাগুলো একটু কড়া হয়ে গেছে।
পিয়াসও তার আব্বুকে একই প্রশ্ন করল। আচ্ছা আব্বু, আমার মনে হয়, আমি শুভর চেয়ে ভালো আবৃত্তি করেছি। তার কবিতাটাও তো
বিজয় দিবস বিষয়ক না। স্বাধীনতা বিষয়ক।
হ্যাঁ, এসব প্রশ্ন আমারও মনে জেগেছে। তবে শুভ আবৃত্তি ভালো করে।
আবৃত্তি তো আমিও খারাপ করিনি।
হ্যাঁ, তোমার আবৃত্তিও ভালো হয়েছে। ধরো, তোমরা দুজনই আবৃত্তি এক সমান করেছ, তো প্রথম তো একজনকে করতে হবে।
এটা কি একটা যুক্তি হতে পারে যে, একজনকে প্রথম করার জন্য আরেকজনকে দ্বিতীয় করতে হবে ?
না। তবে শুভর প্রতি সবার একটা সফ্ট কর্ণার রয়েছে। আমিও যদি বিচারকের আসনে থাকতাম, তাকেই প্রথম বানাতাম।
তাই নাকি...?
তুমি কি কোনো কারণে অসন্তুষ্ট ? মানে প্রথম না হতে পেরে ?
হ্যাঁ, যেহেতু এটা একটা প্রতিযোগিতা, তাই প্রথম যে হয়েছে, তাকেই করা উচিত। সেক্রিফাইসের বিষয়টা আলাদা।
মানছি তোমার কথা। তো আমাকে যদি তুমি একজন বিচারক মনে করো, তাহলে, আমার রায় আমি আগেই দিয়েছি। এতে তোমার মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কারণ নেই। বরং ভবিষ্যতে আরও ভালো করার চেষ্টা করো। আর আজকে ধরে নাও-বিচারে কোনো পক্ষপাতিত্ব হয়নি।
আচ্ছা, তোমার বন্ধু, যার উদ্দেশ্যে তুমি কবিতা উৎসর্গ করেছ, তার বিজয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে তুমি কি কপটতার পরিচয় দিচ্ছ না ?
আব্বু, আমি আসলে শুভকে ছোট করার জন্য কিংবা সে প্রথম হয়েছে এ জন্য তার প্রতি হিংসার কারণে এসব কথা বলিনি। বিশ্বাস করো। আমি শুধু বুঝতে চেয়েছি, এটা তার প্রতি করুণা কি-না। নাকি কবিতা ও আবৃত্তির প্রকৃত মূল্যায়ণ এটাই।
বা! বেশ কঠিন করে ভাবতে শিখেছে মনে হচ্ছে।
দেখতে হবে না ছেলেটা কার?
রিকশার মধ্যেই পিয়াসকে জড়িয়ে ধরে তার আব্বু। শোনো, ভুলক্রমেও এসব কথা শুভ কিংবা তার মায়ের সামনে ভাসিও না।
জ্বি আব্বু।
পেছন থেকে বেগম জাহানারা জিজ্ঞস করে, কী ব্যাপার বাপ-পুত এত খুশি যে।
পিয়াস পেছন দিকে ফিরে বলল, আজকে আব্বুর মনটা ভালো তো।
তোমার আব্বুকে বলো, রম-থ্রির রসমালাই খাওয়াতে।
ঠিক আছে, খাওয়াব। এই রিকশা থামো, থামো।
বাসা থেকে আসলে হবে না ?
আবার যে এদিকেই আসতে হবে। তার চেয়ে বরং তোমরা বাসায় যাও। আমি এক্ষনি নিয়ে চলে আসব।
॥ আট ॥
রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। শেখ দরদ, পিয়াস ও সামিয়া। বেগম জাহানারা তাদের পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে। খেতে খেতে পিয়াস জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আব্বু ভালো ইংরেজি না জানলে কি ইন্টারনেট থেকে তথ্য বের করা সম্ভব না ?
সম্ভব। ভুল বানানে প্রশ্ন লিখলেও উত্তর একটা আসবেই। এভাবে কিছুক্ষণ খুঁজলে তুমি সঠিক বানান ও আসল শব্দটাও পেয়ে যাবে। ইন্টারনেটই তোমাকে প্রশ্ন করবে, তুমি কি এটা বুঝাতে চাইছ ?
যেমন ধরো, তুমি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী পেতে চাও।
তুমি লিখবে, Kazi Nuzrul Islam, life.
মনে করো, তুমি নজরুলে নামের বানান জানো না। মনে করো, তুমি kaji nusrul eslam এই ভুল বানান লিখলে।
কম্পিউটার কতকগুলো ওয়েবসাইট তোমার সামনে হাজির করবে। একই সঙ্গে একেবারে ওপরে কর্ণারে প্রশ্ন করবে, Do you mean Kazi Nuzrul Islam ? তুমি ওখান থেকে কাজী নজরুল ইসলামের নামের সঠিক বানানটা পেয়ে যাবে। এবার সার্চ দাও, poems by Kazi Nuzrul Islam ইত্যাদি।
কী দারুণ আবিস্কার তাই না আব্বু ?
হ্যাঁ। ইন্টারনেট আবিস্কারের ফলে বিশ্বসভ্যতা কয়েক হাজার বছর এগিয়ে গেছে। আসলে কম্পিউটার আবিস্কারই পৃথিবীকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। একটি সরিষার সমপরিমাণ জায়গায় এখন কোটি কোটি তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে মানুষ এটাই কম্পিউটার আবিস্কারের সবচেয়ে বড় সফলতা। দেখো, কম্পিউটার আবিস্কারের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় কল্পনাতীত উন্নতি হয়েছে। মুঠোফোনের কথাই ধরো। এই ফোনে কত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। ঘড়ি, ক্যামেরা, দিকদর্শন যন্ত্র, টেলিভিশন, ই-মেইল (মানে চিঠি-পত্র, ডাটা আদান-প্রদান) সবই সম্ভব হচ্ছে ছোট্ট একটি মুঠোফোনের সাহায্যে।
মুঠোফোন কী আব্বু?
মোবাইল ফোনের বাংলা নাম। কবি নির্মলেন্দু গুণ এ নামটা দিয়েছেন। ও হ্যাঁ, ইন্টারনেটেরও একটা বাংলা নাম চালু হয়েছে, আন্তর্জাল।
মুঠোফোন মানে মুঠোর মধ্যে ধরা যায় যে ফোন। খুব সুন্দর বাংলা। আন্তর্জালও সুন্দর। আচ্ছা আব্বু সব বড় বড় আবিস্কার বিদেশি লোকেরা করেছে আমাদের দেশের লোকেরা করতে পারে না কেনো?
কারণ অনেক। তবে আমার মতে, সবচেয়ে বড় কারণ-বড় ত্যাগের অভাব।
সবচয়ে ছোট কারণ?
সবচয়ে ছোট কারণ-প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব। বিনিযোগ দুই ধরনের আর্থিক বিনিয়োগ ও সময় বিনিয়োগ। আমরা কোনোটাই ঠিকমত করতে পারছি না।
বুঝলাম না আব্বু।
এখন বুঝবে না। এখন থেকে দশ-পনেরো বছর পরে বুঝবে।
সামিয়া জিজ্ঞস করল, আচ্ছা আব্বু, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানি কে?
এ প্রশ্ন কেন করছ?
ভাইয়া বলল, আইনস্টাইন।
তুমি কোনো বড় বিজ্ঞানির নাম জানো?
হ্যাঁ, নিউটন। আম্মু একদিন বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানি নিউটন।
তুমি তাই বলেছিলে নাকি? বেগম জাহানারাকে জিজ্ঞেস করল শেখ দরদ।
আমি সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানি বলিনি। বলেছি সবচয়ে বড় বিজ্ঞানিদের একজন।
হ্যাঁ, তোমার আম্মুর কথাই ঠিক। আলবার্ট আইনস্টাইন, আইজাক নিউটন, টমাস আলভা এডিশন, লুই পাস্তর কেউই ছোট নয় বা বড় নয়। কারণ তাদের এক একজনের আবিস্কার একেক ক্ষেত্রে প্রধান। সবার সম্মিলিত সৃষ্টি নিয়েই বিজ্ঞানের আজকের এ অগ্রযাত্রা। ঠিক তেমনি বলা যায় না, কোন কবি বিশ্বের সেরা কবি। বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় কবি নজরুল না রবীন্দ্রনাথ?
আচ্ছা, পিয়াস তুমি বলেছ, আইনস্টাইন সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানি। কেন? তার সম্পর্কে তুমি কী জানো? তিনি কোন দেশের মানুষ?
আলবার্ট আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেন জার্মানিতে। তাঁকে বলা হয় সর্বকালের অন্যতম শ্রে বিজ্ঞানি। তিনি একজন ইহুদি। রিলেটিভিটি তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। সূত্রটি হলো, E=MC²।
ছেলের মুখে কথার খৈ ফুটছে দেখে বেগম জাহানারা ও শেখ দরদ দুজন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। তারা দুজনেই ছেলের মুখের দিকে তাকান।
কী ব্যাপার হয়নি? পিয়াসের প্রশ্ন।
হয়েছে, খুব সুন্দর হয়েছে। ধন্যবাদ।
শোনো, বিজ্ঞানি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জীবনের একটি গল্প বলছি।
একবার হলো কি, কিছু একটা বিষয়ে একটা লেখা শেষ হলে কাগজের পাতাগুলো আটকাবার জন্য একটা ক্লিপ খোঁজ করে হাতের কাছে কোথাও পেলেন না অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ও তাঁর সহকারী। আরও খোঁজাখুঁজির পর যদিও একটা ক্লিপ পেলেন সেটা দুমড়ানো, মুচড়ানো। ব্যবহারের অযোগ্য। আইনস্টাইন সেই ক্লিপটাকে সোজা করার জন্য কিছু একটা যন্ত্রের খোঁজে কয়েকটা ড্রয়ারে তল্লাশি চালালেন। একটা ড্রয়ারে তিনি এক প্যাকেট নতুন ক্লিপ পেয়ে গেলেন। কিন্তু ওই নতুন ক্লিপের একটিকে বাঁকা করে আগের সেই দুমড়ানো-মুচড়ানো ক্লিপটাকে সোজা করতে লেগে তিনি। বিষয়টা দেখে, তার সহকারী খুব অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, স্যার, এক প্যাকেট নতুন ক্লিপ থাকতে আপনি কেন একটা পুরনো ক্লিপ সোজা করার চেষ্টা করছেন।
আইনস্টাইন উত্তর দিলেন, একটা লক্ষ্য স্থির করার পর নিজেকে আমি তা থেকে বিরত করতে পারি না।
তাহলে ?
তাহলেই বোঝ লক্ষ্য কীভাবে স্থির করতে হয়। আর লক্ষ্য স্থির করার পর সেই লক্ষ্যে স্থির থাকাটা কত জরুরি।
আচ্ছা আব্বু আইনস্টাইন তো ইহুদি, তারা না কোন নবীর উম্মত ?
হযরত মূসার (আঃ)। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মসংক্রান্ত বই থেকে দেখা যায় হযরত মূসার সঙ্গে আল্লাহর ছিল দারুণ বন্ধুত্ব। তিনি পার্থিব ও অপার্থিব অনেক বিষয় নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। এমনকি তর্ক পর্যন্ত করতেন। থুর পাহাড় ছিল তাঁদের মিলনস্থান।
আর খ্রিস্টানরা ?
হযরত ঈসার (আঃ) উম্মত। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বিরা হযরত ঈসাকে বলেন প্রভু যিশু। তারা তাঁকে ঈশ্বরের পুত্র বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু মুসলমান হিসেবে আমরা তা মানতে পারি না। কারণ আমাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী আমরা আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় বলে জানি। তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করা আমাদের জন্য পাপ। ও হ্যাঁ আব্বু, ভালো কথা। আমাদের ভ্রমণের কী হলো?
মানে?
ডিসেম্বর-জানুয়বরি এই দুই মাস আমাদের ভ্রমণ করা করার কথা। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোথাও যাওয়া হলো না। তাহলে আমরা কবে থেকে বেরিয়ে পড়ব। যদি দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে তোমাদের না থাকে তাহলে চলো, ধারেকাছের জায়গাগুলোই দেখে ফেলি। আর যদি তাও যেতে না চাও, তাহলো বলো, আমরা মামার বাড়ি চলে যাই। অন্তত সাতটা দিন অন্তত ওখানে কাটিয়ে আসতে পারব।
তোমাদের আম্মু রাজি থাকলে কাল থেকেই চলো ময়মনসিংহের ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়ি। খুব কাছের একটি জায়গা থেকে শুরু করি। দর্শনীয় ও ঐতিহ্যবাহী স্থান ও স্থাপনাগুলো দেখার পাশাপাশি স্থানীয় ইহিতাস সংগ্রহ করব। ঐতিহাসিক স্থাপনা, প্রাচীন কীর্তি যেমন মসজিদ-মন্দির গীর্জা এগুলোর ছবি তুলব। সম্ভব হলে সংগ্রহ করব লোকমুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজ গল্পকাহিনী।
তাহলে কাগজ, কলম, টেপরেকর্ডার ও ক্যামেরা সঙ্গে নিতে হবে। আমি আজই এগুলো একটি থলেতে উঠিয়ে রাখব। বেগম জাহানার বলল।
তাহলে কাল আমরা কোথায় যাচ্ছি ?
পিয়াস বলল, আনন্দ মোহন কলেজ। আমাদের খুব কাছের ঐতিহাসিক স্থান। সবচেয়ে বড় কথা ওই কলেজে তুমি পড়েছ। তাই আমার মনে হয়, আমার আর সামিয়ার জন্য এই কলেজ দেখাটা বেশি জরুরি।
হ্যাঁ, ওটা তোমাদের জন্য তীর্থস্থান।
কিন্তু একটা কলেজ দেখতে কত সময় আর লাগবে?
এরপর না হয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো। বেগম জাহানার বলল।
শেখ দরদ বলল, না, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরেও কোনো একদিন যাওয়া যাবে। আনন্দমোহন কলেজের কাছেই মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি। রোডের একপাশে শশি লজ। আরেকপাশে অ্যালেকজান্ডার ক্যাসেল। শশি লজ এখন মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। আর অ্যালেকজান্ডার ক্যাসেল পুরুষ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহ এসে ওই অ্যালেকজান্ডার ক্যাসেলে রাত যাপন করেছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথই না, এখানে এসেছিলেন লর্ড কার্জন, মহাত্মা গান্ধী, স্বামী বিবেকান্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ ছাড়াও আরও অনেক মনীষী। কাজেই বুঝতেই পারছ-এ দুটি স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতখানি। আলেকজান্ডার ক্যাসেলের মূল ভবনটি এখন ওই দুটি ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এরপর যাওয়া যায়, শিল্পাচার্য জয়নূল আবেদীন সংগ্রহ শালায়। ওটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অধিদপ্তরের আওতাধীন একটি সংগ্রহ শালা। ব্রহ্মপুত্রের তীরে এর চেয়ে সুন্দর স্থান ময়মনসিংহে আর একটিও নেই। ও হ্যাঁ, একবার যেতে হবে ময়মনসিংহ জাদুঘরে। যা বাংলাদেশ প্রত্নতথ্য বিভাগের আওতাধীন। ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতহাসের অনেক নিদর্শনই তোমরা ওখানে দেখার সুযোগ পাবে।
শোনো, ময়মনসিংহ শহরের আধুনিকায়নে মুক্তাগাছার জমিদারদের অবদান অনেক। শিক্ষা-সংস্কৃতিতেও তাদের প্রভাব সৃষ্টিকারী ভূমিকা ছিল। কিন্তু গরীবের ওপর নিপীড়নও তারা কম করেনি। একটি গল্পেই তার প্রমাণ পাওয়া মেলে। মধুপুর জঙ্গলের কাঠ ছিল জমিদারদের আয়ের বিরাট উৎস। আর সেই কাঠ সংগ্রহের জন্য তারা প্রচুর হাতি পুষত। প্রজাদের প্রতি কোনো কারণে জমদিারগণ অসন্তুষ্ট হলে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতি লেলিয়ে দিতো। হাতিগুলো কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতো। প্রত্ন জাদুঘরে কটি হাতির মাথা এখনো সংরক্ষিত আছে-লোকেরা বলে এগুলো সেই জমিদারদের হাতির মাথা।
আচ্ছা আব্বু, আমরা তো শহরে থাকি। কিন্তু আমাদের গ্রাম সম্পর্কেও তো কিছু জানা প্রয়োজন। আমাদের গ্রামের কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে কি-না। দূরে কোথাও গেলে লোকেরা যদি বলে, নিজের গ্রাম সম্পর্কে জানো? আমাদের অবস্থা তো তখন রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার মতো হবে,
বহুদেশ ঘুরে, বহু ক্রোশ হেঁটে দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
শুধু দেখা হয়নি, ঘর হতে বাহিরে দুইপা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের ওপর একটি শিশির বিন্দু।
আমাদের গ্রাম সম্পর্কে যতটুকু জানা সম্ভব আমি জেনেছি। তোমাদের জানার জন্য বলছি, আমাদের গ্রামেরও গর্ব করার মতো একটা ইতিহাস আছে। এ জন্য আমি তোমাকে দুটি বইয়ের নাম বলছি। কেদারনাথ মুজমদারের ময়মনসিংহের ইতিহাস আর দরজি আব্দুল ওয়াহাবের ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন। দরজি আব্দুল ওয়াহাবের বইটা আমাদের ঘরেই আছে। আর কেদারনাথ মজুমদারের বইটা পাবে ময়মনসিংহের মুসলিম ইনস্টিটিউটে।
প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে তিন অক্ষরবিশিষ্ট নামের গ্রাম এবং এক গ্রাম ভিত্তিক ইউনিয়ন ছিল। যেমন বওলা, সিধলা, ঢাকুয়া, আগিয়া, কালিখাঁ, বালিয়া, শালিয়া, ভালকি, আকুয়া, নাগলা হুগলা ইত্যাদি। আবার একগ্রাম ভিত্তিক ইউনিয়ন ছিল, ধানীখোল, গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর (কুলিয়ারচর থানা), সাধুরপাড়া (দেওয়ানগঞ্জ থানা) এগুলো আসলে আদি গ্রাম ও ইউনিয়ন। বর্তমানে যে ১২ নং বওলা ইউনিয়নটার বাসিন্দা আমরা, আদিকালে এটা ছিল-আদি গ্রামের অখ একটা এলাকা। স্থানীয়ভাবে কথিত আছে যে, বওলা গ্রামে ১০১টি পুকুর ছিল। সেসব পুকুর কে কারা খনন করেছিল কেউ জানে না। তবে সবাই বলে পুকুরগুলো হয়েছিল গৈবি। একরাতে। এখনো কিছু কিছু পুকুর বর্তমান আছে-তোমরা দেখেছ।
হ্যাঁ, বাদ্দশখনি, চামাড়ওয়া ও সুতারনাল দিঘী।
এসব পুকুর নিয়ে অনেক গল্প আছে। তোমরা শুনলে অবাক হবে।
আব্বু একটা গল্প অন্তত বলো।
এগুলো আসলে আজগুবি গল্প। বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেমন একটি গল্প এরকম; এলাকায় কোনো অনুষ্ঠান হলে, কোনো লোক যদি দিঘীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলত, অমূক সময় এই অনুষ্ঠানের জন্য আমার এই পরিমাণ ডিকসিপাতিল লাগবে-তাহলে যথসময়ে সেই পরিমাণ ডিকসিপাতিল পানির ওপর ভেসে উঠত। অনুষ্ঠান শেষ হলে, পাত্রগুলো ধুয়ে-মুছে পুকুর পাড়ে রেখে দিলে যথাসময়ে আবার পানির নিচে চলে যেত। কিন্তু মানুষ তো লোভী, শয়তান। তারা সুন্দর জিনিসের লোভ সামলাতে না পেরে একটি-দুটি করে জিনিস প্রতিবারই রেখে দিতো। এভাবে দিনে দিনে বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এক সময় ডিকসিপাতিল সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলো।
আব্বু যে কেউ বললেই কি ডিকসিপাতিল পানির ওপর ভাসত ?
না, যার অনুষ্ঠান তাকে বলতে হতো।
গল্প শেষ হলে পিয়াস ঘরে যায়। তিনটি বড় সেলফ ভরা বই তাদের ঘরে। সে খুঁজে পায় দরজি আব্দুল ওয়াহাবের ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন বইটা। ওই বইয়ের ৮৮ থেকে ৯৩ পৃষ্টা পর্যন্ত তাদের ফুলপুর থানা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত লিপিবদ্ধ আছে। ৯২ থেকে ৯৩ পৃষ্টায় আছে তাদের বওলা ইউনিয়ন সম্পর্কে।
বওলা অঞ্চলে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য শক্তির প্রাধান্য বিস্তারের সময় আদি সর্দারি শাসন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। সুতানাল দিঘী ভিত্তিক একটি প্রাচীন কাহিনী থেকে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
এ অঞ্চলে প্রথম বহিরাগত শাসকের নাম সোমেশ্বর পাঠক। তিনি সুসঙ্গ দুর্গাপুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা (৬৮৬ বঙ্গাব্দ)। সোমেশ্বরের আগমনের সময় আদি সর্দারী শাসন প্রথার শেষাবস্থা। সর্দার শাসিত অঞ্চলগুলোকে জোয়ার বলা হতো। জোয়ারের শাসককে বলা হতো জোয়ারদার। সোমেশ্বর এসকল জোয়ারদার বা সর্দারদের পরাজিত করে সমতল ভূমির জোয়ারগুলোকে দখল ও একত্র করে বিশাল সুসঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। বওলা হচ্ছে সুসঙ্গ রাজ্যের ছয় জোয়ারের অন্যতম জোয়ার।
বওলা কেন্দ্রে সর্দারি শাসন থাকাকালে সংলগ্ন আশি বিলের পশ্চিম পাড়ে যেখানে বাদ্দশখনি দিঘী বর্তমান, একটি নদী বন্দর ও সমৃদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল বলে মনে করা হয়। সেই স্থানটির বর্তমান নাম পুরান্নগর। একটি ছোট্ট গ্রাম। নাম থেকেও গ্রামটির প্রাচীনত্বের ব্যাপারটা বোঝা যায়। আর এই পুরন্নগরই তো তোমাদের গ্রাম। বুঝতে পারছ জন্মসূত্রে কেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের অংশীদার হয়ে গেছ তোমরা? কিন্তু দুঃখজনক যে, এটা এত আগের ইতিহাস যে, এর বেশি কিছু উদ্ধার করা যায় না।
॥ নয় ॥
একদিন অফিস থেকে ফিরে শেখ দরদ পিয়াসকে বলল, তোমার স্যারেরা তোমাকে খুঁজছেন, আর তুমি কি-না স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে বসে থাকছ। শোনো, তোমার বাংলার জালাল স্যার বলেছেন, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে তোমাদের বিদ্যালয় থেকে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করবে। তোমাকে তারা সেই ম্যাগাজিনের সহকারী সম্পাদক নির্বাচন করেছে। আর জালাল স্যার নিজে সম্পাদক।
কিন্তু ওপরের ক্লাশের ছাত্র-ছাত্রীদের রেখে আমাকে স্যারেরা এ দায়িত্ব দিলেন কেন ?
তারা কেউ কি তোমার মতো গল্প-কবিতা লেখে ?
হ্যাঁ, কেউ কেউ শুনেছি লেখে।
তোমার স্যারেরা তোমাকে তাদের চেয়ে বেশি যোগ্য মনে করেছেন হয়তো।
এত বড় দায়িত্ব আমি পালন করতে পারব?
কোনো ব্যাপারই না। মনে রেখো, বড় দায়িত্ব পেলে মানুষ নিজের যোগ্যতার মূল্যায়ন করতে শেখে।
বুঝলাম না আব্বু।
না বোঝার কী আছে ? কাজ না করলে কী করে জানবে কোন কাজটা তুমি করতে পারো ?
এবার বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সহকারী সম্পাদকের কাজ বা দায়িত্ব কী তাইতো জানি না।
আমি বলে দিচ্ছি। ধরো, একটা ম্যাগাজিন তোমরা বের করবে। এর জন্য প্রথমেই স্কুলের নোটিশ বোর্ডে লেখা চেয়ে একটা বিজ্ঞাপন টানিয়ে দিতে হবে। আরও প্রচারণার জন্য ক্লাশে ক্লাশে নোটিশ পাঠাতে হবে। নোটিশে অবশ্যই লেখা জমার দেয়ার শেষ তারিখ উল্লেখ করতে হবে। এরপর জমা হওয়া লেখা থেকে ভালো লেখাগুলোর প্রাথমিক বাছাই তুমি করবে। একটি প্যাকেটে রাখবে মনোনিত লেখা আরেকটি প্যাকেটে রাখবে অমনোনিত লেখা। লেখা বাছাই করার সময় তোমাকে মনে রাখতে হবে যে, তুমি একজন বিচারক। সর্বাধিক সুন্দর লেখাটাই তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। কারও প্রতি কোনো কারণে পক্ষপাতিত্ব করার যাবে না। এমনকি যদি মনে হয়, জমাকৃত সব লেখা তোমার লেখার চেয়ে ভালো তাহলে তোমারটাও বাদ দিতে হবে। এভাবে তোমার বাছাই শেষ হলে প্যাকেট দুটি জমা দিয়ে দেবে সম্পাদকের কাছে। এরপর সম্পাদক চূড়ান্ত বাছাই সম্পন্ন করবেন এবং প্রয়োজনীয় এডিট করবেন। কাজেই সব দায়িত্ব তোমার স্যারের ওপর। তুমি শুধু তাঁকে সহযোগিতা করবে। আর তোমাকে লেখা দিয়ে সহযোগিতা করবে তোমার বন্ধুরা।
ও হ্যাঁ, তুমি নিজেও কিছু একটা লেখা জমা দিয়ে দিও।
ঠিক আছে আব্বু। আজই আমি ভাষা দিবস নিয়ে একটা ছড়া লিখে ফেলব। তুমি দেখে দিও।
রাতে বাসায় ফিরলে দিও।
এখন তাহলে কী করব?
ঘরে শিশু, সবুজপাতা. সাম্পান, সপ্তডিঙ্গা, অপূর্ব মাসিক, ছোটদের সাহিত্য ইত্যাদি পত্রিকাগুলো আছে না-ওগুলো পড়তে থাক। বিশেষ করে, ভাষা বিষয়ক ছড়াগুলো। দেখবে চমৎকার একটা আইডিয়া মাথায় এসে গেছে। আর আইডিয়াটা আসার সঙ্গে সঙ্গে লিখতে বসে যাবে। লেখার পর বার বার পড়বে, প্রয়োজনীয় কাটাকাটি করবে। এরপর ফ্রেশ করে লিখে তোমার আম্মুকে দেখাবে। তোমার আম্মু যদি ওকে করে তাহলেই আমাকে দেবে। আর তোমার আম্মু যদি ওকে না করে নতুন আরেকটি লেখা দাঁড় করাতে চেষ্টা করবে। অথবা আগের লেখাটাই বারবার এডিট করবে। মনে রেখো, আমার কোনো কোনো ছড়াও ফাইনাল হয়েছে দুতিন বছরে। আরও আশ্চর্য হবে, কোনো ছড়ার একটা ছন্দের পতন আমার অজান্তে থেকে গেলে পত্রিকার সম্পাদক তা করে দিয়েছেন। এভাবে চূড়ান্তভাবে ছাপার উপযোগী হয়েছে একটি ছড়া।
ঠিক আছে আব্বু।
আচ্ছা আব্বু তুমি তো অনুবাদ করো। আমিও কি একটা কবিতা অনুবাদ করে জমা দিতে পারি না ?
ইচ্ছে করলে পারো। তবে আমার মতে, নিজে কবি না হলে অর্থাৎ কবিতা লেখার অভ্যেস এবং একইসঙ্গে ওই রকম কবিত্ব শক্তি না থাকলে কেউ কবিতার অনুবাদ করতে পারে না। একবার নিউজলেটার-এ কবি আসাদ চৌধুরীর একটা অনুবাদ পড়েছিলাম, আমার মন খারাপ হয়েছিল।
কেন ?
ওটা ছিল দায়সারা গোছের একটা অনুবাদ। হয়তো তিনি পত্রিকার অনুরোধে কাজটা করেছিলেন। সময় দেননি। মূল কবিতাটা বার বার পড়েননি। অথচ শুনলে অবাক হবে, আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশের মূলধারার মৌলিক কবিদের মধ্যে আমার প্রিয় একজন কবি। তাঁর দুঃখিরা গল্প করে একটি প্রিয় কাব্যগ্রন্থ আমার। অনুবাদের ইংরেজি ট্রান্সলেশন। কিন্তু সাহিত্যের অনুবাদ মানে অনুবাদের মাধ্যমে সৃষ্টি।
আরেকটু পরিষ্কার করে বলো না ?
অনুবাদের মাধ্যমে একটি ভাষার সাহিত্যকর্ম নতুন একটি ভাষায় পুনঃরচিত হয়। ধরো, ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারভিশের মাই মাদার কবিতাটি আমি বাংলায় অনুবাদ করলাম।
My Mother
by Mahmoud Darwish
I long for my mother’s bread
My mother’s coffee
Her touch
Childhood memories grow up in me
Day after day
I must be worth my life
At the hour of my death
Worth the tears of my mother
And if I come back one day
Take me as a veil to your eyelashes
Cover my bones with the grass
Blessed by your footsteps
Bind us together
with a lock of your hair
With a thread that trails from the back of your dress
I might become immortal
Become a god
If I touch the depths of your heart
If I come back
Use me as wood to feed your fire
As the clothesline on the roof of your house
Without your blessing
I am too weak to stand
I am old
Give me back the star maps of childhood
So that I
Along with the swallows
Can chart the path
Back to your waiting nest
আমার মা
মায়ের হাতের রুটি খেতে আমার ইচ্ছে করে
আমার মায়ের হাতের কফি
তাঁর স্পর্শ
শৈশবের স্মৃতি আমার ভেতরে মাথা চাড়া দেয়
দিনে পর দিন
আমি অবশ্যই নিজেকে সুযোগ্য করে তুলব
আমার মৃত্যুর সময়
যাতে আমার মায়ের চোখের পানি অর্থহীন না হয়ে যায়
এবং যদি কোনো একদিন আমি ফিরে আসি
একজন ছদ্মবেশী হিসেবেই তুমি দেখো আমাকে
আর আমার হাড্ডীসার শরীর ঢেকে দিও ঘাসে
তোমার পায়ের ধূলোয় আশীর্বাদ করো
আর বেধে নিও তোমার সঙ্গে
তোমার চুলের কাঁটায়
আর সেই কাপড়ে যা তোমার পোশাক পেছন থেকে ঝুলিয়ে রাখে
আমি অবশ্যই অমর হবো
হবো উপাস্য
যদি তোমার হৃদয়ের গভীরতা আমি স্পর্শ করতে পারি
যদি ফিরে আসি আমি-আমাকে তুমি
রান্না ঘরে কাঠ-লাকড়ির মতো ব্যবহার করো
ঘরের ছাদে কাপড় শুকোনোর দড়ির মতো ব্যবহার করো
তোমার দোয়া ছাড়া
দাঁড়াবার পক্ষে খুবই দুর্বল আমি
বৃদ্ধ আমি
কৈশোরের চাঞ্চল্য দিয়ে আমাকে তুমি উদ্দীপিত করো
তাহলেই আমি
মৌসুমি পাখিদের সঙ্গে
পথের একটা রেখাচিত্র এঁকে নিতে পারব
তোমার অপেক্ষার ঘরে ফিরে আসার জন্য...
(আরবি থেকে ইংরেজি অনুবাদ-ক্যারোলিন ফর্শে ও মুনির আকাশ)
ইংরেজির সঙ্গে মিলিয়ে দেখো, আমি যদি কবিতাটা আক্ষরিক অর্থে অর্থাৎ বাক্য থেকে বাক্য অনুবাদ করতাম-তাহলে এটা আরেকটা পরিপূর্ণ কবিতা হতো না। অনুবাদে কবির ভাব, চিত্রকল্প একশতভাগ উঠে আসবে এমন আশা করা যায় না। কিন্তু কবি মাহমুদ দারভিশ আরবি ভাষায় যা বলতে চেয়েছেন, ইংরেজিতে ক্যারোলিন ফরশে ও মুনির আকাশ তা খুব কাছাকছি তুলে এনেছেন তাদের অনুবাদে। বাংলাভাষায় চেষ্টা করেছি আমি। একই কবিতার অনুবাদ অন্যেরা যখন অন্যভাবে করবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কাজেই তুমিও অনুবাদ করতে পারো। যত ইচ্ছে স্বাধীনতা নিতে পারো। কিন্তু মূল কবির ভাব ও বক্তব্য থেকে সরে যেও না। সবচেয়ে বড় কথা, যে ভাষা থেকে অনুবাদ করছ সে ভাষার ওপর তোমার ভালো দখল থাকতে হবে।
জ্বি বুঝতে পেরেছি।
শোনো, কালই তুমি একবার বিদ্যালয়ে যাও। তোমাদের জালাল স্যারের সঙ্গে দেখা করো। একুশে ফেব্রুয়ারির তো বেশি দেরি নেই। তিনি হয়তো তোমাকে কোনো দিক নির্দেশনা দেবেন।
জ্বি আব্বু।
॥ দশ ॥
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পিয়াসদের বিদ্যালয় এ উপলক্ষ্যে ভাষা শহীদদের স্মরণে ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে আর দেশের খ্যাতিমান লেখক হাসান বসিরউদ্দিনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বক্তৃতা দেয়ার জন্য। বক্তৃতা শেষে লেখক উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের লেখালেখি বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দেবেন। শেখ দরদ বলল, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। বক্তৃতাটা শোনা প্রয়োজন। আশা করি তুমিও একদুটি প্রশ্ন করবে। পারবে না ?
আব্বু তুমি যদি আগে থেকে কিছু প্রশ্ন ঠিক করে দাও।
এটা সম্ভব নয়। কারণ প্রশ্ন হবে বক্তৃতার বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। বক্তৃতাটা মনযোগ দিয়ে শুনলে অবশ্যই মনে কোনো না কোনো প্রশ্ন জাগবে। সাহস করে তখন দাঁড়িও। একটা কথা মনে রেখো, তোমার প্রশ্ন শুনে অন্যেরা বুঝবে তুমি কতটা জানো। অর্থাৎ কতটা পড়াশোনা করো।
আব্বু তুমি যদি আমার সঙ্গে থাক, তাহলে প্রশ্ন তৈরিতে তুমি আমাকে সাহায্য করবে।
সেটা পরে দেখা যাবে।
সকাল দশটায় সব ছাত্র-ছাত্রীরা বিদ্যালয়ের পোশাক পরে হাজির হয়ে গেল। পিয়াসও তার আব্বুকে নিয়ে। মাইকে স্বাধীনতা দিবসের গান বাজছে। একটার পর একটা।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না,
দুঃসহ বেদনার কণ্টক পথ বেয়ে শোষণের নাকপাশ ছিঁড়লে যারা
আমরা তোমদের ভুলব না।...
একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গায়(২)
যেতায় কোকিল ডাকে কহুকহু দোয়েল ডাকে মহুর্মহু
নদী যেতায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়।...
একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরি ও পল্লী জননী
সুরে ও ফসলে কাদা-মাটি-জলে ঝলমল করে রাখোনি।...
আচ্ছা পিয়াস, এই যে গানগুলো মাইকে বাজছে-কোন গানটা তোমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে ?
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে... গানটি অবশ্যই ভালো লাগে। তবে একটা গানের সুর আমাকে বেশি উদাস করে দেয়-সেটা হলো-একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়।
গুড।
অনুষ্ঠান শুরু হলো। ঘোষক ঘোষণা দিলো, আমাদের আজকের অনুানের প্রধান অতিথি, দেশ বরেণ্য লেখক হাসান বসিরউদ্দিন আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন। তিনি এখন আপনাদের উদ্দেশ্যে তাঁর মূল্যবান বক্তৃতা উপহার দেবেন।
হাসান বসিরউদ্দিন মঞ্চে এসে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, প্রথমেই স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত ত্রিশলাখ মানুষের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। জানিয়ে রাখছি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান, আমাদের অমূল্য সম্পদ। যখনই এসব গান আমি শুনি আবেগ আক্রান্ত হয়ে পড়ি।
তার কথা শুনে হলরুম জুড়ে মহুর্মুহু করতালি বাজতে লাগল। তিনি বলে যেতে থাকেন, সাহিত্য বিষয়ে আমার বক্তৃতা। আমি খুব বড় লেখক নই। বড় কোনো পুরস্কারও পাইনি। কিন্তু আপনারা আমাকে একজন লেখক হিসেবে আজ এখানে বক্তৃতা দানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে যে সম্মান দিয়েছেন-এজন্য নিজেকে আমি ধন্য মনে করছি। আমার সামনে বসে আছে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা। আমার কথা মূলত তাদের উদ্দেশ্যই।
বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই তাদের জীবনের শুরুতে ভালো কিছু করার কিংবা বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কেউ চায় বড় কবি হতে, কেউ বড় লেখক হতে, কেউ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে। সংখ্যায় কম হলেও কেউ কেউ চায় বিজ্ঞানি হতে। আমি মনে করি, যে যা হতে চায়, লক্ষ্য স্থির রেখে আপন মনে কাজ করে গেলে একদিন সে তা হতে পারে। গন্তব্য ঠিক করে যাত্রা শুরু করলে গন্তব্যে পৌঁছাটা যেমন সময়ের ব্যাপার মাত্র এটাও ঠিক তেমনই। সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পরিশ্রম করলে কোনো পরিশ্রমই বৃথা যায় না। যেতে পারে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় লক্ষ্যস্থির রেখে অগ্রসর হওয়া এবং ওই লক্ষ্যে অবিচল থাকাটা সত্যি খুব কঠিন। তবু সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে হবে এবং হতাশাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। নিজের ওপর আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। তবেই সফলতা আসবে।
হ্যাঁ বন্ধুরা, তোমরা যারা বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখো, বড় কবি, লেখক বা বিজ্ঞানি হতে চাও তাদের জন্য আমার কিছু পরামর্শ আছে। যদি এসব পরামর্শ মন থেকে গ্রহণ করতে পারো-সারা জীবন কাজে লাগবে।
এখনকার সময় খুবই প্রতিযোগিতার। মনে রাখতে হবে, এটা স্পেশালাইজেশনের বা বিশেষত্ব অর্জনের যুগ বলে একসঙ্গে অনেক কাজ শুরু করলে কোনোটাতেই সফল হতে পারবে না। প্রথম কথাই হলো, ক্লাশের পড়াশোনা বাদ দিয়ে কোনো কিছু করা যাবে না। প্রাতিানিক শিক্ষার গুরুত্ব সবসময়ই অনেক। যতদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ না হয়, ততদিন বরং ভেবে দেখা উচিত কোন কাজটার জন্য তুমি উপযোগী। কোন কাজটা তোমাকে বেশি টানে। কোন কাজটা করতে গেলে তুমি নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাও। যদি সেটা বিজ্ঞান হয় তবে যে কোনো মূল্যে তুমি বিজ্ঞানের দিকে অগ্রসর হও। বেশি বেশি বিজ্ঞানবিষয়ক বই পত্রিকা কিনতে থাকো, অবসর সময়টা পড়ো। আর বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে থাকো। চেষ্টা চালাও কোনো কিছু উদ্ভাবনের। এতে তোমার উদ্ভাবনী শক্তির পরীক্ষা হয়ে যাবে। আবারও বলছি এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে অবসর সময়ে, ছুটির দিনে। কারণ এতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। আর একবারের প্রচেষ্টায় কোনো বিজ্ঞানি কোনো কিছু আবিস্কার করে ফেলেছেন-এমন কথা আমার জানা নেই। বিজ্ঞানের ব্যাপারটাই এরকম যে অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে হয়।
ছোটদের কল্পনা শক্তি বিকাশের জন্য বিজ্ঞানের অনেক বই রয়েছে। বিজ্ঞানের মজার বই, আবিস্কার কাহিনী, বিজ্ঞানিদের জীবনী, সায়েন্স ফিকশন ইত্যাদি। আর রয়েছে কিছু বিজ্ঞান সাময়িকী। যেমন মৌলিক, সায়েন্স ওয়ার্ল্ড (সমপ্রতি বন্ধ হয়ে গেছে) ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশের মতো আর্থবাস্তবতার দেশে বিজ্ঞানি হিসেবে প্রতিতি হওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। পেছনে শক্তিশালী খুঁটি না থাকলে, যেমন ছিল বিজ্ঞানি জগদিশ চন্দ্র বসুর, এ ক্ষেত্রে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা। বই পত্রের যেমন অভাব, বিজ্ঞানাগারেরও তেমনই অভাব। অভাব রয়েছে ভালো শিক্ষকের। আগেই বলেছি বিজ্ঞানের ব্যাপারটা মূলত পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপার। উপযুক্ত শিক্ষকের গাইডেন্সের সঙ্গে দরকার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ বিজ্ঞানাগার। কিন্তু এসবের কোনো সুবিধাই আমাদের ছেলেমেয়েদের নেই বললেই চলে। অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ কোনো পরিবারের সন্তানের পক্ষে এই দৌড়ে বিজয়ী হওয়া আসলেই কঠিন। বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য দরকার সরকারের বিশাল সহযোগিতা। নতুন বিজ্ঞানিদের গবেষণায় খরচ হবে এমন টাকার বরাদ্দ সরকারী বাজেটে আমি হতে দেখিনি কোনোদিন। আমি বলব, এই জন্যই এদেশে বহু বছরে কোনো বিজ্ঞানির জন্ম হয় না। আমাদের দেশে আমরা বিজ্ঞানি বলি তাকে যিনি বিজ্ঞান পড়ান অথবা বিজ্ঞান বিষয়ে লেখেন।
কবি বা লেখক হওয়ার জন্যও প্রায় একই ধরনের পরামর্শ আমি দেবো। তবে কিছু ব্যাপারে ভিন্নতা রয়েছে। বিজ্ঞানের চেয়ে এ লাইনেও প্রতিষ্ঠা পাওয়া কম কঠিন নয়।
কোনো কোনো বই পড়লে নিজের ঘুমন্ত বিবেক যেমন জেগে উঠে তেমনই জেগে উঠে চিন্তাশক্তি। নতুন নতুন চিন্তা জাগ্রত হয় মাথায়। নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো, গল্পগুলো আর ভেতরে আবদ্ধ থাকতে চায় না। বেরিয়ে আসতে চায়। পড়াশোনার পরিমাণ কম হলে-বেরিয়ে আসতে চাওয়া চিন্তাগুলো সত্যি সত্যি আর বেরিয়ে আসতে পারে না। মনের বদ্ধ ঘরেই গুমড়ে গুমড়ে মরে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ভাব যখন উপযুক্ত ভাষা পায় তখন তারা বেরিয়ে আসতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক পড়াশোনা। পড়শোনা করতে করতেই একটা ভাষা তৈরি হয়ে যায়। ভাষাকে বৈচিত্র্য দান করে শব্দ। একজন চিন্তাশীল ব্যক্তির বা লেখকের শব্দ ভাণ্ডার যত সমৃদ্ধ হবে তার ভাষা তত সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় হবে। ভাষার মধ্যে কারুকাজ না থাকলে, বৈচিত্র্য না থাকলে একজন লেখক কখনোই বহুবিস্তৃত চিন্তা করতে পারেন না। চিন্তা করতে পারলেও তা প্রকাশ করতে পারেন না। হ্যাঁ, তিনি শুরু হয়তো করতে পারেন কিন্তু শেষ করতে পারেন না। এভাবে একসঙ্গে অনেক লেখা শুরু করে কোনোটাই সফলভাবে শেষ করতে না পারলে একসময় হয়তো হতাশ হয়ে লেখাই ছেড়ে দেবেন। পৃথিবীতে প্রতিদিন, প্রতিবছর এমন অনেক লেখকের জন্ম হয়, তাদের কারও কারও ভেতরে প্রচুর শক্তি ও সম্ভাবনাও থাকে। কিন্তু সঠিক দিক নির্দেশনা না থাকায় তারা ঝরে পড়ে। আবার এমন অসংখ্য সফল লেখকের নজির আমাদের সামনে আছে যারা প্রথম জীবনে কখনোই ভাবেননি লেখক হবেন। কিন্তু একটা মাত্র বই লিখে সফলতা পেয়ে সেই সফলতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একটা পর একটা বই লেখে করে অসংখ্য বইয়ের লেখক হয়ে উঠেছেন। এমনকি বড় পুরস্কার পর্যন্ত জিতে নিয়েছেন। শুনলে অবাক হবে, একান্ত হতাশা থেকে, ব্যর্থতা থেকে, কর্মহীনতা থেকে, নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনা থেকে মুক্ত হতেও কেউ কেউ কলম ধরেন। লেখক হওয়ার উদ্দেশ্য তখন পর্যন্ত তাদের থাকে না। এমনই একজন লেখকের কথা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে। তিনি চিলির লেখিকা ইসাবেল আয়েন্দে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা লেখদের মধ্যে তিনিও একজন। তাঁর প্রথম বই দি হাউজ অব দি স্পিরিটস। বইটা শুরু হয়েছিল একটা চিঠি দিয়ে। এবার তাঁর জবানীতেই শোনা যাক, তাঁর লেখক হয়ে ওঠার গল্প। আমার দাদার (বা নানা) তখন মুমূর্ষু অবস্থা, তিনি রয়েছেন চিলিতে আর আমি ভেনিজুয়েলাতে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে আমার পক্ষে চিলিতে ফেরা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় তাঁকে আমি একটি চিঠি লিখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু খুব শিগগিরই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এ চিঠি কোনেদিন তাঁর হাতে পৌঁছবে না। কোনো দিন তিনি তা পড়বেন না। এরপরও আমি লেখা বন্ধ করতে পারলাম না। বছর খানেকের মধ্যে আমার ভেতরে যা কিছু জমা হয়েছিল আমি সেসব কথা ওই চিঠিতে তুলে ধরতে চাইলাম। এভাবে চিঠিটা ভিন্নরকম কিছু হয়ে গেল। আসলে বড় কিছু লেখার চিন্তা আমার মাথায় তখন সত্যি ছিল না। অর্থাৎ উপন্যাস লেখার মতো প্রস্তুতি আমার ছিল না। এখন ভেবে দেখো, ওই চিঠিগুলো পরে হয়ে যায় উপন্যাস। প্রকাশিত হয় বই আকারে। মজার ব্যাপার, পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ এই বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, এটা লাতিন আমেরিকারই আরেক লেখক, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গেব্রিয়েল গর্সিয়া মার্কেজের উপন্যাসের শিল্পরূপ ধার করে লেখা। কিন্তু উপস্থাপন শৈলীর কারণে এটিও হয়ে গেল লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে আরেকটি জমকালো সংযোজন। তুমি দেখবে এমনি এমনি মনটাকে হালকা করার জন্য দুঃখ-কষ্টের স্মৃতিগুলো কেউ কেউ লিখতে শুরু করেন। এমনই করে বড় একটা বই রচনা হয়ে গেলেও তারা জানেন না কী হয়েছে ওটা। ইসাবেল আয়েন্দেই তো তোমাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আমার তো মনে হয় বাংলাদেশের এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ এমনই এক লেখকের নজির। তোমরা হয়তো জানো নন্দিত নরকে তাঁর প্রথম বই। ওই বইটি লেখে প্রশংসিত হয়ে পরবর্তী বইগুলো রচনার প্রেরণা তিনি পান। ছাত্র জীবনে তিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই। বিজ্ঞানের ভালো একজন ছাত্রের তো বিজ্ঞানি হওয়ার চিন্তাই মাথায় থাকার কথা, তাই না?
খোঁজ নিলে দেখবে পৃথিবীতে এমন অনেক লেখক আছেন যাঁরা জীবনের শুরুতে মোটেই লেখক হতে চাননি। লেখক হয়েছেন-যা হতে চেয়েছেন তা হতে না পেরে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শ্বেতাঙ্গ লেখিকা নাদিন গর্ডিমার বলেছেন, তিনি প্রথম জীবনে একজন ব্যালে নৃত্যশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নয় বছর বয়সে হার্টের অসুখ ধরা পড়লে ডাক্তার তাকে নাচ করতে নিষেধ করে দিলেন। ফলে নেশাটা ঘুরে গেলো বই পড়া দিকে। পড়তে পড়তে জাগলো লেখার ইচ্ছে। কিন্তু শুনলে অবাক হবে, ওই ডাক্তারের ওটা ছিল ভুল ট্রেটমেন্ট। তার হার্টে কোনো অসুখই ছিল না।
আরেকজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর কখা ধরো। তিনি মিসরীয় ঔপন্যাসিক নাগিব মাহফুজ। অঙ্কে ভালো হওয়ায় তাঁর পরিবার চেয়েছিল তিনি প্রকৌশলী হবেন। তিনিও তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু ভেতরের লেখক হওয়ার তাগিদ তাঁকে আর প্রকৌশলী হতে দিলো না।
এজন্যই বলছি ভালো লেখার সবচেয়ে ভালো এবং প্রকৃত প্রশিক্ষণটা আপনি পেতে পারেন অন্যদের বই পড়ার মাধ্যমে। বলেছেন, বুকার পুরস্কার বিজয়ী নাইজেরিয়ান বংশোদ্ভব আমেরিকান লেখিকা জ্যাডি স্মিথ। অনেকে ভাবেন কখন লিখবেন? দিনে না রাতে? আবার কেউ কেউ আছেন, সারাদিন ঘুমিয়ে সারারাত ধরে লিখেন। রাতের নির্জনতা নাকি তাদের মগজ খুলে দেয়ে। সত্যি কি আছে এ ধরনের কোনা বাধাধরা নিয়ম? না নেই। একেকজন মানুষ একেকরকম। তার চিন্তা, তার কাজকর্মের ধরন অন্যদের থেকে আলাদা। কাজেই তার লেখার সময়টাও আলাদা হতেই পারে। বিখ্যাত পাঞ্জেরী কবিতা কবি ফররুখ আহমদ কাঠপেন্সিল আর টুকরো কাগজ পকেটে রাখতেন। কবিতার লাইন মনে আসলেই ঠুকে নিতেন কাগজে। পরে বাসায় গিয়ে পুরো কবিতাটা সম্পন্ন করতেন। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক আদিব খান এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি ক্লাশ চলাকালেও ঠুকে নেন গল্প-উপন্যাসের আইডিয়া। তাঁর ছাত্ররা তখন অবাক হয়। বড় হয়ে তোমরা মার্জরিয়া কিনান রিওয়েলিংসের মাদর ইন ম্যানভিল গল্পটি পড়বে। দেখবে গল্পে তিনি এক পাহাড়ে বেড়াতে এসেছেন লেখার জন্য। আজকাল অনেক লেখক আছেন, যারা ভ্রমণ করেন লেখার মালশশলা সংগ্রহ করার জন্য। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশী বংশোদ্ভব ভারতীয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা তোমাদের বলা যায়। সোনালী দুঃখ, ইতিহাসের স্বপ্ন ভঙ্গ ইত্যাদি বইগুলো তাঁর ভ্রমণজ্ঞানের ভিত্তিেই লেখা। যাহোক, আবার জ্যাডি স্মিথের কথা শুনিয়ে এ বক্তব্যের ইতি টানি। তিনি লিখেছেন, আপনার লেখাটি কখন, কোথায় বসে আপনি লিখবেন? ছোট্ট কোনো ঘরে যেখানে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো-বাতাস নেই? তাতেও কিছু এসে যায় না। যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো শিডিউল আমি মেনে চলিনি, তাই বিকেল বেলাটাই ছিল আমার কাছে সর্বোত্তম। কিন্তু আমি সব কাজেই অত্যন্ত অলস। যখন আমার মাথা লেখার বিষয়ে ডুবে থাকে আমি তখন প্রতিদিন নটা-পাঁচটা লিখতে পারি। তখন আমি মনে রাখি না আমার ধারণা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে খুবই ভাগ্যবতী মনে করি যদি দুঘণ্টা উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত থাকতে পারি। এমন কথা অনেক শুনেছি যে, ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্য ভোর ৪টায় উঠতে হবে, তিন লিটার ব্লাক কপি গিলতে হবে এরপর ৩,০০০ শব্দ একদিনে লিখতে হবে। আবার এমন কথাও শুনেছি যে, ক্রিয়েটিভ মোমেন্ট বোঝে দুসপ্তাহে আধ ঘণ্টা করে লিখলেও কিল্লাফতে। আমি মনে করি এমন সব ধারণাই ভুল। জ্যাডি স্মিথের মতো আমিও মনে করি লেখকের কোনো নিয়ম নির্ধারিত থাকা এবং তা মেনে চলা বোধহয় সম্ভব না।
ইসাবেল আয়েন্দে বলেছেন,আমি শুধু রাতে রাতে লিখতাম, কারণ আমার একটা চাকরি ছিল। আমি একটা স্কুলে কাজ করতাম। ওখানে দুশিফট চালু ছিল। সকাল সাতটা থেকে একটা পর্যন্ত এবং একটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত। সুতরাং ওটা ছিল দিনে বারো ঘন্টার একটা চাকরি। লান্সের জন্যও কোনো বিরতি ছিল না। কাজেই শুধু রাতেই আমার পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল। যদিও আমার ছাত্ররা মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করত, তখন বলতাম, না, লেখার সময় আমি পাই না। কিন্তু ভোরে ওঠে ঠিকই লেগে যেতাম। তো কিছু করতে চাইলে সবসময় একটা উপায় আবিষ্কৃত হয়।
এবার চলো ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে যাই। জাত লেখক বা স্বভাব লেখক বা স্বভাব কবির কথা হয়তো তোমরা শুনে থাকবে। তারা কেউই কোনোদিন বড় কবি বা লেখক হওয়ার চিন্তা মাথায় নিয়ে কাজ করেন না। এমনকি তাদের অনেকেই কোনোদিন ভাবেন না, তাদের চিন্তাগুলোও মূল্যবান চিন্তা হিসেবে জগতে ঠাঁই পাবে। তাঁরা কী করেন? নিজের মনের খুশির জন্য যা মনে আসে তাই মনের মধ্যেই সাজাতে থাকেন। প্রখর স্মৃতি শক্তির কারণে এগুলো তারা অনেকদিন মনের মধ্যে লালন করেন। অন্যকে আনন্দ দেয়ার জন্য কখনো কখনো তারা সেসব প্রকাশ করেন। পরে লোকেদের মুখ থেকে মুখে চলে যায় এসব কবিতা, ছড়া, গল্প। সঙ্গে ছড়িয়ে যায় তাদের নাম। আমাদের শেখ ভানু, লালন ফকির, হাসান রাজা, প্রত্যেকেই এই ধারার স্বভাব কবি।
কিন্তু আধুনিক সময়ে এমন স্বভাব কবিদের প্রতিষ্ঠা পাওয়া আমার মনে হয় না সম্ভব। কেউ হয়তো আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন, তারপরও আমি বলব, স্বভাব কবিদের যুগ চলে গেছে। দেখবে পাঁচশো বছর আগের একজন স্বভাব কবির কাব্য অন্বেষণ করছেন এখনকার একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ব্যক্তি। কিন্তু তিনি তাঁর বাড়ির পাশে সদ্য গজিয়ে ওঠা কোনো স্বভাব কবির কবিতাকে পাত্তাই দেন না। বরং শিক্ষিত মানুষেরাই, যারা এমনসব কবি-গল্পকারদের মেধা কাজে লাগিয়ে অধিক লাভবান হন, তারাই দেখেবে, প্রথমে তাঁদের চিন্তা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রোপ করেন। পাঞ্জাবি ভাষার সর্বকালের সেরা সুফি দার্শনিক বুল্িহ শাহর কথা হয়তো তোমারা শোনোনি এখনো। তাঁর কবিতা শোনার জন্য, তাঁর চমৎকার ব্যবহারের জন্য, হতাশাগ্রস্থ মানুষেরা পথের দিশা পাবার জন্য দলে দলে তাঁর কাছে আসত। কিন্তু স্থানীয় পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবীরা সবাই তাঁর বিরোধীতা করত। এমনকি লোকেদের তারা তাঁর কাছে পৌঁছার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথাই ভাবো। তাঁর সৃষ্টিশীলতার সবচেয়ে উর্বর সময়টাতে আমাদের দেশের কিছু মুন্সি-মওলানা তাঁকে কাফের নামে আখ্যায়িত করেছে। কবি-বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে তাঁকে ব্যঙ্গ বিদ্রোপ করেছে। এমনকি কবি গোলাম মোস্তফার মতো কবিও তাকে নিয়ে প্যারোডি রচনা করেছেন।
ভালো লেখার মূলনীতি নামে একটি প্রবন্ধ আছে ড. এল এ. হিলের। তিনি লিখেছেন, যুক্তিযুক্ত লেখার জন্য প্রয়োজন যুক্তিযুক্ত উন্নত চিন্তাশক্তি। তুমি যদি পরিষ্কারভাবে লিখতে চাও তাহলে চিন্তাও তোমাকে পরিষ্কাভাবে করতে পারতে হবে। অথবা সে ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন কিছু অনুশীলনের। বিশেষ কিছু সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হবে এবং কোনো সমস্যাকে বাদ না দিয়েই অগ্রসর হতে হবে।
স্বাধীনতা শব্দটার অর্থ তো তোমরা বোঝ। যেমন আমরা বলে থাকি আমরা স্বাধীন দেশর নাগরিক। সে অর্থে আমরা স্বাধীন মানুষ। হ্যাঁ, একথাও ঠিক। কিন্তু একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে যে, আমরা কেউই বলগাহীনভাবে স্বাধীন নই। আমাদের হয়তো সবকিছু করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের হত্যা করতে পারি না। তাদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত করতে পারি না। আরেকটু বাড়িয়ে বললে বলা যায়, আমার স্বাধীনতা জন্যই আমি এমন কিছু করতে পারি না যাতে অন্যের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়। এভাবে যদি সবাই সবার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে তাহলে স্বাধীনতা পরিণত হবে স্বেচ্ছাচারিতায়|
অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত এসব কথা কেন বললাম-বুঝলে না? একজন লেখক কখনোই অন্যের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেন না। বা করতে পারেন না। তিনি বরং যেখানেই অবিচার নিপীড়ন দেখেন সেখানেই রুখে দাঁড়ান। লেখকদের পলায়ণ পর মনোভাবাপন্ন হলে চলে না। বিশ্বের দেশে দেশে লেখকগণ সব সময় সাধারণ মানুষদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। এমন অনেক লেখকের নাম এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে। তাঁদের অনেকেই সরাসরি আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ সরাসরি অংশ গ্রহণ করলেও লেখার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। যেমন, আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামীদের একজন তিনি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুভাবেই অংশ নিয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন, সরাসরি সংগ্রামী মানুষের কাতারে আসতে পারেননি। কিন্তু তাঁর কবিতা গান প্রতি মুহূর্তে আমাদের প্রেরণা যুগিয়েছে। কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট...গানটি শত সহস্র কামান রাইফেলের চেয়েও শক্তিশালী অস্ত্রের ভূমিকা পালন করেছে। আবার উপমহাদেশের একমাত্র সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ধরো। ওই উত্তাল সময়টায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশ গ্রহণ না করায় তাঁর কত সমালোচনা তখন হয়েছে। অথবা তিনি নজরুলের মতো সরাসরি আক্রমণাত্মক কবিতাও লিখেননি এ জন্য। কিন্তু পরে আমরা দেখেছি, তিনি তাঁর মতো করে প্রতিবাদ করেছেন, ভাষার নিরব শব্দে স্বাধীনতার জন্য মানুষকে প্ররোচিত করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর কবিতায় দেশে প্রেম, মানব প্রেম ছিল। যেকোনো প্রেমই শক্তি ও প্রেরণার উৎস হতে পারে। আবার তিনি জালিওনাবাগের হত্যাকান্ডের পর তাঁর নাইট খেতাব ফিরিয়ে দিয়ে সেইসব যোদ্ধাদের সহযোদ্ধার কাতারে চলে যান। আরেকজন কবির কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। তাঁর কথা না বলে প্রসঙ্গান্তরে যেতে পারছি না। তিনি চিলির বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদা। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে স্বেপ্টম্বরে ভারতের ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছে, রিপাবলিকান সরকারের বিরুদ্ধে ফাসোঁয়া ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ১৯৩৬ সালে সামরিক আগ্রাসন শুরু হলে গৃহযুদ্ধের আগুন চারপাশে ছড়িয়ে গেল। সে সময় ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সে আন্দোলনে নেরুদার অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত বীরোচিত। এ কারণে সম্মানজনক কনসোলার পদ থেকে চিলির কর্তৃপক্ষ তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছিল এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশ গ্রহণের দায়ে তাঁর কবি বন্ধু গার্সিয়া লোরকাকে সরকারের লেলিয়ে দেওয়া গুণ্ডারা ছুরিকাঘাত করলে কবি লোরকা মারা যান। ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে পুলিশ সে সময় রাফায়েল আলবার্তির বাড়িতেও তল্লাসি চালিয়েছিল। স্পেন ইন মাই হার্ট (১৯৩৬) কাব্যগ্রন্থে নেরুদার ওই ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। এসব কবিতার দ্বারা কবি নেরুদা নিজেও বদলে গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, জীবনের শিক্ষা আমি পেয়েছি মানুষের ভিড় থেকে। সে শিক্ষা নিয়েই বেরিয়ে আসতে পেরেছি, জন্ম হয়েছে ভীরু এক কবির। কিন্তু ভীরু ভয় নিয়েই একদিন চলে এলাম সবার মাঝে। তখন মনে হলো, ধন্য হয়ে গেছি; প্রয়োজনীয় সর্বাধিক সংখ্যক জনতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গেছি আমি। মহান মনুষ্য বৃক্ষের শাখায় সংযোজিত হলো আরও একটি পাতা। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ কবি-লেখকদের কোন ধরনের মানসিকতা নিয়ে বড় হতে হয়।
এল. এ. হিল বলেছেন, নিয়মিতভাবে বারবার অনুশীলন করা ভালো লেখার জন্য জরুরি। লেখেই তোমাকে লেখা শিখতে হবে। পূর্বের লেখা থেকে যতক্ষণ না তুমি অনুপ্রেরণা লাভ করবে ততক্ষণ তোমার লেখা ভালো হবে না। এমনকি অনেক বড় লেখকের কাছ থেকেও প্রেরণা পাওয়া যায় না। লেখার ৯৯% কঠোর পরিশ্রম বাকি ১% মাত্র প্রেরণা। তাই শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে লেখার অভ্যাস গড়ে তোলাই অতি উত্তম।
চোখ কান খোলা রেখে চললে তুমি তোমার চারপাশে লেখার মতো প্রচুর উপাদান পেয়ে যাবে। রাস্তায় মানুষের আলাপ-আলোচনা থেকে তুমি করতে পারো তোমার নতুন চিন্তার সূচনা। সর্ববস্থায় নিজেকে নবাগত মনে করবে এবং সবকিছু তোমার অপরিচিত এইটুকু চিন্তা মাথায় রেখে ভাবনা শুরু করো।
প্রতিদিন পত্রিকা পড়বে। তবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে। ওখান থেকে সাধারণ মানুষদের আনন্দ বেদনার কথা, জয়-পরাজয়ের কথা জানতে পারবে। অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষের নিত্য নতুন চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে অবগত হতে পারবে। এবং গ্রহণ করতে পারবে লেখার প্রয়োজনীয় উপাদান। উষ্ণ মানবীয় বোধগুলোকে উন্নত করতে চেষ্টা করবে। সর্বসাধারণের সমস্যা তাদের আনন্দ বেদনা, তাদের দুঃখ দুর্দশা আন্তরিকতার সঙ্গে অনুধাবন করা চেষ্টা করতে হবে। যাদের তুমি দেখো, যে সমস্ত ঘটনা তুমি প্রত্যক্ষ করো সেগুলোকে কাছে থেকে দেখবে। তাহলে তুমি তোমার লেখার জন্য পর্যাপ্ত উপাদান পেয়ে যাবে। সফল লেখক হওয়ার জন্য কৌতূহলোদ্দীপক লেখা লিখতে হবে। মানুষ ভেদে তাদের আকর্ষণও ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। অথচ তোমাকে লিখতে হবে সবার জন্যই। তোমাকে বুঝতে হবে কী ধরনের পাঠক তোমার জন্য অপক্ষো করছে। এবং তারা ঠিক কী ধরনের বিষয়ে আনন্দবোধ করে।
বেশিরভাগ মানুষের আগ্রহ বর্তমান নিয়ে। তারা অতীত কিংবা ভবিষ্যত নিয়েও ভাবে। তবে অবশ্যই বর্তমানের সঙ্গে সম্পর্কিত হলে। তাই সমকালীন মানুষদের সমস্যা, উদ্বেগ, অস্থিরতা ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো অভিজ্ঞতা থেকেই যতটুকু সম্ভব লেখা ভালো। নিজের অভিজ্ঞতায় যদি গভীরতা থাকে তার ওপর নির্ভর করে যতটুকু লেখা যায় অন্য কিছুতে (যেমন কল্পনা থেকে) ততটুকু লেখা যায় না।
ভালো উপস্থাপন লেখার জন্য খুবই অপরিহার্য বিষয়। শুরুতেই পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারা লেখকের একটি বড় গুণ। সহজ কথোপকথনের মাধ্যমে লেখাই উত্তম। তাছাড়া সংক্ষিপ্ত, জীবন্ত শব্দ ব্যবহারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। লেখার টেবিলে অনেক সময় যথার্থ শব্দ মনে নাও আসতে পারে, উচিত হবে যেনতেন শব্দ ব্যবহার করে কোনোরকমে লেখাটা শেষ করা। পরে সম্পাদনা করার সময় উপযুক্ত শব্দ মনে এলে অথবা ডিকশনারি দেখে তা বসিয়ে দিতে হবে। এতে চিন্তা স্রোতে কোনো রকম ব্যাঘাত ঘটে না।
লেখা শেষ করে সমালোচকের দৃষ্টিতে তা বার বার পড়তে হবে। অপ্রয়োজনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ বাক্য নির্দ্বিধায় কেটে বাদ দিয়ে নতুন শব্দ বাক্য দিয়ে ওসব স্থান পূরণ করে দিতে হবে। এটাকে বলে ঘঁষামাজা করা। লেখাকে সুন্দর, অভিজাত করার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে লেভ নিকোলাইভিচ তলস্তয়ের কন্যা লেখিকা আলেকজান্দ্রা তলস্তয়ার কথা টেনে আনা যায়। তিনি বলেছেন তাঁর বাবার লেখালেখির বিষয়ে।চাইল্ডহুড ইজ দি লেসনস অব ইউথ-এর পাণ্ডুলিপিটি তিনি সম্ভবত চার বার লিখেছিলেন এবং আমার মা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওয়ার এন্ড পিস-এর পাণ্ডুলিপিটি সাত বার নকল করে দিয়েছিলেন। প্রায় সাত বছর ধরে তিনি এ উপন্যাসটির ওপর কাজ করেছিলেন। আনা কারেনিনা লিখতে তিনি কত সময় লাগিয়েছিলেন আমি ঠিক বলতে পারছি না। তবে এটা মনে আছে তিনি ওটা শেষ করার আগে একদিন আমায় বলেছিলেন, আনা কারেনিনা লিখতে লিখতে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। তিনি ওটার পরিচ্ছদ থেকে পরিচ্ছদ কাজ করেছিলেন। তাই আমি বলব, আমার বাবা তাঁর লেখালেখির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছাত্র ছিলেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কিছু না কিছু শিখেছেন।। দেখা গেছে একই লেখা বার বার সম্পাদনা করলে প্রতিবারই কিছু না কিছু উন্নত হয়।
এখন দেখো কজন বিখ্যাত লেখক কী বলেছেন-তাঁরা কীভাবে লেখক হয়েছেন-এ প্রশ্নের উত্তরে।
খলিল জিবরান বলেছেন, আমি আমার নিজের মধ্যে পরিপূর্ণ পাকা একটি ফল। সত্যিকারভাবে এর জন্য আমি বোঝা অনুভব করি। কারও-না-কারও উচিত এগিয়ে এসে এর ভাগীদার হওয়া। এটা এমন একটা স্তর যখন একজন লেখক কলম ধরেন। তাহলে বুঝতেই পারো, শুধু ফল হলেই চলবে না ফলটাকে পাকতেও হবে। তা নাহলে তা থেকে পর্যপ্ত রসাস্বাদন সম্ভব হবে না।
লেখিকা অনিতা দেশাই বলেছেন, তখন আমি খুব ছোট। এতটুকুন বালিকা। আমাদের একটি ঘর ছিল বইয়ে ঠাসা। ওসব বইয়ের আমরা ছিলাম একনি পাঠক। আমরা সব সময় লাইব্রেরিতে যেতাম, বইয়ের দোকানে যেতাম। বিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল কীভাবে লিখতে ও পড়তে হয়। আমার মনে আছে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি আমার সবচেয়ে ভালো লাগা কাজটার মধ্যেই আত্মনিয়োগ করব। সুতরাং ওই বয়সেই আমি ছোট ছোট গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম। আমি আর কিছুই করতে চাইনি। আমি মনে করি, এটা একটা সাধারণ ধারণা যে, বইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসার জন্যই আমি লেখক হয়েছি। শব্দের বুননের দ্বারা দৃশ্যপট তৈরি করেই আমি বেশি আনন্দ পেতাম।
আদিব খান বলেছেন, মধ্যজীবনের জটিল সমস্যাগুলোই আমি মনে করি আমাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। চল্লিশের কাছাকাছি এসে চিন্তাটা মাথায় এলো, এটাই কি জীবন বা জীবনের পাওয়া? শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদান আমার পেশা। পরবর্তী বিশ-পঁচিশ বছর আমি না হয় শিক্ষাদানই করব। কিন্তু তারপর? আমি মনে করি আমাদের সবার মধ্যে সৃজনশীলতার আগুন রয়েছে এটা জাগিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শুধু সাহস এবং প্রচেষ্টা। ওই সময় স্থানান্তরের আবেগ আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করত। সুতরাং দুটি শক্তি আমার মধ্যে জড়ো হলো, বিশ্ব সাহিত্যের কোনো খোঁজ-খবর ছাড়াই, অস্ট্রেলিয়াতে যা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়, আমি এক সকালে লিখতে বসে গেলাম এবং বাংলাদেশ সম্পর্কিত আমার স্মৃতিগুলোকে ধারণার মধ্যে সমন্বিত করলাম। আমি লিখে যাচ্ছিলাম, যেভাবেই হোক বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো পরপর সাজিয়ে নিচ্ছিলাম। এভাবে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস, মাস গড়িয়ে বছর হলো। এবং এটিই আমার বইয়ের প্রথম খসড়ায় পরিণত হলো। তারপর আমার মনে হলো আমি যে খসড়াটা তৈরি করেছি এটার ঘঁষামাজা প্রয়োজন এবং বার বার তাই করলাম। মজার ব্যাপার হলো, সমগ্র বিষয়টাকে পরবর্তী দুবছর ধরে আমি পুনরায় লিখলাম। তারপর সত্যি এটি নতুন কিছু হয়ে আমাকে চমৎকৃত করল। আপনি নিশ্চয়ই তখন এটিকে একজন প্রকাশকের কাছে পাঠাতেন। কিন্তু ওই সময় আমার তত সাহস হলো না। কারণ, আমার মনে হচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়াতে হাজার পাণ্ডুলিপি প্রত্যাখ্যানের যে ধারা প্রচলিত আমারটার ভাগ্যেও তাই ঘটবে। আর যেহেতু আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত কাজেই লেখালেখির জগতে আমার পদার্পণ আপাতত স্থগিত।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক উইলিয়াম গোল্ডিং বলেছেন, ভালো লেখকেরা জন্মগ্রহণ করে তৈরি হয় না। অবশ্য বিশেষ একশ্রেণীর লেখক তৈরি হতেও পারে। তাদের মধ্যে কোনো স্ফুলিঙ্গ দেখা যায় না, নিরস গদ্য চর্চাতেই তারা ব্যস্ত থাকে। প্রেরণা শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। আমি কোনো একটি ধারণাকে মাথায় নিয়েই কেবল লিখতে বসি। আমার বইগুলো ধারণারই ছায়ামাত্র। প্রতীকগুলো আমার গল্পের অপরিহার্য অঙ্গবিশেষ।
সামপ্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত টেকনো থ্রিলার, দ্য বিঞ্চি কোডের লেখক ডেন ব্রাউন বলেছেন, ঠিক লেখকই হতে চেয়েছিলাম বলব না। কলেজে গ্রাজুয়েশন করার সময় দুটি প্রিয় কাজ ছিল আমার। একটি ফিক্শন (কল্পগল্প) লেখা আরেকটি সঙ্গীত রচনা করা। অল্প কিছুদি আমি হলিউডের কমার্শিয়াল এলাকায় ছিলাম, গান রচনা করাই ছিল নেশা। একটি গান আটলান্টার অলিম্পিক উৎসব-সঙ্গীত হিসেবে মনোয়ন পেতে পেতেও পায় নি। তখনই মনে হলো, সঙ্গীতে কখনোই ভালো করব না। এক সকালে ঘুম থেকে জেগে সিদ্ধান্ত নিলাম আবার কল্পগল্প লেখায় মনোযোগী হব। ডিজিটাল ফোর্টরেস ছিল আমার উপন্যাস লেখার প্রথম উদ্যোগ। ওটার দ্বারা আমি বেশ উৎসাহিত বোধ করেছিলাম। কারণ, ওটি প্রচুর বিক্রি হয়েছিল এবং এখনো হচ্ছে। তারপরও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না যে, কল্পনানির্ভর আরেকটি উপন্যাস লেখার মতো ধৈর্য আমার আছে কিনা।
পাকিকস্তানি বংশোদ্ভব আমেরিকান নাট্যকার, ঔপন্যাসিক মহসীন হামিদ বলেন, ছেলেবেলার স্বপ্নই আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। পড়ছিলাম অ্যাটলাসেস এবং অ্যালম্যানকস। আঁকছিলাম মানচিত্র আর কল্পনায় রচনা করছিলাম ইতিহাস। পরে যুক্তরাষ্ট্রে বসে যখন আমি উপন্যাস লিখতে শুরু করি যখন আমার দেশকে আমি খুব বেশি মিস করছিলাম।
এ বক্তৃতা শেষ করার আগে উইলিয়াম গোল্ডিং-এর একটি কথা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি। তিনি বলেছেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী নতুন লেখকদের প্রতি আমার বার্তা হলো, লেগে থাক, লিখে যাও, কখনো থেমো না, কখনো ছেড়ে দিও না।
আমার বক্তৃতা শেষ। এখন কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো। তবে প্রশ্ন করার আগে দশ মিনিট সময় দেয়া হলো ভাবার জন্য। তিনি তার জন্য নির্ধারিত আসনে বসে একগ্লাস পানি খেলেন। ঘড়ি দেখলেন, দশ মিনিট কেটে গেল। উঠে আবার এগিয়ে গেলেন মাইকের কাছে।
কী কারও কোনো প্রশ্ন।
উচ্চ শ্রেণীর একজন ছাত্র উঠে দাঁড়াল। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি বক্তৃতা দেয়ার জন্য। আপনি এমনভাবে আপনার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন মনে হয় না কোনো কথা বাকি আছে।
তুমি প্রশ্ন করবে-আলোচনা নয়।
আমরা দেখেছি আপনার বক্তৃতার একটি লিখিত স্ক্রিপ্ট আছে-এটি কি আমাদের ফটো কপি করে নেয়ার সুযোগ দেবেন?
তোমাদের বিদ্যালয়ে ইতোমধ্যেই এর কপি দেয়া হয়েছে। ইচ্ছে করলে ফটোকপি নিতে পারবে।
আরও একজন ছাত্র উঠে দাঁড়াল। স্যার আপনার আগমনের জন্য এবং অমূল্য বক্তৃতার জন্য ধন্যবাদ। জানতে চাচ্ছি, শিশুদের জন্য সায়েন্স ফিকশন কতটা উপযোগী।
শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ানোর জন্য সায়েন্স কিছুটা কাজে লাগতে পারে। তবে আমি নিজে এর প্রয়োজনীয়তা দেখি না। শিশুদের বরং বিজ্ঞানিদের জীবনী, আবিস্কার কাহিনী পড়তে দিলেই অনেক হয়। শিশুদের উপযোগী সায়েন্স ফিকশ রচনা সত্যি কঠিন।
আরেকটি ছেলে উঠে দাঁড়াল। স্যার ক্লাশে পড়িয়ে, বক্তৃতা শুনিয়ে কী লেখক তৈরি করা যায়?
প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। শোনো, ক্লাশে পড়িয়ে, বক্তৃতা শুনিয়ে লেখক তৈরি করা যায় না। তো তাকে কিছু কলকৌশল শিখিয়ে দেয়া যায়। বড় হয়ে সেসব কৌশল সে কাজে নাও লাগাতে পারে। জীবনটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। একজন যোদ্ধা অস্ত্রের ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে যায়। কিন্তু বাস্তবে যখন যুদ্ধ তাকে করতে হয়-ওইসব ট্রেনিং খুব কাজে লাগে না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়। লেখকদের বেলায়ও একইকথা প্রযোজ্য।
আর ক্লাশ মানে কী। প্রচলিত অর্থে ক্লাশ মানে হলোছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত-যেখানে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর শিক্ষক বক্তৃতা দেন। ওসব বক্তৃতা থেকে কোনো ছাত্র উপকৃত হয়, কোনো ছাত্র হয় না। কিন্তু পরীক্ষা পাস কারও আটকে থাকে না-যারা পড়াশোনা করে। আর লেখক হওয়ার ব্যাপারটা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজনের নিজের ভেতরে জেগে ওঠা। সৃজনশীল হয়ে ওঠা। এখন একজনের ভেতরের শক্তি কীভাবে, কতটা জাগ্রত হবে এটা নির্ভর করে তারই ওপর। পারিপার্শ্বিকতা থেকে সে কতটুকু গ্রহণ করতে পারে তার ওপর।
পিয়াস উঠে দাঁড়াল। স্যার, আপনার বক্তৃতা থেকে এটা বুঝতে পেরেছি যে, আসল উদ্দেশ্য মানুষ হওয়া।
হ্যাঁ, ধন্যবাদ। আসল উদ্দেশ্য মানুষ হওয়া। যে যেখানেই আছ সেখাই কাজ করো। ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা করো, নিজেদের শিক্ষিত করে তোল। তাহলেই হবে। তুমি কবি না বিজ্ঞানি হবে আগে থেকে স্থির করে হতে পারবে না। কারণ মানুষের জীবনের মোড়, চিন্তার মোড় কখন ঘুরে কেউ বলতে পারে না।
জীবনের বা চিন্তার মোড় ঘোরার একটা উদাহরণ দিই। তোফান রাফাই। এক পা খোঁড়া একটি ছেলে। কোন দেশের মানুষ সে এখন আর মনে নেই। কিন্তু তার জীবনের গল্পটা আমার মনে আছে। সে একটা ভাঙা ভেলা বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করত। কোনো বন্ধু, আত্মীয়স্বজন তার ছিল না। অভাব আর দুর্ভোগ ছিল নিত্য সঙ্গী। এভাবেই ভিক্ষে করতে করতে একদিন সে অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। কেউ একজন দয়া করে তাকে সরকারি হাসপাতালে পৌঁছে দেয়।
তার চিকিৎসা চলতে থাকে। নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অযত্ন-অবহেলা ও না খেয়ে থাকার কারণে শরীরে তার বাসা বেধেছিল অনেক রোগব্যাধি। ডাক্তারের দয়ায় উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়ায় কিছুদিনেই সে সুস্থ হতে শুরু করে। কিন্তু ডাক্তার, নার্স লক্ষ্য করে যে, সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে কোনো উদ্দীপনা নেই। সবসময় মন মরা হয়ে শুয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে বিছানায় বসে আপন মনে সে তার ভাঙা, তার ছেঁড়া ভেলাটা বাজায়। এভাবে আরও কিছুদিন চলে যায়। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরও মনমরা ভাবটা যায় না তার। ডাক্তার নার্সকে ডেকে বলে, রাফাইকে ছুটি দিন। কিন্তু রাফাই কিছুতেই হাসপাতাল থেকে যাবে না। তার এভাবে হাসপাতালে থাকতে চাওয়াটা অন্যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকায় তার প্রতি নার্সদের মায়া পড়ে গিয়েছিল। তারাও চাইত না জোর করে তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দিতে। তারা এটাও জানত যে, তার যাবার কোনো জায়গা নেই। তারা বরং ডাক্তার আসলে তাকে লুকিয়ে রাখত। একদিন এক নার্স তার জন্য কিনে নিয়ে এলো নতুন একটি ভেলা। ভেলা পেয়ে সে কী খুশি! তার খুশি দেখে ডাক্তার তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেবেই। রাফাই হাসপাতালের বারান্দায় কিংবা দূরের মাঠে বসে আপন মনে ভেলায় সুর তুলে। একদিন সবাই অবাক হয়ে শুনল, রাফাইয়ের ভেলা সুরের মুর্ছনায় কেঁদে উঠে যেন। ক্রমশ তার নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। হাপসপাতাল থেকে শহর, শহর থেকে সারাদেশ। রাফাই বাজানোর পাশাপাশি সংগীত তুলে নেয় কণ্ঠে। এরপর অল্পদিনের ব্যবধানেই সে হয়ে উঠে দেশের সেরা সংগীত তারকা। সত্যি বিস্ময়কর এ ঘটনা। জীবনের মোড়, ভাগ্যের চাকা কতভাবে যে ঘুরে!
মাইক ছেড়ে দিলেন লেখক। ঘোষক এগিয়ে এলো। ঘোষণা দিলো, প্রশ্নোত্তর পর্ব এখানেই শেষ। একই সঙ্গে শেষ হলো আজকের অনুষ্ঠান।
॥ এগারো ॥
সকাল দশটার মধ্যেই আনন্দ মোহন কলেজের সামনে পৌঁছে গেল পিয়াসদের পরিবার। গেটে দাঁড়িয়ে শেখ দরদ ওপরদিকে ইশারা করল, তোরণ চূড়ায় লেখা আছে আনন্দ মোহন কলেজ, প্রতিষ্ঠা-১৯০৮।
তাহলে তো একশ বছর পার করেছে এ কলেজটি। বেগম জাহানারা বলল।
হ্যাঁ, এইতো ২০০৮-এ।
তারা ভেতরে প্রবেশ করে ডানদিকের পথ ধরল। মূল ভবনের মধ্যচ্ছেদা দিয়ে যে পথ, সেই পথের ওপর দাঁড়িয়ে পিয়াস বলল, আব্বু, কোনো স্মৃতি কি তোমার মনে পড়ছে না ?
কেন নয়? কত কথা মনে ভাসছে।
তাহলে বলো কিছু।
এই কলেজে পড়ার সময়ের সব স্মৃতিই আমার মধুর না ? শুনলে তোমাদের খুব খারাপ লাগবে।
কেন খারাপ লাগবে আব্বু ? সামিয়া বলল।
কারণ আমার জীবনটা তখন দুঃখ-কষ্টে জর্জড়িত ছিল। বলতে পারো পথের ছেলে। কখনো কখনো পথের ছেলে আর পথের কুকুরে কোনো পার্থক্য থাকে না।
আব্বু তোমার কথা শুনে সত্যি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার।
আরও মন খারাপ হবে, যদি সব কথা শোনো।
বাংলা আর অর্থনীতি বিভাগের মাঝাখান দিয়ে তারা এগিয়ে চললো। বন্ধের দিন। বোটানি ডিপার্টমেণ্ট নিচ তলার দীর্ঘ বারান্দা খালি পড়ে আছে। তারা সেদিকে অগ্রসর হয়ে বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে বসল। ওই বারান্দায় বসলে দুতলায় অর্থনীতি বিভাগের সামনের অংশটা পুরো দেখা যায়।
দুতলার দিকে আঙুল তুলে শেখ দরদ বলল, ওই তো আমাদের ক্লাশরুমগুলো। আর ওই পশ্চিম দিকের রুমে বসতেন স্যারেরা। মনে হয় এখনো সবকিছু আগেরই মতো আছে।
দুবিল্ডিংয়ের মাঝখানের জায়গাটা দেখিয়ে শেখ দরদ বলে যাচ্ছে, এই যে বাগানটা দেখছ, আমাদের সময় এই জায়গাটা ছিল সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠের মতো। কোনো কারণে ক্লাশ অফ হয়ে গেলে দলে দলে ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে এস বসত। একদিনের কথা মনে পড়ছে, ক্লাশ ছিল না। আমরা কবন্ধু এখানে এসে ঘাসের ওপর বসলাম। সবাই ছিল খুব কাছাকছি। কিন্তু আমি কেন জানি একটু দূরে বসেছিলাম। সঞ্জীব নামে যে বন্ধুটি ছিল, সে আমাকে তাদের কাছে গিয়ে বসতে বলল। আমি গেলাম না। বন্ধুটি তখন অন্য বন্ধুদের আমাকে দেখিয়ে বলল, ওই দেখ, অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ে, এখনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়াটাও শেখেনি। এসব ছেলেরা জীবনে কী যে করবে ?
সত্যি তো, তুমি দূরে বসেছিল কেন ? বেগম জাহানারা জানতে চাইল।
এমনিই। কোনো কারণ ছিল না। আজও আমি বন্ধুদের থেকে একটু দূরেই বসি। বলতে পারো, এটাই আমার স্বভাব|
তোমার বন্ধুদের কেউ হয়তো ভাবতো তুমি খুব অহংকারী। পিয়াস বলল।
কেউ ভাবত কিনা জানি না। কিন্তু অহংকার করার মতো আমার কিছু ছিল না। আজও যেমন নেই।
এরপর তারা বারান্দা ছেড়ে আরও দক্ষিণ দিকে হাঁটে। ওখানে বাম দিকে কলেজের বিশাল অডিটরিয়ামটি। অডিটরিয়ামের সোজা উত্তর দিকে কলেজের মূল চত্বর। শেখ দরদ বলল, এই যে চত্বরটি দেখছ এখানেই ছিল কলেজের ঐতিহাসিক কৃষ্ণচূড়া গাছটি। কখন কেটে ফেলেছে কে জানে?
এরপর সর্বদক্ষিণে পুকুর পাড় ধরে তারা আরও এগিয়ে গেল। মসজিদের সামনে দিয়ে। ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রি হোস্টেলের বারান্দা ধরে হেঁটে আবার উত্তর দিকে এলো। এখানে তরুণ ছাত্রাবাস। শেখ দরদ বলল, এই ছাত্রাবাসেরই আবাসিক ছাত্র ছিলাম আমি। ওই যে দুতলার বারো নাম্বার রুমে থেকেছি। শেষে থেকেছি নিচ তলার এই দুই নাম্বার রুমটাতে। শফিক, মাইনূল আর আমি, এই তিনজন আমরা ছিলাম রুমের বর্ডার স্টুডেন্ট।
আবার তারা হাঁটতে থাকে। এবার অডিটরিয়ামের বারান্দা দিয়ে পথ। এবার তারা ক্যামেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সিঁড়িতে বসে। শেখ দরদ বলল, আনন্দ মোহন কলেজের মূল গল্পটা এখানে বসে শেষ করছি, শোনো।
১৯৮৩-১৯৮৪ ব্যাচে ম্যাথম্যাটিকস-এ অনার্স ভর্তি হলাম। ম্যথমেটিক্স আমার প্রিয় বিষয় ছিল। কিন্তু পদার্থ, রসায়ন কখনোই না। কারণ ওসব বিষয়ের রয়েছে প্র্যাক্টিক্যাল। নেত্রকোণা সরকারি কলেজে পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলাম, প্র্যাক্টিক্যাল খুব খারাপ জিনিস। প্রাইভেট পড়ে শিক্ষকদের সন্তুষ্ট করতে না পারলে প্র্যাক্টিক্যালে ভালো নাম্বার পাওয়া কঠিন হয়। তাই প্রিয় বিষয়ে ভর্তি হয়েও মনটা খুঁত খুঁত করছিল। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ম্যাথম্যাটিকস পড়ব না। অর্থনীতি পড়ব। দরখাস্ত করাই ছিল। কিন্তু ঝামেলা বাধল। ভর্তি পরীক্ষায় রিটেনে ভালো করতে পারিনি। নাম ওয়েটিং লিস্টে। বিভাগীয় প্রধান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া কিছুতেই ভর্তি করবেন না। দ্বিতীয়বার, একদিন, খুব সকালে, স্যারের সঙ্গে ডিপার্টমেন্টে দেখা করে অনুরোধ করলাম। অন্য কোনো স্যার তখন ডিপার্টমেন্টে ছিলেন না। তিনি কিছু একটা লিখছিলেন। আমার দিকে একবার তাকিয়ে একটা কাগজ টেনে ক্যালকুলাসের একটা অঙ্ক দিয়ে বললেন, যদি এটা পারো তাহলে ভর্তি করে নেবো। না পারলে, আঙুল দিয়ে দরজা দেখিয়ে বললেন, সোজা চলে যাবে।
অঙ্কটা দেখে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়লাম। পারব না জেনেও কিছু চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পর স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আর কোনো কথা নেই, তুমি আসতে পারো। বলে যে মুহূর্তে তিনি রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বাবু স্যার রুমে ঢুকলেন।
বাবু স্যার কি তোমাদের বিভাগেরই স্যার ?
হ্যাঁ, ভালো নাম আমার জানা নেই। তিনি ছিলেন খুব সুন্দর, চাল-চলনে আধুনিক, স্মার্ট। মাস ছয়েক পরে পরিকল্পনা কমিশনের একটা চাকরি নিয়ে তিনি আনন্দ মোহন কলেজ ত্যাগ করেছিলেন।
আমি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছি। মজিবুর রহমান ভূঁইয়া স্যারের শেষ কথাগুলো তাঁর কানে গিয়েছিল। তিনি একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার ? মন খারাপ কেন ?
ঘটনা বললাম।
স্যার জানতে চাইলেন, কোথাও চ্যান্স পাওনি ?
ম্যাথম্যাটিকস-এ পেয়েছি স্যার।
তাহলে ভর্তি হয়ে যাও।
স্যার আপনাকে মিথ্যে বলব না, ভর্তিও হয়েছি। কিন্তু ম্যাথম্যাটিকস পড়তে আমার ইচ্ছে করছে না।
আচ্ছা ঠিক আছে, বলো তো আমি অঙ্কে কাঁচা ইংরেজি কী ?
বললাম, আই অ্যাম ডাল ইন ম্যাথম্যাটিকস, আই অ্যাম ইনডিপারেন্ট টু ম্যাথম্যাটিকস, আই অ্যাম উইক ইন ম্যাথম্যাটিকস, আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম।
স্যার বললেন, থামো থামো। দারুণ বলেছ তো।
ঠিক সেই মুহূর্তে মজিবুর রহমান ভঁইয়া স্যার আবার রুমে ফিরে এলেন।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ ?
বাবু স্যার বললেন, স্যার, ওকে ভর্তি করে নিন।
ও তো অঙ্ক মোটেই পারে না।
কী বলেন স্যার, ওতো ম্যাথমেটিকস ভর্তি হয়েছে।
তাহলে ম্যাথমেটিকসই পড়ুক।
না স্যার, ওর ইচ্ছে অর্থনীতি পড়বে। স্যার ও খুব ভালো ইংরেজি জানে।
তাই নাকি ? আচ্ছা, তুমি যখন বলছ-নিয়ে নিলাম।
এভাবেই আনন্দ মোহন কলেজে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয় আমার। শুনলে অবাক হবে, অর্থনীতিতে ভর্তি হওয়ার আগে কোনোদিন আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে, অর্থনীতি নিয়ে আমি পড়াশোনা করব।
তাহলে পড়লে কেন ? ম্যাথ পড়লেই ভালো হতো।
হ্যাঁ, আমারও মনে হয় ম্যাথ পড়লেই আমি ভালো করতাম। তবে এটাও সত্য যে, সাবসিডিয়ারি বিষয়ের প্র্যাক্টিক্যালের ভয়েই আমি ম্যাথ পড়িনি।
প্র্যাক্টিক্যালের ভয় কেন ?
ওই যে বলেছি, প্রাইভেট পড়তে হয়। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে শিক্ষকদের তোয়াজ করতে হয়।
শিক্ষকগণ যখন শিক্ষাগুরু তোয়াজ তো করাই উচিত ?
শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করা আর তোয়াজ করা এক জিনিস নয়-বাপধন। রবীন্দ্রনাথও একথা জানতেন।
তুমি একদিন বলেছিলে, রবীন্দ্রনাথ আনন্দ মোহন কলেজে এসেছিলেন ?
হ্যাঁ, এ কথা জেনেছি আনন্দ মোহনে ভর্তি হওয়ার অনেক বছর পড়ে। রবীন্দ্রনাথের কথায় যাওয়ার আগে শোনো যাঁর নামে আনন্দ মোহন কলেজের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর কথা। তিনি আনন্দ মোহন বসু। প্রথম ভারতীয় রেঙলার, বিজ্ঞানাচার্য স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর ভগ্নিপতি। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ মোহন বসু ময়মনসিংহ শহরের রামবাবু রোডে প্রতিষ্ঠা করেন ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউট। পরে ইনস্টিটিউটের নামকরণ করা হয় সিটি কলিজিয়েট স্কুল। পরে ব্রাহ্মসমাজ ১৮ জুলাই ১৯০১, কলকাতা সিটি কলেজের একটি অ্যাফিলিয়েট ব্রাঞ্চ এখানে চালু করে। আর আনন্দ মোহন বসুর মৃত্যুর পর ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে কলেজ ব্রাঞ্চটি বন্ধ হয়ে যায়। দুবছর পর ময়মনসিংহের একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, যার নাম ছিল ব্লাকওড, কলেজ শাখাটি পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেন। এই প্রক্রিয়ায় কলেজটির নতুন নামকরণ হয় আনন্দ মোহন কলেজ। প্রফেসর বৈকণ্ঠ কিশোর চক্রবর্তী ছিলেন এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয় এবং চালু হয় বাংলা ও ইতিহাসের বিষয়ের ওপর অনার্স কোর্স। আজকের আনন্দ মোহন কলেজ আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।
কেমন ?
ওই দেখো, পুকুরের পাড়ে পাড়ে ছেলেদের হোস্টেল। পাকা করা প্রতিটি ঘাট। পুকুরের কোণে কোণে পথের শিমুল-কৃষ্ণচূড়া গাছ। আমার মনে হয়, সিজনে যখন সবুজ ঘাসের ওপর রক্তলাল শিমুল আর কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়ে বড় সুন্দর লাগে।
আগে এরকম ছিল না?
ছিল। কিন্তু বিল্ডিংগুলো এত গুছানো ছিল না। পথ-ঘাট এত পরিপাটি ছিল না।
আর রবীন্দ্রনাথ জানি কবে এসেছিলেন ?
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি। এটাই আনন্দ কলেজের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা।
আচ্ছা তখন কবির সঙ্গে কে কে ছিলেন ?
তখন কবির সঙ্গে ছিলেন তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পত্রবধূ প্রতিমা দেবী এবং বিশ্বভারতীর কজন অধ্যাপক। কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের পক্ষ থেকে সেদিন রবীন্দ্রনাথকে দেয়া হয়েছিল এক আবেগময় সংবর্ধ্বনা।
আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ কী করলেন এখানে এসে ?
রবীন্দ্রনাথ ছাত্র-শিক্ষকদের সংবর্ধ্বনার উত্তরে একটি দীর্ঘ ভাষণ প্রদান করেছিলেন। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন,... উপদেষ্টা ও শ্রোতার ভিতরে আবহমানকাল থেকে একটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে আসছে যা কোনদিনই যাবার নয়, আর যা চিরদিন শিক্ষককে ছাত্র হতে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছে। আমি আজ ক্ষণকালের জন্য তোমাদের কাছে কিছু বলে যাব সেই চিরন্তন ব্যবধান অতিক্রম করার জন্য। আমি শান্তি নিকেতনের ভিতরেও এ ভেদ দূর করতে চেষ্টা করছি। যখনই সেখানকার ছাত্রদের সঙ্গে মিশতে চেয়েছি, তখনই তাদের সুখদুঃখের ভার নিয়ে মিশেছি। গুরুশিষ্যের সম্মানের দূরত্বের ওপর দাঁড়িয়ে কখনও কোন কাজ করিনি, বয়স্যভাবে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমার বিশ্বাস, বাইরে যাই থাক অন্তরে অন্তরে সমবয়সী না হলে তাদের সঙ্গে কোন কথা বলা চলতে পারে না।... রবীন্দ্রনাথের ওই ভাষণ ২৫ জানুয়ারি ১৯২৬ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল বর্তমান শিক্ষার দুগর্তি শিরোনামে।
আচ্ছা আব্বু ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এভাবে ভেবেছিলেন কেন ?
কারণ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল জটিল। ছাত্র জানত না শিক্ষককের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কী ? পিতা-পুত্রের সম্পর্ক নাকি বন্ধুত্বের ? নাকি গুরু-শিষ্যের। আমি বলব, বিষয়টা এখনো পরিস্কার না। ফলে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক এখনো রবীন্দ্রনাথের সময়ের মতোই জটিল রয়ে গেছে। ফলে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে দূরত্ব দিন দিন কমলেও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি।
আচ্ছা তোমাদের সময়ে আনন্দ মোহন কলেজে কত ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করত তুমি জানো ?
হ্যাঁ, আঠারো হাজার।
এত ?
হ্যাঁ, এ অঞ্চলের সবচেয়ে নামকরা কলেজ যে।
আচ্ছা আব্বু, এত ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে তো তোমার আনন্দে থাকার কথা। তাহলে দুঃখ-কষ্টের কারণ ?
কারণ আমার অভাব। দেড় বছর ব্রহ্মপুত্রের অপর পাড়ে, কমপক্ষে চার মাইল দূরে, গোবিন্দপুরে লজিং থেকেছি। এরপর অসুস্থ হয়ে ভর্তি হলাম হাসপাতালে। যখন কিছুটা সুস্থ হলাম লজিং ছেড়ে গিয়ে উঠলাম বড় বাজারের মনির উদ্দিন মুন্সির ভাঙা দুতলার মেসে। মনির উদ্দিন মুন্সির মেস পর্যন্ত পৌঁছতে আমাকে কত না সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। স্থানাভাবে একটি রাত আমাকে কাটাতে হয়েছে ইতিহাস বিভাগের ক্লাশ রুমের বেঞ্চে বসে। মনতোষ চক্রবর্তী স্যারের ম্যাক্রো অর্থনীতির মোটা বইটা মাঝেমধ্যে মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করেছি।
আচ্ছা, সবই দুঃখ ছিল- সুখ ছিল না কিছুতে? জিজ্ঞেস করল বেগম জাহানারা।
অবশ্যই ছিল, না হলে কি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারতাম ? যেমন ধরো, আমার সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শন। ভাবজগতের মানুষ বলেই বোধহয় দর্শনের ক্লাশগুলো বরাবরই আমার ভালো লাগত। বিশেষ করে, মোজাফফর হোসেন স্যারের ক্লাশ। তিনি যখন সুখবাদ পড়াতেন, আমার মনে অসংখ্য প্রশ্ন জাগত। ক্লাশেই স্যারকে প্রশ্ন করতাম, তিনি হাসি মুখে উত্তর দিতেন। কখনো বলতেন, ক্লাশের পরে তুমি এসো-সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।
এতসব প্রশ্ন করতাম বলেই বোধহয় সাবসিডিয়ারি ক্লাশের ছাত্ররা ঠাট্টা করে আমাকে দার্শনিক বলে ডাকত।
ও এখন বুঝতে পারছি কেন তুমি দার্শনিক নামের ম্যাগাজিনটি বের করো।
বুঝতে পারার জন্য ধন্যবাদ।
আচ্ছা আব্বু, সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট কী ?
সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট হলো বাড়তি বা অতিরিক্ত সাবজেক্ট। আমাদের সময় অনার্স কলেজগুলোতে সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট ছিল। এখনো আছে কিনা জানি না। আসলে, অনার্সের কঠিন বিষয়কে সহজবোধ্য করার জন্য বাড়তি কিছু জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। সাবসিডিয়ারি সাবজেক্টগুলোকে মনে করা হতো বাড়তি জ্ঞানের যোগানদাতা।
ভর্তি হওয়ার পর তোমার মজিবুর রহমান ভূঁইয়া স্যারের আচরণ কেমন ছিল ? তিনি তো তোমাকে নিতে চাননি।
ভালো। আসলে লোক হিসেবে তিনি বেশ ভালো ছিলেন। অর্থনীতি বিভাগের অধিকাংশ স্যারই যেমন ধরো, মনতোষ চক্রবর্তী, হাবিবুল্লাহ বাহার, শামছুর রহমান, পরে যোগদান করা বসির উদ্দিন স্যার সবাই ছিলেন বড় মানুষ। যত ধুলি মলিনই হোক, মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের নাম স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না ? অন্যবিভাগের শিক্ষক হলেও ইতিহাসের মনিরুজ্জান স্যারকে আমরা সবাই ভয় করতাম। ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের শহীদ আসাদের ভাই বলে তাঁর প্রতি আমাদের অন্যরকম একটা শ্রদ্ধাও জেগে থাকত। বাংলা বিভাগের প্রণব চৌধুরী সরাসরিই আমার শিক্ষক হয়েছিলেন মুসলিম ইনস্টিটিউটে। কিছুদিন তিনি আমাদের কবিতার ছন্দের ওপর ক্লাস নিয়েছিলেন।
অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র হয়ে ক্লাশ করেছ কবিতার ছন্দের ওপর ? বেগম জাহানারার জিজ্ঞাসা।
হ্যাঁ, কবিতা লেখার জন্য ছন্দ জানাটা বড় জরুরি।
তোমর সবচেয়ে প্রিয় স্যার ?
এভাবে বলা বোধহয় ঠিক হবে না। তবে মনতোষ চক্রবর্তী স্যারের কথা আমার সব সময় মনে থাকে। এ ভেরি গুড টিচার, ম্যান অব গ্রেট হার্ট। তাঁর ক্লাশ মানেই ছাত্রদের জন্য আদর্শ একটি ক্লাশ। জনৈক দার্শনিকের একটা কথা আছে, একজন মানুষ কত বড় তার প্রমাণ মেলে ছোটদের সঙ্গে তার ব্যবহারের নমূনা দেখে। ওই দার্শনিকের এ কথার সূত্র ধরেই মনতোষ চক্রবর্তী স্যারের একটা মূল্যায়ণ আমি করতে পারি-একদিনের একটি গল্প বলার মাধ্যমে। ডিপার্টমেন্টের কী জানি একটা অনুষ্ঠান। আজ মনে নেই। গান গেয়েছিলেন আমাদের সিনিয়র এক বোন ফওজিয়া জাহান পপি, সাবেক ভিপি কাজী আজাদ জাহান শামীমের ছোট বোন। আমি পড়েছিলাম স্বরচিত একটি কবিতা। আল্পনা রায়। ছাত্ররা কেউই শুনেনি। সবাই কথা বলছিল। মনতোষ চক্রবর্তী স্যার ছিলেন শ্রোতার সারিতে। তিনি ওঠে এসে আমার হাত থেকে স্ক্রিপটা নিয়ে মাইকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। রুমে পিন পতন নিরবতা। স্যার বললেন, ওর কবিতাটি তোমরা শুনলে না। আমার কাছে ভালো লেগেছে। আমি পড়ছি শোন। স্যার সেদিন আমার কবিতাটি পড়ে যে সম্মান আমায় দিয়েছিলেন তা আমি জীবনে ভুলব না।
আচ্ছা আব্বু, তুমি তোমার একজন স্যারের নামে একটা উপন্যাস লেখছ, কী জানি নাম। ও হ্যাঁ, অধ্যক্ষ হাসান ওয়াইজ। তিনিও কি আনন্দ মোহন কলেজে ছিলেন ?
হ্যাঁ, তিনিও আনন্দ মোহন কলেজেই ছিলেন। অধ্যক্ষ। ছাত্রদের সঙ্গে মিশতেন খুব ফ্রি-লি। প্রায়ই কলেজ হোস্টেল পরিদর্শনে যেতেন। তখন রুমে রুমে গিয়ে ছাত্রদের সুযোগ-সবিধার কথা জানতে চাইতেন। এমনকি চলার পথে কোনো ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলে, মুখ চিনতে পারলেই, তিনি কুশল জিজ্ঞেস করতেন। একদিন তরুণ হোস্টেলের নিচ তলার দুই নাম্বার রুমে আমার রুমমেট গফরগাঁয়ের শফিক তার জুতো পালিশ করছিল। স্যার এসে দেখে ফেললেন। বললেন, খুব ভালো, সব কাজ নিজের হাতে করছিস। খুব ভালো। একদিন এক ছেলের মুখে ঘা হয়েছে। কড়িডোরে সে স্যারের সঙ্গে কথা বলছিল। বলছিল, মুখে ঘায়ের জন্য কিছু খেতে পারছে না। স্যার তাকে ঠাট্ট করে বললেন, কাঁচা মরিচ চিবিয়ে খা। ভালো হয়ে যাবে। একই সঙ্গে নিজের কথাও বললেন, আমি কাঁচা মরিচ খেতে পারি না। আমার তো আলসার।
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নিয়ে তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা একটা ভিন্ন ধরনের সম্পর্ক। না পিতা-পুত্রের, না বন্ধুত্বের। এটা অধিক গুরু শিষ্যের। অন্যকথায়, শিক্ষক হলেন ছাত্রের ঝঢ়রৎরঃঁধষ ঋধঃযবৎ. তাঁর এ কথা কতই না মূল্যবান।
ইসলামি ফান্ডেশনের বক্তৃতার অনুানে, বিজ্ঞান মেলার উপস্থিত বক্তৃতায় তিনি যখন সভাপতিত্ব করতেন আমার সাহস বেড়ে যেত। তুমি জানো, স্যারের সঙ্গে এখন পর্যন্ত আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে। ঢাকার উত্তরায় সপরিবারে তিনি থাকেন।
আচ্ছা আব্বু তোমার একজন স্যার যিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে মাঝেমধ্যে বিদেশ যান-তাঁর না কী নাম ?
কবীর চৌধুরী।
তিনিও কী আনন্দ মোহন কলেজে ছিলেন ?
হ্যাঁ, কিন্তু অনেক আগে। পত্রিকার লেখা, সম্পদনা করা, বিশ্ব সাহিত্যে ওপর গবেষণা করা আর দেশ-বিদেশের বিশিষ্টজনদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার সুবাধে একদিন জানতে পারি তিনি আনন্দ মোহন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। শেখ হাসিনার বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সময় তিনি জাতীয় অধ্যাপক হয়েছিলেন। আমার অনুবাদ গল্পের বইটিতে তিনি যে তাঁর অভিমত দিয়েছেন সেটা তো তুমি দেখেছ ?
জ্বি আব্বু দেখেছি।
তাঁর সিগনেচারটা ওখানে স্ক্যান করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
হ্যাঁ।
তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রবীণ অনুবাদকদের একজন। তাঁর অনুবাদকৃত বইয়ের সংখ্যাই শতাধিক। তাঁর লেখা বহু বইয়ের রিভিউ আমি করেছি জাতীয় দৈনিকের সাময়িকীতে ও সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিনে, একটু খুঁজলেই তুমি পেয়ে যাবে।
তোমার ক্লাশমেট যেসব বন্ধুর কথা মাঝেমধ্যে তুমি বলো...।
ক্লাশমেটদের অনেকের কথাই এই মুর্হতে আমার মনে পড়ছে। কে কোথায় আছে জানি না-কিন্তু হৃদয়ের গহীন তলে তাকালে তাদের প্রত্যেকের মুখ দেখতে পাই।
হ্যাঁ আব্বু, মনে করতে চাইলে মনে করা যায়। মানুষের মুখ বা যেকোনো ঘটনা। এই যেমন এখন আমি আমার শান্তি খালামনির মুখ দেখতে পাচ্ছি। অথচ কতদিন হয়ে গেছে তার সঙ্গে দেখা হয় না।
আচ্ছা আব্বু স্মৃতি কীভাবে কাজ করে ?
খুব জটিল প্রশ্ন বাবা ? দার্শনিক ও বিজ্ঞানিরা এ নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছেন। কিন্তু এখনো কেউই শেষ কথা বলতে পারেননি। তাদের চিন্তাগুরো নিয়ে একদিন তোমাদের সঙ্গে আলাপ করা যাবে।
॥ বারো ॥
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যে সাতটার পরে দুদিনের সফরে পিয়াসদের পরিবার দুর্গাপুরে পৌঁছল। আগে থেকে ডাকবাংলায় রুম বুকিং দেয়া ছিল বলে থাকার জায়গা নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না তাদের। বাংলাদেশের বৃহত্তর জেলা ময়মনসিংহের সর্বোত্তরের সীমান্ত শহর এটি। বর্তমানে নেত্রকোণা জেলায় পড়েছে। এটি ভারতের মেঘালয় এর সঙ্গে লাগুয়া। আগে দুর্গাপুরকে বলা হতো সুসঙ্গ দুর্গাপুর। শহরটি সুমেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড়ের গভীর থেকে বেরিয়ে এসেছে সুমেশ্বরী। দুর্গাপুর থেকে মেঘালয়ের দূরত্ব দুই-তিন মাইল আর গারো পাহাড়ের দূরত্ব চার-পাঁচ মাইল। জায়গাটা সুন্দর হলেও এর ইতিহাস অসংখ্য যুদ্ধ বিগ্রহে ভরা। টঙ্ক আন্দোলন ও হাজং বিদ্রোহ এ এলাকার ইতিহাসকে অনেকখানি সমৃদ্ধ করেছে। টঙ্ক আন্দোলনের নেতা কমরেড মনি সিং এই দুর্গাপুরেরই সন্তান।
১৩ শতকে প্রতিতি বিখ্যাত সুসঙ্গ রাজ বংশের লোকেরা এখানে শত শত বছর ধরে বসবাস করেছে। মুসলমানদের শাসনকাল শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ময়মনসিংহের উত্তর-পূর্বের বিশাল অংশ জুড়ে সুসঙ্গদের রাজ্য বিস্তৃত ছিল। মনে করা হয় সোমেশ্বর পাঠক সুসঙ্গ রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১২৮০ খ্রিঃ (৬৮৬ বঙ্গাব্দ) কান্যকুব্জ থেকে এই অঞ্চলে আগমন করেন। সোমেশ্বর পাঠক হোচং ও দুর্গা নামক দুই গারো দলপতিকে হত্যা করে তাদের স্থান দখল করেন। অনেকে মনে করেন, সুসং বা সুসঙ্গ দুর্গাপুর নামদ্বয়ের উৎপত্তি উক্ত হোচং ও দুর্গা গারোর নাম থেকেই হয়েছে। একইভাবে সমভূমির জোয়ার অঞ্চলসমূহের অধিকর্তা জোয়ারদারদের পদানত করে তিনি তাদের এলাকাগুলো একে একে দখল করেন এবং নিজ রাজ্যভূক্ত করে বৃহত্তর সুসঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন সুসঙ্গ রাজ্যের ছয়টি জোয়ার বা বিভাগ ছিল, যেমন: বওলা, উজান, সুসঙ্গ, রায়পুর, বারসহস্র এবং ভাটি জোয়ার।
শেখ দরদ বলল, পিয়াস আমরা তো আমাদের রাজার শহরে রাত কাটিয়ে যাচ্ছি। আল্লাহকে ধন্যবাদ যে, তিনি আমাদের এই ঐতিহাসিক শহরটি দেখার সুযোগ দিয়েছেন।
হ্যাঁ, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী। বলল বেগম জাহানারা।
রাতের খাবার খেয়ে এই রুমে পাশাপাশি খাটে চারজন শুয়েছে তারা। পিয়াস তার আব্বুর সঙ্গে। শেখ দরদ শুয়ে শুয়ে পত্রিকার পাতা উল্টাছে। পিয়াস বলল, আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না আব্বু-প্রাচীনকালে আমাদের অঞ্চল থেকে মানুষ এখানে আসত কেমন করে ?
তখনকার বাস্তবতায় আমার মনে হয় না সাধারণ কোনো মানুষ এখানে আসত। এই যেমন আমরা এসেছি বেড়ানোর জন্য। তবে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা লুণ্ঠনকারীরা হয়তো আসা-যাওয়া করত। রাস্তাঘাট, যানবাহন ছিল না, চারপাশে ছিল শুধু জঙ্গল। আমি তখনকার মানুষের জীবন বাস্তবতা কল্পনাও করতে পারি না। জানি না কত অসহায় ছিল তারা।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই তারা ছুটল সুমেশ্বরীর তীরে। শীতকালে সুমেশ্বরী হয়ে পড়ে জীর্ণ-শীর্ণ। শুকিয়ে মাঝখান দিয়ে একটি ধারা প্রবাহমান থাকে। এক মাইল প্রশস্তের নদীর মাঝখানের ধারায় হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি থাকে। তারা বালুচরে খালি পায়ে হাঁটে। পিয়াস সামিয়া হাত ধরে ছুটাছুটি করে। পানি ছিটিয়ে দেয় একে অপরের শরীরে। শেখ দরদ কিছু বালি হাতে নিয়ে বেগম জাহানারাকে ডাকে। দেখো দেখো কত দানাদার বালি। আর কত পরিষ্কার ও ঝকমকে।
হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি তো। এই জন্যই সুমেশ্বরীর বালির দাম অনেক বেশি।
বাড়ি করলে আমরা সুমেশ্বরী থেকে বালি ও পাথর নেবো।
তাহলে বালির জন্য আসতে হবে শীতকালে আর পাথরের জন্য আসতে হবে বর্ষাকালে। আমি একটি পত্রিকায় পড়েছিলাম।
সবাই নদীতে নেমে গেল গোসল করার জন্য। পিয়াস দুহাত ভরে পানি তুলে ছুঁড়ে মারল সামিয়ার দিকে। কী পরিষ্কার নীল পানি!
আমার ইচ্ছে করছে একটু খেয়ে দেখতে।
আমারও। পিয়াসের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলল সামিয়া।
না না। পেট খারাপ করতে পারে। বেগম জাহানার বারণ করে।
আম্মু এটা তো ঝরণার পানি। দোষণ মুক্ত। পিয়াস বলল।
হোক তবু খাবে না। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করো। এক্ষনি ডাকবাংলায় গিয়ে খাওয়া সাড়তে হবে।
দ্রুতপায়ে ডাকবাংলায় ফিরল তারা। এরপর নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়ল, শহরের ভেতরেই কমরেড মনি সিংয়ের বসত ভিটায় টঙ্ক আন্দোলনের (১৯৩৯-১৯৪৯) শহীদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত টঙ্ক শহীদ স্মৃতি সৌধ দেখার জন্য।
স্মৃতি সৌধের পাশে দাঁড়িয়ে শেখ দরদ বলল, মনি সিং-এর লেখা জীবন সংগ্রাম বইটা আমাদের ঘরে আছে। দেখেছ?
শুধু দেখিনি, পড়েছিও। একবার তোমকে বলিনি, ব্রিটিশ বিরোধী চট্রগ্রাম আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র সম্পর্কে আমি প্রথম পড়ি মনি সিংহের বইয়ে।
হ্যাঁ মনে পড়ছে, বলেছিলে।
এরপর ওখান থেকে তারা গেল বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারেল সেন্টারে। ওখানে উপজাতীয় মেয়েদের নাচগান দেখল তারা। নাচগান দেখে যখন তারা ওখান থেকে বের হলো ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে।
দুপুরের খাবার খেয়ে তারা আবার বেরিয়ে পড়ল বিজয়পুরের উদ্দেশ্যে। ওখানে বিশাল এলাকা জুড়ে চিনামাটির খনি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাদা পাহাড় আর টিলা। শ্রমিকরা পাহাড় কেটে কেটে ট্রাক বোঝাই করে দিচ্ছে। ট্রাক চলে যাচ্ছে বড় বড় সিরামিকস শিল্পগুলোয়। দুর্গাপুরের স্থানীয় একজন লোক শেখ দরদকে জানালো, এ চিনামাটির খনি থেকে দুর্গাপুরের মানুষ কোনোভাবে লাভবান হয়নি।
ওখান থেকে রানী খং-এর উদ্দেশ্যে আবার রিকশায় চড়ে।
রানী খং-এ কী আছে আব্বু ? রিকশায় উঠতে উঠতে সামিয়া জানতে চাইল।
গেলেই দেখতে পাবে।
তুমি বলো না।
রানী খং খুব সুন্দর একটা জায়গা। ওখানে আছে একটি খ্রিস্টিয়ান মিশন। আর রানী খংয়ের অদূরে বহেরাতলীতে আছে টঙ্ক আন্দোলনের শহীদ (১৯৪৬) রাশীমন স্মৃতি সৌধ। বেদির ওপর তীর-ধণুক। আদীবাসীদের যুদ্ধাস্ত্রের প্রতীক। মূলত ওটা দেখার জন্যই আমি দুর্গাপুর এসেছি।
রিকশা চলছে। শেখ দরদ গলা ছেড়ে গান ধরেছে, ও আমার দেশের মাটি তোমার কোলে ঠেকাই মাথা। ঠিক এ সময়ই বেগম জাহানারার ব্যাগের মধ্যে ফোন বেজে উঠল।
হ্যালো, হ্যালো কে? ও রওশন আপা? তাই নাকি? কখন থেকে? কিন্তু আমরা তো এখন দুর্গাপুরে।
হ্যাঁ। সে ফোন সেটের মুখ হাতের তালু দিয়ে চাপা দিয়ে শেখ দরদকে বলল, শুভ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রওশন আপা বলছেন-তোমাকে দরকার। তোমার সাহায্য দরকার। কী বলব ?
আমার কাছে দাও।
বেশি অসুস্থ? আচ্ছা ভাববেন না আমরা আজই চলে আসছি। হ্যাঁ, কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রা শুরু করব।
আচ্ছা, আচ্ছা।
ফোন কান থেকে নামিয়ে শেখ দরদ বলল, আমরা এখান থেকে ঘুরব। রানীখং আর যাবো না।
আম্মু শুভ অসুস্থ হলে আমাদের চলে যেতে হবে কেন?
শুভর আম্মু তোমার আব্বুর সাহায্য চাইছেন।
সাহায্য তো কালকে গিয়ে করলেও চলবে।
কী বলছ ভাইয়া ? শুভ ভাইয়া না তোমার বন্ধু।
তুই চুপ কর।
হ্যাঁ, শুভ না তোমার বন্ধু। শেখ দরদ বলল।
বন্ধু তো কী হয়েছে ? তার জন্য আমাদের সব কাজকর্ম বাদ দিতে হবে?
পিয়াস তুমি কিন্তু খুব হীনমন্যতার পরিচয় দিচ্ছ। তোমার প্রতি আমার মন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
থামো তুমি থামো। আমি দেখছি। বেগম জাহানারা শেখ দরদকে থামাল।
কিন্তু আম্মু রানীখংটা কত কাছে। এমন সুন্দর একটা জায়গাটা। এত কাছ থেকে না দেখে চলে যাচ্ছি।
হ্যাঁ, খারাপ লাগারই কথা। তবু শুভর জন্য তোমার আব্বু সাহায্য দরকার।
আচ্ছা ঠিক আছে। মন মরাভাবে বলল পিয়াস।
এত খারাপ লাগার তো কোনো কারণ নেই। তুমি কি পড়োনি,
বিপুলা এ পৃথিবীর আমি কতটুকু জানি
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী-গিরি-সিন্ধু-মরু,
কত-না অজানা জীব কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে।
পড়েছি আব্বু।
যদি পড়েই থাক তাহলে মন খারাপ করো কেন? জগতের সবকিছু তোমার পক্ষে দেখা সম্ভব না। সাদ্দাত বেহেস্ত তৈরি শেষ করেও তাতে প্রবেশ করতে পারেনি। আল্লাহ তার জান কবজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
জানি আব্বু।
জ্ঞান যদি কাজেই না লাগে অর্জন কী লাভ ? বন্ধুর জীবনের চয়ে সুন্দর দৃশ্য বড় না।
সামিয়া বলল, আব্বু ভাইয়া তো মেনে নিয়েছে। শুভর জন্যও তো ভাইয়ার খারাপ লাগছে।
খারাপ লাগলে আমার মুখের ওপর সে না করতে পারত না। দেখো, আমি জানি, পৃথিবীতে এমন অনেক সুন্দর জায়গা আমার দেখার বাইরে থেকে যাবে। আমি বরং কল্পনা করে নিতে চেষ্টা করি। মনে মনে বলি, পরে একসময় গিয়ে দেখে নেব-জায়গাটা সম্পর্কে আমি কতটুকু কল্পনা করতে পেরেছিলাম।
বেগম জাহানারা বলল, শোনো পিয়াস, পৃথিবীর সব শহর, নগর, বন্দরের ভিত্তি প্রস্তর বসানোর আগে মানুষ কল্পনা করে নিয়েছে। এখন তো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপত্যবিদ্যার ওপর ডিগ্রি দিচ্ছে। আগে এমন শিক্ষিত ইঞ্চিনিয়ারের অভাব ছিল। কিন্তু তবু কেউ না কেউ কল্পনা দিয়ে একটি আকার দিয়ে নিতো তার শহরের, বন্দরের, প্রাসাদের। আগ্রার তাজমহলের কথা ধরো, সম্রাট শাহ জাহান তো স্থাপত্য কিংবা পুরো-প্রকৌশল বিদ্যায় শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু তাজমহলের নকশার প্রথম ড্রাপটা তাঁর মাথাতেই অঙ্কিত হয়েছিল। কাজেই তুমি ইচ্ছে করলেও একটি শহর কল্পনা নিতে পারো। যমকালো করে সাজিয়েও নিতে পারে মনের সব রঙ লাগিয়ে।
সরি আম্মু। ভবিষ্যতে এমনটি আর করব না।
না তুমি আগেও একদিন শুভ ফার্স্ট হয়েছিল বলে তার প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করেছিল।
আগের কথা থাক। বলেছে তো ভুল হয়েছে।
আব্বু ভাইয়াকে ক্ষমা করে দাও।
পিয়াস মুখ ভার করে দূররে দিকে তাকিয়ে আছে।
পিয়াস, বেগম জাহানারা বলল, বন্ধু হিসেবে না হয় শুভকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করো। একটা জীবনের চেয়ে মহৎ কিছু হতে পারে না। শেখ দরদ বেগম জাহানারার কথা কেড়ে নিয়ে বলল, পিয়াস, তোমাকে মাঝেমধ্যে আমি বুঝতে পারি না। তুমি আমার ছেলে। তোমার তো হীনমন্যতার পরিচয় দিলে চলবে না। সত্যি বলেছ পিয়াসের মা। বিপদাপন্ন মানুষের পাশেই যদি আমরা দাঁড়াতে পারি তাহলে কী হবে সুন্দর কল্পনা দিয়ে, কবিতা লিখে ? সব সুন্দর তো মানুষের জন্যই। মানুষই যদি না থাকে তাহলে কার জন্য এত আয়োজন ? ধরো, প্রতিযোগীতা না থাকলে তুমি কার সঙ্গে লড়বে ? আর প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়ার করার অর্থ এই নয় যে, তাকে মেরে ফেরতে হবে। আগের দিনে মানুষ এত সভ্য ছিল না। তারা তাদের প্রতিযোগীকে মেরে ফেলত।
আব্বু আমাকে ক্ষমা করে দাও। সত্যি আমার ভুল হয়ে গেছে।
আব্বু ভাইয়া তার ভুল বুঝতে পেরেছে তাকে ক্ষমা করে দাও।
ঠিক আছে ক্ষমা করে দিলাম।
দুপুরের মধ্যেই তারা ময়মনসিংহ শহরে পৌঁছে গেলো। বাস থেকে নেমে শেখ দরদ বলল, তোমরা বাসায় চলে যাও। আমি যাব হাসপাতালে। পরের পরিস্থিতি ফোন দিয়ে জানাব।
পিয়াস বলল, আব্বু আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। শুভর জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে।
আব্বু ভাইয়াকে নিয়ে যাও। আমার ভাইয়াটা কত ভালো।
ঠিকানা:
গাজী সাইফুল ইসলাম
অগত্যা, তৃতীয়তলা,
কাঁচিঝুলি মোড়, ময়মনসিংহ।
মোবাইল-01911715835